সুশাসনের প্রশ্নে... by মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

একটি রাষ্ট্রের কিছু সার্বভৌম অধিকার আছে। ঐতিহ্যগতভাবে সেই অধিকারকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়- নির্বাহী ক্ষমতা, আইন প্রণয়ন ক্ষমতা ও বিচারিক ক্ষমতা।
এই তিন ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য পৃথক্করণের কথা বলা হয়েছে, যেন কোনো একটি বিভাগ অতিরিক্ত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশের নাগরিকদের জীবন বিপন্ন করে তুলতে না পারে। রাষ্ট্রক্ষমতার এই হরাইজন্টাল বা সমান্তরাল পৃথক্করণের পাশাপাশি ভার্টিক্যাল বা উল্লম্ব পৃথক্করণের কথা আলোচিত হচ্ছে। যেটি হচ্ছে, রাষ্ট্রের শীর্ষবিন্দু থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাষ্ট্রক্ষমতার এমন বিন্যাস করতে হবে, যেখানে স্বায়ত্তশাসন ও বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সাধারণ নাগরিক কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়, উভয় সরকারের সুপরিচালনায় সমৃদ্ধ হতে পারে।
আমরা গত ৪২ বছরে, স্বাধীনতা অর্জনের দিন থেকে আজ পর্যন্ত, স্থানীয় সরকারকে অবহেলা করে এসেছি। নির্বাচিত লোকের দ্বারা স্থানীয় সরকার পরিচালিত হওয়ার পরিবর্তে কেন্দ্রীয় সরকারের নায়েব-গোমস্তা-মুৎসুদ্দিদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তাব্যক্তিদের ধারণা, স্থানীয় সরকার একটি বিজাতীয় প্রতিষ্ঠান এবং সেই প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় হতে দিলে অদক্ষ হস্তে দেশের অর্থের অপচয় ঘটবে। এমন কথা অতীতে ঔপনিবেশিক প্রভুরা ও বর্তমান দাতা গোষ্ঠীরা প্রায়শই আকার-ইঙ্গিতে বলে থাকে। আমি একাধিকবার বলেছি, বাংলাদেশ যদি বহু উপনিবেশ-সংবলিত একটি সাম্রাজ্যের অধিকারী হতো, তাহলে সেই ক্ষমতাধরের কোনো অধীনস্থ উপনিবেশ স্বাধীনতার মুখদর্শন করতে পারত না।
প্রত্যেক সার্বভৌম রাষ্ট্রের কিছু বিশেষ অধিকার থাকে। আমি আপাতত একটি অধিকারের কথা উল্লেখ করতে চাই। যেহেতু অপরাধের মামলায় রাষ্ট্র প্রধান পক্ষ, রাষ্ট্র ইচ্ছা করলে যেকোনো মামলা প্রত্যাহার করতে পারে। এই প্রত্যাহার করার ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত, বিশেষ প্রেক্ষিত বা কারণের জন্য ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে। যখন এই ক্ষমতা ঢালাওভাবে ব্যবহার করা হয়, তখন রাষ্ট্রের সার্বভৌম বিচারক্ষমতা ব্যাহত হয়।
অত্যধিক সুখের কথা এই যে পৃথিবীর বুদ্ধিধর অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ এই শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পশ্চিমের বহু দেশকে ছাড়িয়ে যাবে। আমি ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাস করি না। হেনরি কিসিঞ্জার যখন 'বটমলেস বাস্কেট' বা 'তলাবিহীন ঝুড়ি' বলেছিলেন, তখনো আমি বিমর্ষ হইনি। সাম্প্রতিক আশাব্যঞ্জক কথায়ও আমি উল্লসিত হইনি। আমি জানি, এখন আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে অবাসযোগ্য শহরে বাস করছি। এই শহরকে যাঁরা তিলোত্তমা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁরা সুশাসনের কথা স্মরণে রাখেননি। তিলোত্তমা দূরের কথা, সামান্য সহনযোগ্য বাসভূমি গড়ে তুলতে সুশাসন এক অপরিহার্য উপাদান। এ ব্যাপারে প্রথমেই আমাদের প্রয়োজন সুদক্ষ প্রশাসন কর্মকর্তা। অনেকের মতে, আমাদের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ কর্মদক্ষ। ইদানীং খবরের কাগজের মারফত আমরা জানতে পারছি, প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে বাইরে থেকে বা আউটসোর্সিং করে কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় মৌখিক নম্বর নাকি ২০০ করা হয়েছে নিজেদের লোককে সাহায্য করার জন্য! আউটসোর্সিং করে প্রশাসনে কর্মকর্তা নিয়োগ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অধিকার ও দায়িত্বের সঙ্গে কি সামঞ্জস্যপূর্ণ?
আমি এখানে মাত্র দু-একটি প্রশ্ন উত্থাপন করলাম। আমার বলার উদ্দেশ্য, সুশাসনের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য যেসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, কম্পট্রোলার জেনারেল, অ্যাটর্নি জেনারেল, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, নির্বাচন কমিশন- সর্বোপরি বিচার বিভাগকে দক্ষতার সঙ্গে স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে না দিলে সুশাসনের কথা বড়ই ফাঁপা শোনাবে।
আজ সুজনের জাতীয় সম্মেলন ও দশম বর্ষপূর্তি উৎসবে এ কয়েকটি কথা প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে।
আমি মনে করি, নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলের সংস্কারের পাশাপাশি এসব কার্যক্রম সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক উত্তরণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আমি সুজনের সাফল্য কামনা করে আজকের এই সম্মেলনের শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করছি।

(গতকাল শনিবার সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজনের দশম বর্ষপূর্তি ও জাতীয় সম্মেলনে প্রদত্ত উদ্বোধনী বক্তৃতার অংশবিশেষ।)

No comments

Powered by Blogger.