যুদ্ধাপরাধী বিচারের বিরোধিতাকারীদের প্রতিহত করতে হবে- জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে ছায়া প্রতিবেদন ॥ বিচারবহির্ভূত হত্যা ও সীমান্তে হত্যার- কঠোর সমালোচনা by নাজনীন আখতার

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বেসরকারী সংগঠনগুলোর জমা দেয়া ছায়া প্রতিবেদনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার বিরোধিতাকারীদের প্রতিহত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
ছায়া প্রতিবেদনে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশংসনীয় ও ইতিবাচক উল্লেখ করে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা যায়। তাই দ্রুত ও স্বচ্ছ বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিচারকে বাধাগ্রস্ত করতে দেশে ও বিদেশে যেসব মহল সক্রিয় রয়েছে তাদের প্রতিরোধ করা প্রয়োজন।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘে যে প্রতিবেদন দেয়া হবে তাতেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত দাবি ও প্রত্যাশার বিষয়টি তুলে ধরার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।
ছায়া প্রতিবেদনে নারীর অধিকারের প্রশ্নে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে বলে প্রশংসা করা হলেও রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, সীমান্তে হত্যার কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ইউপিআর পদ্ধতির মাধ্যমে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল প্রতি সাড়ে চার বছর অন্তর জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে। ২০০৯-২০১২ এই সময়কালীন বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জাতিসংঘের সর্বজনীন পুনর্বীক্ষণ পদ্ধতির (ইউপিআর) আওতায় প্রতিবেদন তৈরির কাজ করছে সরকার। সে লক্ষ্যে গত বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মানবাধিকার ইস্যুতে বেসরকারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে এক পরামর্শ সভার আয়োজন করে। ৪০টি বেসরকারী সংগঠন ও ২৮টি সরকারী সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে সভা অনুষ্ঠিত হয়। চলতি মাসের মধ্যে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে দ্বিতীয় পর্যায়ের ইউনিভার্সেল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) প্রতিবেদন আকারে জমা দিতে হবে। সভা থেকে যেসব উদ্বেগ, সুপারিশ ও মতামত উঠে আসবে তার ভিত্তিতে সরকার প্রতিবেদনটি তৈরি করবে। প্রথম পর্যায়ের ইউপিআর প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ ২০০৯ সালে জমা দেয়। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রতিবেদন তৈরির অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে গত ১৮ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর সোনারগাঁও হোটেলে একটি কর্মশালাও অনুষ্ঠিত হয়।
পরামর্শ সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে একটি জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক প্রতিবেদন পেশ করবে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে গত চার বছরে ১৯৬টি আইন হয়েছে, যার ৭০টিই নারী অধিকার ও মানবাধিকার সুরক্ষায় প্রণীত। মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে অঙ্গীকার রয়েছে।
এদিকে বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হিউম্যান রাইটস ফোরাম-বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে একটি ছায়া প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ফোরামের সদস্যরা হলো- আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-ফোরাম সচিবালয়, এ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন, বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বয়েজ অব বাংলাদেশ, ফেয়ার, কর্মজীবী নারী, কাপেং ফাউন্ডেশন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, ন্যাশনাল এলায়েন্স অব ডিজ্যাবল পিপলস্ অর্গানাইজেশন, নাগরিক উদ্যোগ, নারীপক্ষ, নিজেরা করি, স্টেপস্ টুওয়ার্ডস্ ডেভেলপমেন্ট এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ছায়া প্রতিবেদনটি তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিভিন্ন মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠন, নাগরিক সমাজ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মতবিনিময় করা হয়েছে।
ছায়া প্রতিবেদনে বলা হয়, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকার অনেকটা পিছিয়ে আছে। বিশেষত গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। ২০০৯ সালের ইউপিআর অধিবেশনে অঙ্গীকার করা হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- ও নির্যাতনকে সরকার বরদাশত করবে না। তবে জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো থেকে আইন ও সালিশ কেন্দ্র কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৫৬ জন গুম হয়েছে, যার মধ্যে ২৮ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, যদিও সরকারী হিসাবে এই সংখ্যা অনেক কম। এই সময়ে ক্রসফায়ারের নামে ৪৬২ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে। র‌্যাবের গুলিতে পা হারিয়েছে ঝালকাঠির তরুণ লিমন হোসেন। পুলিশের উপস্থিতিতে গণপিটুনি কিংবা পুলিশের ইন্ধনে গণপিটুনির ঘটনা ঘটার অভিযোগ রয়েছে। প্রতিবেশী ভারতের বার বার আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির পরও সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা বন্ধ হয়নি এবং এ ব্যাপারে সরকারের প্রচেষ্টাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
প্রতিবেদনে সংখ্যালঘু প্রসঙ্গে বলা হয়, সাম্প্রতিক সরকার দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রশাসনের উচ্চপদে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। এটি অত্যন্ত ইতিবাচক। তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে প্রথম ইউপিআর অধিবেশনে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কল্যাণের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা হবে বলে অঙ্গীকার করা হয়। অথচ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হলেও ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করে সকল সংখ্যালঘু তথা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে। এছাড়া ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান, উপাসনালয়ে আক্রমণ ও ভাংচুরের ঘটনা উদ্বেগজনক। এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক রামুর ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
প্রতিবেদনে মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন সুপারিশ তুলে ধরে বলা হয়, রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন অভিযোগের স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক তদন্ত, রাষ্ট্রপক্ষের মামলা পরিচালনা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করার জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করতে সরকারঘোষিত ‘জিরো-টলারেন্স’ নীতি নিশ্চিত করাও দরকার। পাশাপাশি রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা বা অবহেলার জন্য ফৌজদারি এবং বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল করাসহ অন্যান্য আইনের সংস্কার করা। সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা বন্ধ করতে জোরালো কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা। বিনা বিচারে আটক ও কারাবন্দীদের ওপর নির্যাতন ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করা। কারাব্যবস্থার সংস্কারসহ নিয়মতান্ত্রিক পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া উন্নয়ন করা। জরুরিভিত্তিতে সড়ক নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা, গাড়ির লাইসেন্স সংক্রান্ত বেআইনী বিষয়গুলো বিচারের আওতায় এবং গণপরিবহনের ফিটনেস নিয়ন্ত্রণে আনা।
এ প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অধিকারগুলোর (যেমন খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষার অধিকার এবং নারীর অধিকার প্রভৃতি) ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা ও ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোর ওপর যেমন আলোকপাত করা হয়েছে। নারীর অধিকার রক্ষায় জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ গ্রহণ এবং বিভিন্ন সেক্টরে জেন্ডার ভারসাম্য বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি, হাইকোর্টের নারীর অধিকার রক্ষায় বেশ কিছু ইতিবাচক দিকনির্দেশনা হিসেবে ‘ফতোয়া’র নামে বিচারবহির্ভূত শাস্তিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা (২০১০), শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে জোরপূর্বক পর্দা নিষিদ্ধ ঘোষণা (২০১০), পাবলিক সেক্টরে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে দিকনির্দেশনামূলক নীতিমালা প্রদান (২০১০) এবং বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের জন্য জন্মনিবন্ধনের সার্টিফিকেট যাচাই করে দেখা ইত্যাদি পদক্ষেপকে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। তবে এখনও পারিবারিক নির্যাতন, বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, ধর্ষণ, এ্যাসিড নিক্ষেপ, ফতোয়া, যৌন হয়রানি প্রভৃতি নানাভাবে নারীর অধিকার খর্ব করছে এবং এ সংক্রান্ত আইন ও নীতিমালাগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় প্রতিবেদনে।
২০০৯ সালে বিচারবিভাগকে শাসনবিভাগ থেকে আলাদা করা হলেও এই পৃথকীকরণ পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হওয়া, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পুনর্গঠিত হলেও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নীতিমালা এখনও প্রণীত না হওয়াসহ কমিশনে বর্তমানে জনবলের এবং একটি লিগ্যাল প্যানেলের অভাব, দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তাদের জন্য কোন আচরণ বিধিমালা নেই, কমিশনের আর্থিক অধীনতা, কাজের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব কমিশনের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলেও ছায়া প্রতিবেদনে বলা হয়।

No comments

Powered by Blogger.