গবেষণায় তথ্যকম ওজন নিয়ে জন্মানো শিশুর হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে-শিশুর সংক্রমণ ৪০% কমায় মায়ের পুষ্টিশিক্ষা by শিশির মোড়ল


মাকে শিক্ষা দিলে শিশুর শ্বাসতন্ত্রের রোগ ও ডায়রিয়ার সংক্রমণ ৪০ শতাংশ কমে যায়। শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মালেও মা যদি বুকের দুধ খাওয়ানোর বিষয়ে সঠিক শিক্ষা পান, তাহলে সেই শিশুর পুষ্টি-পরিস্থিতি ও স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। এটি গবেষণায় পাওয়া তথ্য। বাংলাদেশের পাঁচজন গবেষক মাতৃসেবা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেবা নিতে আসা ১৮৪ জন মা ও ১৮৪ জন কম ওজনের শিশুর ওপর এ গবেষণা


করেছেন। সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রবন্ধ গত নভেম্বরে ইউরোপিয়ান জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন-এ প্রকাশিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) পুষ্টি বিভাগের প্রধান তাহমিদ আহমেদ বলেন, শিশুর অপুষ্টি দূর করার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা। এটা বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজে লাগানো দরকার। তিনি বলেন, বিরাজমান অপুষ্টি দূর করতে আসলে দরকার সমন্বিত পন্থা।
শিশু পুষ্টিবিদ অধ্যাপক এম কিউ কে তালুকদার বলেন, নবজাতক মৃত্যুর প্রধান কারণ সংক্রমণ, শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতা এবং জন্মের সময় কম ওজন। বুকের দুধ সংক্রমণ বন্ধে ও শিশুর ওজন বাড়াতে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে; শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতা দূর করতে পরোক্ষভাবে কাজ করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কম জন্ম-ওজন বাংলাদেশের জন্য একটি জনস্বাস্থ্য সমস্যা। সর্বশেষ জরিপ বলছে, দেশে ৩৭ শতাংশ নবজাতক কম ওজন নিয়ে জন্মায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘ শিশু তহবিল ইউনিসেফ বলছে, জন্মের সময় ওজন ২৫০০ গ্রামের কম হলে সেই শিশু লো বার্থ ওয়েট (এলবিডব্লিউ)। ৩৭ সপ্তাহ গর্ভে থাকার আগেই জন্ম নিলে এবং জরায়ুর অভ্যন্তরে বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হলে নবজাতকের ওজন কম হয়।
কম ওজন নিয়ে জন্মানো শিশুর হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। শহরের (২৯%) চেয়ে গ্রামে (৩৭%) এই হার বেশি। কম ওজন নিয়ে জন্মানো নবজাতক মৃত্যুর ৮৪ শতাংশ ঘটে প্রথম সাত দিনে এবং অর্ধেক প্রথম ৪৮ ঘণ্টায়।
লন্ডন থেকে প্রকাশিত প্রখ্যাত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকীতে বলা হয়েছে, ২৫০০ গ্রাম ওজন নিয়ে জন্মানো নবজাতকের চেয়ে ১৫০০-১৯৯৯ গ্রাম ওজন নিয়ে জন্মানো নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি আট গুণ, ২০০০-২৪৯৯ গ্রাম ওজন নিয়ে জন্মানো নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি তিন গুণ বেশি।
গবেষণার কথা: ২০০৮ সালে পাঁচজন গবেষক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং আজিমপুরের মাতৃ ও স্বাস্থ্যসেবা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ১৮৪ জন মা ও ১৮৪ জন নবজাতক নিয়ে এ গবেষণা করেন। তাঁদের মধ্যে ৯২ জন মাকে প্রসবের পর পরই শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর ওপর শিক্ষা দেওয়া হয়। দুই মাসে মোট চারবার এ শিক্ষা দেওয়া হয়।
গবেষক দলের প্রধান বিশিষ্ট পুষ্টিবিদ ও বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের সভাপতি এস কে রায় বলেন, ‘মাকে এবং মায়ের পরিবারের সদস্যদের আমরা পুষ্টির বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছিলাম, সচেতন করেছিলাম।’ এ শিক্ষার মধ্যে ছিল: প্রি-ল্যাকটাল (মায়ের দুধ ছাড়া পানি-মধুজাতীয়) খাবার বাদ, জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানো, শিশুকে যথাযথভাবে স্তনের স্পর্শে রাখা, সঠিকভাবে বুকের দুধ খাওয়ানো, ছয় মাস পর্যন্ত শিশুকে শুধু বুকের দুধ খাওয়ানো, যত দিন বুকের দুধ খাওয়াবেন, তত দিন মাকে মানসম্পন্ন খাবারের পরিমাণ বেশি দিতে হবে এবং বেশিবার দিতে হবে। এ ছাড়া নির্মল খাদ্য ও ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার ওপরও শিক্ষা দেওয়া হয়।
গবেষণা প্রবন্ধে দেখা যায়, শিক্ষা পাওয়া মায়েদের জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে বুকের দুধ খাওয়ানোর হার ৬২ শতাংশ, অন্যদের ক্ষেত্রে তা ৩৭ শতাংশ। শিক্ষা পাওয়া মায়েদের মধ্যে শুধু বুকের দুধ খাওয়ানোর হারও বেশি (৬০% বনাম ৩৭%)। শিক্ষা পাওয়া মায়েদের শিশুদের মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের রোগ ও ডায়রিয়ায় সংক্রমণের হার অন্য শিশুদের তুলনায় ৪০ শতাংশ কম।
এস কে রায় জানান, গবেষণা প্রবন্ধটি তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠিয়েছেন। তিনি বলেন, মাকে শিক্ষা দেওয়ার কাজে সরকারের মাঠপর্যায়ের কর্মীকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকে এ কাজের দায়িত্ব দিতে হবে নার্সদের।

No comments

Powered by Blogger.