রাজনীতি-গুজব আর ষড়যন্ত্রের দোনলা বন্দুক by ফারুক ওয়াসিফ

র কাছে যা গুজব, ওর কাছে তা সত্য। রাজনৈতিক উত্তেজনা যখন তুঙ্গে ওঠে, সে রকম সময়ে সত্য আর গুজবের মধ্যে ফারাক করা কঠিন হয়ে যায়। তবে গুজব অনেক সেয়ানা, সত্যের থেকে তার কাটতি ও গতি অনেক বেশি। গত রোববার যখন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চোরাগোপ্তা হামলা ও পুলিশি অ্যাকশন তুঙ্গে, তখনই গুজব রটে গিয়েছিল, জামায়াতের সাবেক আমির, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত গোলাম আযমের গ্রেপ্তারের প্রতিক্রিয়ায় শিবিরের


কর্মীরা ভাঙচুর-জ্বালাও-পোড়াও শুরু করেছে। পরে দেখা গেল, গোলাম আযম গ্রেপ্তার হননি এবং ভাঙচুর-জ্বালাও-পোড়াওয়ের কারণও সেটা নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনার নামে বড় আকারের শোডাউন করতে চেয়েছিল বিএনপি, তাতে পুলিশের বাধাদান থেকেই ঘটনার শুরু। প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির সমর্থকেরা রাস্তাঘাটে সহিংস আচরণ করেন। দেখা গেল, ঢাকা তখন গুজবে ভরপুর। অল্প সময়ের মধ্যে রাস্তাঘাট ফাঁকা হতে থাকে, আতঙ্ক শীতের কুয়াশার মতো ঢাকাকে ঢেকে দিতে পারে।
পেরেছে, কারণ রাজনৈতিক দুর্যোগের সম্ভাবনায় মানুষ শঙ্কিত। যখন সরকারের প্রতি আস্থা কমতির দিকে, যখন বিরোধী দল ক্ষমতার লোভে দায়িত্বহীন হয়ে যায়, আতঙ্ক ও গুজবের ডালপালা মেলার সেটাই সুবর্ণ সময়। গবেষকেরা দেখিয়েছেন, গুজব তখনই বেশি ছড়ায়, যখন জনজীবনের তলায় চাপা উত্তেজনা ও ভয় বাসা বাঁধে। যে হারে সরকার ও বিরোধী দল পরস্পরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলছে, তখন গুজবে কান না পেতে উপায় কী? যা হতে পারে, যা হওয়া উচিত এবং যা মানুষ বিশ্বাস করতে ভালোবাসে, তাই গুজবের খোরাক।
কেবল এ দেশেই নয়, গুজবের রাজনৈতিক ব্যবহার খোদ আমেরিকায়ও কম নয়। প্রতিপক্ষ গুজব ছড়িয়েছিল, প্রেসিডেন্ট ওবামা আমেরিকার নাগরিকই নন। গুজবের চাপে ও চোটে ওবামাকে শেষ পর্যন্ত তাঁর জন্মসনদ প্রকাশ করতে হয়েছে। যা হোক, ওবামা তো প্রমাণ করেছেন তিনি মার্কিন নাগরিক। কিন্তু আমাদের এখানে সরকার বা বে-সরকার কারও দিক থেকেই এ রকম সত্য উন্মোচনের দায়িত্ব নেওয়ার নজির কম। সরকার বা বিরোধী দলের উত্থাপিত অভিযোগগুলোর বেশির ভাগই অপ্রমাণিত থেকে যায়। কিন্তু সেসব নিয়ে রাজনৈতিক গুজব চলতে থাকে, অভিযোগ বাড়তেই থাকে।
রোববারের চোরাগোপ্তা হামলায় দুজনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছি, এই ঘটনার দায় কার বলে মনে করেন? উত্তর শুনে মনে হলো, সবাই সবকিছু জানেন। কেউ বলেননি আমি জানি না। যিনি যেমন গুজবে কান পেতেছেন, যেমন অভিযোগ মনে ধরেছে, তেমন বিবেকই তাঁর জেগেছে। কেউ দুষলেন বিএনপিকে, কেউ ঝাড়লেন সরকারকে। অভিযোগের ছাঁচটা আগে থেকেই তৈরি থাকে, দরকারমতো কেবল স্থান-কাল-পাত্রের নাম বসিয়ে নিলেই ঝাঁজালো অভিযোগ দাঁড়িয়ে যায়। আর তারপর শুরু হয়ে যায় যাত্রাপালার বিবেকের মতো সংলাপ। আমাদের একটি মানবাধিকার কমিশন রয়েছে। স্ব-উদ্যোগে তদন্ত কমিটি গঠন করে সত্য খুঁড়ে বের করার এখতিয়ার তাদের থাকার কথা। কিন্তু মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্যগুলো যতটা না তদন্তজাত, তার থেকে বেশি বিবেকজাত। কিন্তু প্রশ্নটা তো বিবেকের নয়, প্রশ্নটা সত্য-মিথ্যার। কারা একযোগে ৫০টি জায়গায় বোমা-ককটেল ফাটাচ্ছে, কারা যাত্রীভর্তি বাসে আগুন ধরাচ্ছে? এসবের বিহিত তো অভিযোগ বা গুজব দিয়ে হবে না। একটি নিরপেক্ষ তদন্তজাত বিবরণ কি আমরা পাব না? সত্যই নাকি বিবেক আর বিবেকই নাকি সত্য। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সত্য গুম আর বিবেক অতি জাগ্রত। বিবেক যদি সত্য দেখতে না পায় তার জাগরণ কীকাজে লাগবে?
এ রকম অবস্থা কারও জন্যই ভালো নয়। যখন ঘটনার কার্যকারণ জানা যায় না, যখন অন্যায়ের প্রতিকার হয় না, যখন রাজনীতির কলকাঠিরা সত্যকে এড়ান, যখন তথ্যের জায়গা নেয় গুজব, তখন আসলেই অনিশ্চয়তা ও অজানা ভয় মানুষকে কামড়াতে থাকে। এ রকম একটি অবস্থা দেখেই সম্ভবত বিশিষ্ট আইনজীবী ও শিক্ষক শাহ্দীন মালিক নাগরিক কমিটির সভায় বলেছেন, ‘আমরা অরাজকতার দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছি।’
আমাদের তথ্যভিত্তিক সত্য বলে কিছু নেই, সবকিছুর মতো সত্যও এখানে দুই দলের দুটি ধারায় দ্বিফলা নদীর মতো প্রবাহিত। গুজব আর ষড়যন্ত্রের অভিযোগের দোনলা বন্দুকের সামনে সত্যভীত ও বিব্রত। কিন্তু মতিঝিলে যিনি ককটেলাহত হয়ে রাস্তার মধ্যে প্রাণত্যাগ করেছেন, সিলেটে যিনি বাসের মধ্যে পুড়ে অঙ্গার হয়েছেন, তাঁদের ঘাতকেরা তো গায়েবি কেউ নয়। তাহলে তারা কারা? গুজব কিংবা অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ নিহতদের পরিবারের শোকের হুতাশনে আরো ঘী ঢালবে বরং, সান্ত্বনা দেবে না। তাঁরা বিচার চান, আর বিচারের জন্য দরকার তথ্য-প্রমাণ। সাধারণ মানুষও সেটাই চায়।
গুজব রয়েছে, গুমহত্যাগুলো সরকারি সংস্থার কাজ। মানবাধিকার সংস্থাগুলো থেকে শুরু করে সরকারি মানবাধিকার কমিশনও এমনটাই মনে করে। ক্রসফায়ারের যুগে বসবাস করে এই গুজবকে সত্য বলেই মনে হয়। কিন্তু প্রমাণের দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না। আবারও মার্কিন দেশের আরেকটি উদাহরণ চলে আসবে। টুইন টাওয়ার ধ্বংস নিয়ে সরকারি ভাষ্য বিশ্বাস করেননি অনেকে। এ নিয়ে অজস্র গুজবে যখন কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়, তখন একদল মার্কিন নাগরিক, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, তাঁরা পাল্টা একটা গণতদন্ত কমিশন করে পাল্টা সত্য হাজির করলেন। দেখালেন, কীভাবে ওয়ার অন টেররের নামে নিরীহ মার্কিন নাগরিকদেরও হয়রানি-নির্যাতন করা হচ্ছে। সরকারি ভাষ্যের ফাঁকফোকর দেখিয়ে দিয়ে সরকারকে জবাবদিহির মুখে ফেললেন। গুমহত্যা নিয়েও কি সে রকম একটি গণতদন্ত কমিশন হতে পারে না? কিন্তু হচ্ছে না। আমাদের জাতীয়নাটকে অজস্র বিবেকের উপস্থিতি, কিন্তু দায়িত্ব নেবার লোক কম।
‘গুজবে কান পাতবেন না’ এমন নির্দেশনা সাধারণত সরকারি মহল থেকেই আসে। অথচ তাদেরই উচিত গুজবে কান পাতা এবং তার জবাব দেওয়া। নইলে দুটো জিনিস ঘটবে: এক, সকল গুমহত্যার দায় চাপবে গিয়ে র‌্যাব-পুলিশ ইত্যাদির ওপর এবং মনে করা হবে, এতে সরকারের সায় রয়েছে। দুই, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়ও অজ্ঞাত অপরাধীদের ওপর চাপানো যাবে। আসলেই কী হচ্ছে, কারা করছে, তা জানানোর দায়িত্ব সরকারের। নইলে, গুজবের বন্যায় মানুষ অন্যায়কে ভাসিয়ে নিতে চাইবে। বলাবাহুল্য, ক্ষমতাসীনদের প্রতিই অবিশ্বাসের তীর বেশি নিক্ষিপ্ত হয়। গুজব জনগণের মিডিয়া, সেই মিডিয়া-নিক্ষিপ্ত গুজবের তীর কিন্তু একটাও মাটিতে পড়ে না।
২০১১ সালের চালু গুজবগুলোর একটি ছিল ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র’। বলা যায়, বিচার শুরু হওয়ারই সমান বয়সী এই গুজব। খোদ সরকারই এই গুজবের একনিষ্ঠ বিশ্বাসী ও প্রধান প্রচারক। ষড়যন্ত্রটা কী এবং কীভাবে সেটা বাস্তবায়িত হবে, সে বিষয়ে আমাদের কেউই পরিষ্কার করেনি। এ অবস্থায়, সত্যিকার ষড়যন্ত্র থেকে থাকলেও মানুষ তা জানবে না, জেনে মোকাবিলায় প্রস্তুত হতে পারবে না এবং সরকারও মিথ্যাবাদীরাখালের মতো হয়ে পড়বে একা।
রাখালের গল্পটা আমরা সবাই জানি: মিথ্যা হুঁশিয়ারি দিয়ে গ্রামবাসীর এতই বিরাগভাজন হয়েছিল সেই রাখাল যে সত্যিই যখন বাঘ এল, তখন কেউ তার ডাকে সাড়া দিল না। তাতে ক্ষতি হলো সবারই। এক তেঁদড় রসিক গল্পটার উল্টো বয়ান বের করেছেন। তিনি বলছেন, গল্পটাকে বাঘের দিক থেকে দেখলে কেমন হয়? সব বাঘ মিলে এক বাঘকে দায়িত্ব দিল, গরু-মহিষ এলেই তুমি আমাদের খবর দেবে। চতুর বাঘ একদিন গরু গরু বলে চেঁচাল। সবাই এসে দেখল, কিসের গরু, ভেড়াটি পর্যন্ত নেই। সবাই চলে গেল। আরেক দিন বাঘটি একই রকম গরু গরু করে বন মাথায় করল। সব বাঘ দৌড়ে এসে একই রকম ধোঁকা খেল। এখন আর কেউ বাঘটিকে বিশ্বাস করে না। অবশেষে সত্যি সত্যিই একটি গরু একদিন পথ ভুলে বনের পাশে এল। ধূর্ত বাঘ সেদিনও সবাইকে ডাকল; যথারীতি কেউ এল না। এই সুযোগে বাঘটি একাই গরুটিকে সাবাড় করল।
গল্পের দুটি শিক্ষাই মূল্যবান। মিথ্যাবাদী হওয়ার সুবিধা কেবল বাঘই পায়, রাখাল ও তার গরুরা কেবল শিকারই হয়। সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই জনগণের রাখাল, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব তাদের। একই সঙ্গে, সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত গণতন্ত্রের জিম্মাদারও তারা। তাদের দায়িত্বহীনতা ও ভুলের জন্য জীবন ও অধিকার খোয়া গেলে তার দায় তো তাদেরই নিতে হবে।
সিলেটে জীবন্ত দগ্ধ হওয়া সেই বাসযাত্রীর একটি ছবি প্রথম আলোতেই ছাপা হয়েছিল। অসহায় অবস্থায় পুড়তে পুড়তে মানুষটি কেবল একটি পা জানালা দিয়ে বের করতে পেরেছিলেন। দাউ দাউ জ্বলতে থাকা বাসের জানালা দিয়ে বেরিয়ে থাকা জুতো পরা একটি পা আমরা সবাই দেখেছি। এসব সত্য-মিথ্যা, গুজব-অভিযোগ আর ক্ষমতার খেলার দিকে উঠে আসা সেই পোড়া পায়ের ধিক্কারটা ভুলবার নয়।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.