জ্বালানি তেলের বাড়তি মূল্য প্রত্যাহারের দাবি

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো যৌক্তিক হয়নি মন্তব্য করে এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। অর্থনীতি বিশ্লেষকরা বলেছেন, তেলের মূল্যবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি ও কৃষকদের দুর্ভোগ আরো বাড়াবে।
সরকারের ভুল নীতির কারণে জ্বালানি-বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদন ব্যয় ও ভর্তুকি বেড়েছে, যার দায় জনগণের ওপর চাপানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। গতকাল শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত সমাবেশ থেকে সংগঠনটি জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি প্রত্যাহারসহ সাত দফা দাবিতে আগামী ১১ জানুয়ারি দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করে।
সমাবেশে জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, 'সরকার বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ আধিপত্যবাদী শক্তির কাছে মাথা নত করে আমাদের জ্বালানি খাত ধ্বংস করছে। ডিজেলের দাম বাড়ার ফলে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এমনিতেই কৃষক ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না, এর ওপর উৎপাদন ব্যয় বাড়লে এর ভার সাধারণ কৃষক সইতে পারবে না। যাতায়াত ব্যয় ও দ্রব্যমূল্য বেড়ে অর্থনীতিতে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, সরকার জ্বালানি তেলের যে ভর্তুকির কথা বলছে, তার দায় জনগণ নেবে না। কারণ এই ভর্তুকির বড় অংশ যাচ্ছে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের নামে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। জনগণের মতামত উপেক্ষা করে মাত্র এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পেতে প্রতিবছর এই খাতে ২৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে।
আনু মুহাম্মদ আরো বলেন, আইএমএফের কাছ থেকে তিন বছরে ১০০ কোটি ডলার ঋণ পেতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোসহ যেসব গণবিরোধী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, তা অপ্রয়োজনীয়। মাত্র ২৫ দিনে বিদেশে অবস্থানরত শ্রমজীবী মানুষ ১০০ কোটি ডলার দেশে পাঠায়।
জ্বালানি তেলের বাড়তি মূল্য প্রত্যাহারের দাবি করেছে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি)। সংগঠনটি বলেছে, তেলের দাম বাড়ানোর ফলে পণ্যের উৎপাদন খরচ আরো বাড়বে। এতে রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
গতকাল শনিবার এক বিবৃতিতে ইএবির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, দফায় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। এর ফলে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা অজিত হচ্ছে না। ৩ জানুয়ারি থেকে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে রপ্তানিমুখী শিল্পখাত আরো সমস্যার আবর্তে পড়ে গেল।
সার্বিকভাবে জ্বালানি খাতের সংকটের এ সময়ে তেলের বাড়তি দাম জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়াটা সরকারের ঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, 'বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে কত অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বছরের পর বছর ধরে পড়ে থাকে, সেগুলো কাটছাঁট করে জ্বালানি তেলের বাড়তি খরচ সমন্বয় করতে পারত সরকার। বিশেষ করে কেরোসিন ও ডিজেলের দাম বাড়ানো কোনোমতেই উচিত হয়নি। এর ফলে বোরো মৌসুমে সেচের খরচ বাড়বে, আরো সমস্যায় পড়বে কৃষক।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে খাদ্য-বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। এ মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে যদি কৃষি খাতের ভর্তুকির সমন্বয় না করা হয়, তবে কৃষি উৎপাদনের ব্যয় বেড়ে যেতে পারে।
কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশের (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর আহমদ বলেছেন, বর্তমান সরকার চার বছরে জনগণকে দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেই চলেছে। সর্বশেষ ৩ জানুয়ারি গভীর রাতে পঞ্চমবারের মতো জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সরকার আবারও জনগণের সঙ্গে ওয়াদা ভঙ্গ করেছে।
সিপিবি ও বাসদের দেশব্যাপী গণজাগরণ অভিযানের তৃতীয় দিনে গতকাল সাতক্ষীরা ও খুলনার সমাবেশে সৈয়দ আবু জাফর এসব কথা বলেন। এ সময় বাসদের সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান বলেন, মুক্তবাজারের নামে লুটপাটের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু থাকায় চাল-ডাল-তেল-সবজিসহ দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। রেন্টাল-কুইক রেন্টালের নামে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে সরকার জনগণের পকেট কাটছে।
অবিলম্বে জ্বালানি তেলের বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে খালেকুজ্জামান বলেন প্রয়োজনে এই গণবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে।
বক্তারা আগামী ৯ জানুয়ারি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পাঁয়তারার প্রতিবাদে ঢাকায় বিইআরসি কার্যালয়ের সামনে এবং জেলায় ডিসি অফিসের সামনে কালো পতাকা প্রদর্শনের কর্মসূচি সফল করার আহ্বান জানান।
তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়েছে আরো কয়েকটি পেশাজীবী সংগঠন। তাদের দাবি, সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের জীবনের ব্যয়ভার বাড়িয়ে দিয়েছে। এসব সংগঠনের মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতি, ঢাকা জেলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ট্যাংক-লরি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ জ্বালানি তেল পরিবেশক সমিতি, জাতীয় নাগরিক সমাজ ও ঢাকা জেলা অটোরিকশা-অটোটেম্পো-মিশুক যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়ন।

No comments

Powered by Blogger.