চার বছর পূর্তি সাফল্যের পাল্লাভারি- ০ কিছু ব্যর্থতা ম্লান করেছে অনেক সাফল্য- ০ গুণগত পরিবর্তন আসেনি রাজনীতিতে

কি পেলাম আর কি পেলাম না। জনসমর্থনের ব্যারোমিটার কার দিকে? আগামী নির্বাচন হবে তো? আর নির্বাচন হলে কার ভাগ্যে জুটবে জনগণের ভোট, কেইবা যাবে কাক্সিক্ষত ক্ষমতার চেয়ারে... ইত্যাদি নানা প্রশ্নকে সামনে রেখে সাফল্য ও ব্যর্থতার চার বছর অতিক্রান্ত করল বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার।
মহাচ্যালেঞ্জ নিয়ে পাঁচ বছর মেয়াদের শেষ বর্ষে পা রাখল এই সরকার। ২০০৯-এর ৬ জানুয়ারি যে সরকার দিনবদলের অঙ্গীকারের পানসিতে চড়ে সোনালী ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল সে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব-নিকাশের খেরোখাতা খুলে বসেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সুশীল সমাজসহ দেশের মানুষ। আর সেই খেরোখাতায় উঠে এসেছে মহাজোট সরকারের চার বছরে মানুষের আশাভঙ্গ ঘটেনি, তবে আত্মতুষ্টিরও সুযোগ নেই। সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ করলে গত চার বছরের এই সরকারের পাল্লা সফলতায় ভারি, তবে ব্যর্থতার পাল্লা কম হলেও গুরুত্বহীন নয়। অনেক সাফল্যই ব্যর্থতার কালো ছায়ায় আড়ালে পড়েছে। কিছু ব্যর্থতা বিশাল সাফল্যকে কালো মেঘে আড়াল করে দিয়েছে। সর্বশেষ মেয়াদের এই শেষ বছরে বিগত সময়ের ব্যর্থতাগুলো কতটুকু সামলিয়ে জনগণের প্রত্যাশা ও সমর্থন মহাজোট সরকার ধরে রাখতে পারবে সেটাই এখন দেখার অপেক্ষায়।
সরকারের, আওয়ামী লীগের নানা ব্যর্থতা সত্ত্বেও এখনও দেশের বেশিরভাগ মানুষের আস্থা রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপরেই। অতীতে দেখা গেছে, সরকারের শেষ বছরে জনসমর্থন হারিয়ে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন ক্ষমতাসীন সরকার প্রধান। কিন্তু এবারই প্রথম, আকাশসম জনপ্রিয়তায় গত ৪ বছরে কিছুটা ধাক্কা লাগলেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখনও শেখ হাসিনার প্রতি আস্থাশীল। মাঠ পর্যায়ের নানা জরিপ ও অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেৃতত্বের প্রতি দেশের শতকরা ১১ ভাগ বেশি মানুষ আস্থাশীল। আগামীতে আবারও ক্ষমতার নেতৃত্বে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁরা শেখ হাসিনাকেই দেখতে চান।
২০০৯ সালের চেয়ে বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের সমর্থন অনেক কমলেও বিএনপির চেয়ে এখনও বেশ এগিয়ে রয়েছে শাসক দল। এখনও ৪৮ ভাগ মানুষ সমর্থন করে আওয়ামী লীগসহ মহাজোটকে, আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের প্রতি দেশের ৩৭ ভাগ মানুষ সমর্থন করে। দলীয়ভাবে তেমন সমর্থন আদায় করতে না পারলেও পুঁজিবাজার ধসসহ গত বছরে বেশ কয়েকটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় বিএনপির জনসমর্থন কিছুটা হলেও বেড়েছে। প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাশাপাশি এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির জনসমর্থন বৃদ্ধির কথাও উঠে এসেছে নানামুখী জরিপে।
চার বছর পেরিয়ে সরকারের মেয়াদের শেষ বর্ষে পদার্পণ করলেও তীর থেকে প্রত্যাশার তরী এখনও অনেকটাই দূরে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধান কমেনি। রাজনীতির সামগ্রিক গুণগত পরিবর্তন শূন্যের কোঠায়। বর্তমান মহাজোট সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি জনগণের আস্থা এখনও অটুট থাকলেও তাতে কিছুটা হলেও ভাটার টানা পড়েছে গত ৪ বছরের বেশকিছু অনাকাক্সিক্ষত ইস্যুতে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুতে দেশের শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ সরকারের প্রতি আস্থা ও সমর্থন ব্যক্ত করলেও গত বছরে পদ্মা সেতু, হলমার্কসহ কয়েকটি দুর্নীতির অভিযোগ এবং অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা সরকারের বিশাল সাফল্যেকে ম্লান করে দিয়েছে। জনসমর্থনেও ধাক্কা লেগেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ করলে চার বছরের এই সরকারের পাল্লা সফলতায় ভারি, তবে ব্যর্থতার পাল্লা কম হলেও গুরুত্বহীন নয়। মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান রয়েছে। তবে তা দুস্তর নয়। সামগ্রিকভাবে সরকারের ওপর দেশের মানুষের আস্থা এখনও অটুট রয়েছে। সর্বোপরি চার বছরের বছরের মাথায় মানুষ হিসাব মেলাতে চাইবে, সরকার তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি কতটা পূরণ করতে পেরেছে বা করেনি। তাদের আশাবাদ, বাকি এই এক বছরে পরিস্থিতির আরও উন্নতি ঘটবে, সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করতে পারবে।
তবে মেয়াদের চার বছর অতিক্রান্ত হলেও সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্বের বরফ এতটুকুও গলেনি। বরং সময়ের ব্যবধানে ক্রমাগত বাড়ছে। তবে মেয়াদের শেষ বছরে দেশের মানুষের কাছে একটি প্রশ্নই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে আগামী নির্বাচন কিভাবে হবে? অন্তর্বর্তীকালীন দলীয় নাকি নির্দলীয় সরকারের অধীনে? সকল দল ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে নাকি একপক্ষের নির্বাচন হবে? দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের মন থেকে ওয়ান ইলেভেনের শঙ্কা দূর হয়নি।
এই বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর শঙ্কা, নির্বাচন পদ্ধতি ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে শেষ পর্যন্ত সমঝোতা না হলে আবারও জাতির ঘাড়ে বসতে পারে ওয়ান ইলেভেনের মতো আরেকটি নির্বাচিত সরকার। সরকার ও বিরোধী দল উভয় পক্ষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে কিছু ছাড় না দিলে গণতন্ত্র আবারও হুমকির মুখে পড়তে পারে। এ আশঙ্কা থেকে দেশের ৬০ ভাগ মানুষই চায়, গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রাখতে এ ইস্যুতে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ইতিবাচক সংলাপের মাধ্যমে কার্যকর সমাধান হোক। বিএনপির সঙ্গে এ ইস্যুতে সমঝোতা চাইলেও দেশের ৭৪ ভাগ মানুষ স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে কোন ধরনের সমঝোতার বিপক্ষে। সবারই একটি দাবি, সরকারের শেষ বছরেই সম্পন্ন হোক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, কার্যকর করা হোক আদালতের রায়।
মহাজোট সরকারের হাতে সময় আছে আর মাত্র এক বছর। ইতোমধ্যে নির্বাচনী ডামাডোল বেজে উঠেছে। বাকি এই এক বছরের মধ্যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হলে সরকারকে সর্বাগ্রে জনগণের সমর্থন ধরে রাখতে হবে। যার প্রস্তুতি শুরু করার সময় এখনই। তবে চারবছর পূর্তিকালে রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সমাজচিন্তক বা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অনেকটা এক বাক্যেই স্বীকার করেছেন, ১৯৯৬ বা ২০০১-এর শেখ হাসিনা এবং ২০০৯-১২-এর শেখ হাসিনার মধ্যে পার্থক্য আকাশ-পাতাল। এখনকার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা অনেক বেশি সাহসী, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং নেতা হিসেবে ঝুঁকি নিতে অভ্যস্ত হয়েছেন। শত ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবেলা করে জনগণের কাছে দেয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালনে শেখ হাসিনা অনেক বেশি দৃঢ়চেতা।
তাঁদের মতে, এ দেশে সাধ ও সাধ্য, চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা সহজ নয়। দিন বদলের কঠিন অঙ্গীকার দিয়ে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে গত চার বছরে এই সত্য মর্মে মর্মে অনুধাবন করতে পেরেছে যে, পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, কণ্টকাকীর্ণ। অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যে সরকারের যাত্রা শুরু, চার বছর পূর্তিতে সে সরকারকেও যথানিয়মে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় যথানিয়মে। চার বছর পূর্তিতে দেশের মানুষ এখন সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব শুরু করেছে। কয়েকটি স্পর্শকাতর ইস্যু এবং কিছু বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে সরকার তার মেয়াদের শেষ বর্ষে পা রাখল। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার লাগাম শক্ত হাতে টেনে ধরা, শত ষড়যন্ত্রের নাগপাশ ছিন্ন করে জনগণের আকাক্সিক্ষত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা, বিশ্বমন্দা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিকে আরও স্বাবলম্বী করা, বিপর্যস্ত পুঁজিবাজারকে রক্ষা, রাজনৈতিকভাবে বিরোধী দলকে মোকাবেলা এবং আগামী নির্বাচন কিভাবে হবে দলীয় সরকারের অধীনে নাকি পূর্বের ন্যায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এসব চ্যালেঞ্জ এই এক বছরেই নিষ্পন্ন করে জনগণের বিপুল জনসমর্থন বজায় রাখতে হবে বর্তমান সরকারকে। অন্যথায় জনপ্রিয়তায় যে ভাটার টান পড়বে তা আগামী নির্বাচনে সামাল দেয়া ক্ষমতাসীন দলটির জন্য খুব কঠিনই হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চার বছরের সরকার জোর গলায় বেশকিছু সাফল্যের কথা বলতেই পারে। যেমন- কৃষি, শিক্ষা, কূটনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতি। মাত্র চার বছরেই কৃষি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়েছে মহাজোট সরকার। স্বাধীনতার ৩৯ বছরের মাথায় সর্বজনীন শিক্ষানীতি প্রণয়ন, প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মাঝে বছরের শুরুতেই প্রায় ২৭ কোটি বিনামূল্যে বই বিতরণ, প্রাথমিক ও জুনিয়র সমাপনি পরীক্ষার প্রবর্তন, দীর্ঘদিন পর শিল্পনীতি প্রণয়ন, সন্ত্রাস-ধর্মীয় জঙ্গীবাদ দমন, আন্তর্জাতিক পরিম-লে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল এবং আন্তর্জাতিক আদালতে আইনী লড়াই চালিয়ে বাংলাদেশের সমপরিমাণ গভীর সমুদ্রে বিশাল অঞ্চল আদায়ের রীতিমতো বিপ্লবের ঘটনা সরকারের বড় দাগের সাফল্য হিসেবেই দেখছেন তাঁরা।
সারাবিশ্বকে তাক লাগিয়ে মাত্র চার বছরেই উন্নয়ন দৌড়ে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ দেশের অন্যতম এখন বাংলাদেশ। শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সুশাসনের ক্ষেত্রে অসাধারণ সাফল্যের জন্য আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় বাংলাদেশ স্থান করে নিয়েছে সুখী দেশের তালিকায়। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস এবং গড় আয়ুস্কাল বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে। বিশ্বমন্দা মোকাবেলা করে প্রবৃদ্ধির হার প্রায় সাড়ে ৬ শতাংশে উন্নীতকরণ, বিদ্যুত ও জ্বালানির সঙ্কটের সমাধান, রফতানি ও রেমিটেন্স বৃদ্ধি, খাদ্যে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবায় বিশাল সাফল্যে এবং নারীর ক্ষমতায়নের অগ্রগতির ফলে প্রকৃতই বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তথ্যপ্রযুক্তির অভূতপূর্ব ব্যবহারের ফলে ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। তাঁদের মতে, বর্তমান সরকারের এই চার বছরে সমাজ অর্থনীতি রাজনীতিসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।
এছাড়া মাত্র ১০ টাকায় কৃষকের ব্যাংক হিসাব খোলা, কৃষি কার্ডের মাধ্যমে কৃষকদের কৃষি ভর্তুকি প্রদান, বিনাসুদে সরকারী-বেসরকারী ব্যাংকের কৃষিঋণ প্রদান, তিন দফা সারের দাম কমানো, মাত্র চার বছরে প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুত উৎপাদন, সেচ পাম্পে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত প্রদান, সার-বীজ-ডিজেলসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণে বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফের বাধা উপেক্ষা করে শুধু নন ইউরিয়া সারের জন্য ৩ হাজার কোটিরও বেশি টাকার ভর্তুকি, কৃষি যন্ত্রপাতিতে ২৫ শতাংশ ভর্তুকিসহ কৃষক কল্যাণে সরকারের নানা পদক্ষেপ কৃষি উৎপাদনে বিপ্লবের সূচনা নিঃশর্ত প্রশংসা অর্জন করেছে। এসব সাফল্যে জাতিকে আশান্বিত করেছে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্যতম অঙ্গীকার ছিল ক্ষমতায় গেলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার রায় কার্যকর এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করা। মহাজোট সরকার দু’বছরের সূচনা পর্বেই সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছে। কিছুটা দেরিতে হলেও ক্ষমতার মাঝামাঝি অবস্থায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপর্ব শুরু করেছে। আদালতে এখন যুদ্ধাপরাধীদের চূড়ান্ত বিচার প্রক্রিয়া প্রায় শেষের পথে। কয়েকটি মামলার রায় ঘোষণা করা হবে যেকোন দিন। দেশের মানুষের প্রত্যাশা, অন্তত মূল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ বর্তমান সরকারের আমলেই শেষ ও বিচারের রায় কার্যকর হবে।
সমাজচিন্তকদের মতে, শেখ হাসিনার সরকার চার বছরে দেশের মানুষকে খুব একটা হতাশ করেনি। জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমনে সফলতা এসেছে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও আরও উন্নতি হওয়ার দাবি রাখে। কৃষি উৎপাদনে অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছে। গত চার বছরে বর্তমান সরকারের বড় সফলতা ছিল বিদ্যুত উৎপাদনে বিগত জোট সরকারের আমলে যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকে শুধু উত্তরণই নয়, লোডশেডিং-এর দুঃষহ যন্ত্রণার কথা দেশের মানুষ প্রায় ভুলে যেতে বসেছে। মাত্র চার বছরেই প্রায় ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করে বিদ্যুতের বেহাল অবস্থা থেকে জনগণকে মুক্ত করেছে। বিগত চার বছরে ৭ হাজার ৬৪৯ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৫৭টি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে, এরই মধ্যে সরকারী ও বেসরকারী খাতে ৫ হাজার ৪৮ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ২৮টি বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
ডলারের দাম বৃদ্ধি, বিপুল পরিমাণ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণগ্রহণসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছুটা ধাক্কা এলেও সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক মহামন্দার কারণে আশপাশের দেশগুলো কাবু হয়ে গেলেও বাংলাদেশ তা থেকে অনেকটা রক্ষা পেয়েছে। প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের উপরে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বিশ্বমন্দার মধ্যেও গার্মেন্টস পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে। বিদেশ থেকে রেমিটেন্স আনায়নেও অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে, জনশক্তি রফতানিতেও প্রশংসা অর্জন করেছে সরকার। মাত্র চার বছরে ১৯ লাখ ৭৮ হাজার শ্রমিক বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
এছাড়া গত চার বছরে সফলভাবে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে বাংলাদেশ তার হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সফলতা দেখাতে পেরেছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে সরকার এখন আগের চাইতে আরও বেশি সচেতন হয়েছে। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পুরো পাঁচ বছরেই যেখানে ছিল দুর্নীতিই নিয়ামক, রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি। সেখানে বর্তমান মহাজোট সরকারের চার বছরে দালিলিক বা প্রামাণিক মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে বড়মাপের কোন দুর্নীতির অভিযোগ এখনও শোনা যায়নি।
মহাজোট সরকার মাত্র চার বছরেই আন্তর্জাতিক পরিম-লে সন্ত্রাসী-জঙ্গীবাদী বা দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের কালো তালিকা থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করেছে। এলডিসির অবিসংবাদী নেতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নিজেকে, বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক উত্থাপিত অটিজম রেজুলেশন, জনগণের ক্ষমতায়নে শান্তিকেন্দ্রিক উন্নয়ন মডেল এবং শান্তির সংস্কৃতি প্রস্তাব জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ১৯৩টি সদস্যরাষ্ট্র সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করেছে।
ব্যর্থতার তালিকাও কম নয়
বিশ্লেষকদের মতে, মহাজোট সরকারের চার বছর কার্যপরিচালনায় সফলতার পাল্লা ভারি হলেও ব্যর্থতার পাল্লাও খুব একটা কম নয়। ২০০৯ নালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ‘চমকের মন্ত্রিসভা’ শপথ নিয়েছিল আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা জাগিয়ে। তার অনেক কিছুই অপূর্ণ রয়ে গেছে চার বছর মেয়াদে। তাঁরা বর্তমান মহাজোট সরকারের চার বছরের রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতার ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে চিহ্নিত করেছেন- দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, বিভিন্ন সেক্টরে দুর্নীতির অভিযোগ, পদ্মা সেতু নির্মাণে জটিলতা, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, হলমার্ক-ডেসটিনি কেলেঙ্কারি, দলীয় কর্মীদের টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি-সন্ত্রাস, সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ইত্যাদি।
নদীর বুকে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু বানিয়ে দক্ষিণাঞ্চলবাসীকে সড়ক ও রেলপথে সরাসরি ঢাকায় আনার স্বপ্ন দেখিয়ে যাত্রা শুরু করলেও মহাজোট সরকারের চার বছর গড়ালেও সেই সেতুর কাজ শুরু করা যায়নি। দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর ঋণদাতা প্রধান সংস্থা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে জটিলতার মধ্যে বাকি এক বছরেও বহু প্রতীক্ষিত এই সেতুর কাজ শুরু হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনও কাটেনি। জটিলতা কাটাতে মন্ত্রিত্ব থেকে সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগ, প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকে দীর্ঘ ছুটিতে পাঠানো এবং সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করার পরও কাক্সিক্ষত এই সেতুটি বর্তমান সরকারের বাকি এক বছরে মেয়াদে শুরু হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই গেছে।
সরকারের চার বছর মেয়াদ শেষে এই দ্রব্যমূল্য নিয়েই দুশ্চিন্তায় সরকার। বাজার নিয়ন্ত্রণে চার বছর নেয়া হয়েছে অনেক উদ্যোগ। হয়েছে বাজার ও দাম নিয়ন্ত্রণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কখনও বেঁধে দেয়া হয়েছে নির্ধারিত পণ্যের দাম। আবার কখনও নেয়া হয়েছে বাজার পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত। মন্ত্রিত্বও রদবদল করা হয়েছে। কিন্তু চার বছর বাজার পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি বাজারের অসাধু সিন্ডিকেটকে। এই দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতিই সরকারের সাফল্যেগুলোকে ম্লান করে দিচ্ছে।
চার বছর পূর্তির প্রাক্কালে আরেক দফা তেলের দাম বৃদ্ধি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা মতো অবস্থা হয়েছে। শেষ সময়ে এই জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি সরকারকে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে দ্রব্যমূল্য আরও বাড়বে। দ্রুত এর লাগাম টেনে ধরতে না পারলে সরকারের বিশাল জনসমর্থন ধরে রাখাই কঠিন হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মহাজোট সরকারের আরেকটি বড় ব্যর্থতা হচ্ছে দেশব্যাপী ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নামধারী কিছু দুর্বৃত্তের বেপরোয়া দুর্বৃত্তপনা। চার বছর ধরেই এদের কারণে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। সরকারের অনেক সাফল্যেকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের মেয়াদের শেষ বছরেও আওয়ামী লীগ বা মহাজোটকে যদি কোন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে তা হবে এদের কারণেই। এছাড়া মন্ত্রিসভা, সংসদ সদস্য ও তাঁদের পরিবারের সম্পদের পরিমাণ ও আয়ের উৎস প্রতিবছর জনসমপক্ষে প্রকাশের অঙ্গীকার থাকলেও চার বছরে সে প্রতিশ্রুতি পালন হয়নি।
বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল ক্ষমতায় গেলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বন্ধ করা। কিন্তু তা হয়নি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বা ক্রসফায়ার কিছুটা কমলে সম্প্রতি দেশব্যাপী কিছু গুপ্তহত্যা, অপহরণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নিয়ে মানবাধিকার সংস্থা, সুশীল সমাজ ও মিডিয়ার কঠোর সমালোচনা সরকারকে হজম করতে হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও প্রতিদিন হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি বা ডাকাতির ঘটনার কমতি নেই। রাজধানীর অসহনীয় যানজটও নিরসনে ব্যর্থতার অভিযোগও সরকারের দিকে।
যানজট নিরসনে উড়ালসেতু, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা পাতাল রেল ইত্যাদি নির্মাণের নানা প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও একমাত্র সায়েদাবাদ-গুলিস্তান ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ শুরু হওয়া ছাড়া বাকি কাজগুলোর কোনকিছুই হয়নি। এমনকি জনগণের প্রাণের দাবি পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণের পরও কথিত দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তা স্থগিতের ঘটনাতেও সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। মহাজোট সরকারের চার বছর পার হলেও গতি আসেনি জনপ্রশাসনে। রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত ও দক্ষ করে তোলার যে প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছিল, তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, শুধু একজন প্রধানমন্ত্রীই দেশ পরিচালনা করেননা। সমষ্টির প্রয়াসে সৃষ্ট ঐক্যতানই সরকারের সাফল্যের চাবিকাঠি। সরকার পরিচালনায় দিনবদলের বিশাল অঙ্গীকার প্রতিপালনে যে গতিশীল প্রশাসন প্রয়োজন, গত চার বছরে সে প্রশাসন প্রত্যক্ষ করা যায়নি। মাঠ থেকে শুরু করে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত থমকে গেছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনের অদক্ষতা ও গতিহীনতা প্রসঙ্গে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
এছাড়া সরকারের চার বছর পূর্তিতে অনেক মন্ত্রীর যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। অনেকের মতে, মন্ত্রিসভায় নবীনের প্রাচুর্য, বেশকিছু প্রবীণও রয়েছেন। তাঁদের সততা নিয়ে এখনও তেমন গুরুতর প্রশ্ন না উঠলেও সরকার পরিচালনায় সততাই প্রথম ও শেষ কথা নয়। কিছু মন্ত্রীর অতিকথন, কাজের চেয়ে ‘অন্য কাজে’ মনযোগী হওয়া এবং দক্ষভাবে নিজ মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন পরিচালনা না করার অভিযোগ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ল্যাপটপে এসব মন্ত্রীর বিস্তারিত আমলনামা রয়েছে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এবং বিপুল পরিমাণ অর্থসহ এপিএস গ্রেফতার এবং রেল দুর্নীতির অভিযোগে রেল মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে। এ দুটি ঘটনা সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের ক্ষেত্রে ওই দুই মন্ত্রীকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে বিরোধী দল।
সবমিলিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, বিদ্যুত ও জ্বালানি সমস্যার অগ্রগতি, নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়ন, যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন ও রায় কার্যকর, রাজধানীর যানজট নিরসন, সংসদ কার্যকর, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং দুর্নীতি দমনে সদিচ্ছার প্রমাণ এবং সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে বিরোধী দলকে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা- বর্তমান মহাজোট সরকারের মেয়াদের শেষ একটি বছরে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। বাকি এই এক বছরে বর্তমান সরকারকে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই জনসমর্থন ধরে রাখতে হবে বলেই মনে করছেন তাঁরা।
রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন শূন্যের কোঠায় ॥ মহাজোট সরকারের চার বছরের হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি এই চার বছরে রাজনৈতিক দলগুলোর সফলতা-ব্যর্থতারও হিসাব-নিকাশ শুরু করেছে দেশের মানুষ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক দলগুলো এক-এগারো থেকে কোন শিক্ষাই নেয়নি। রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তন আশা করেছিল দেশের মানুষ, তার কিছুই হয়নি।
বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে দেশের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত মনে করছেন, দেশকে এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা সবচেয়ে জরুরী। এ জন্য সরকারী দলকে সহনশীল ও বিরোধী দলকে সহযোগিতামূলক আচরণ করতে হবে। সংসদকে কার্যকর করে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন আনতে হবে। সরকার ও বিরোধী দলের দুই শীর্ষ নেত্রীকে মুখ দেখাদেখি বন্ধের অবস্থান থেকে সরে এসে দেশের যে কোন বড় ইস্যুতে এক টেবিলে বসতে হবে। তবেই গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা নিরঙ্কুশ হবে। নইলে আবারও জনগণের ভাগ্যবিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।
বিশ্লেষকদের মতে, ক্ষমতাসীন সরকার তিন-চার বছরেও আওয়ামী লীগকে আলাদা সত্তায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং সরকারের মধ্যেই যেন ঢুকে পড়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। প্রান্ত থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত দলের নেতাকর্মীদের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণই যেন হারিয়ে ফেলেছে দলটি। দলের অধিকাংশ সিনিয়র নেতাকে সাইড লাইনে বসিয়ে রেখে অপেক্ষাকৃত নবীনদের হাতে সাংগঠনিক ভার তুলে দিয়ে চমক দেখানো হলেও তা খুব একটা কাজে আসেনি। গত চার বছরেও সাংগঠনিক স্থবিরতা কাটাতে পারেনি সরকারের কর্তাব্যক্তিরা।
আর সে কারণে চার বছর ধরেই দলের এক শ্রেণীর সুযোগসন্ধানী দুর্বৃত্তদের দুর্বৃত্তপণা সরকারকে মাঝে মধ্যেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। মানসিক পরিবর্তন দেখা যায়নি দলটির তৃণমূল নেতাদের মধ্যেই। অনেক সংসদ সদস্যর গত চার বছরের নানা প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকা- সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করেছে। মহাজোটকে নিষ্ক্রিয় রেখে আওয়ামী লীগের একলা চলো নীতির কারণে সরকারের অনেক উন্নয়নমূলক কর্মকা- জনগণের মাঝে প্রচার পায়নি বলেও মনে করেন তাঁরা।
অন্যদিকে দুর্নীতি-সন্ত্রাস ও দুঃশাসনের কারণে জনগণে থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়া বিএনপির কোনই পরিবর্তন হয়নি গত চার বছরে। যে বল্লাহীন দুর্নীতি, সন্ত্রাস, দুঃশাসন এবং যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গীবাদের মদদদানের কারণে নির্বাচনে জনগণ এ দলকে প্রত্যাখ্যান করেছে- সেই পুরনো নষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বিন্দুমাত্র বের হতে পারেনি বিএনপি। বরং পাঁচটি বছর যেসব ব্যক্তি ‘দুর্নীতির বরপুত্র’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে, খালেদা জিয়ার তত্ত্বাবধানে তারেক রহমানসহ সেসব দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী ও জঙ্গীবাদের মদদদানের অভিযোগ থাকা সাবেক মন্ত্রী-এমপি-নেতারাই আবারও চালকের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন বিএনপির রাজনীতিতে।
বার বার সরকার পতন আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে চার বছর ধরে বিএনপি রাজপথে থাকলেও আন্দোলন জমাতে পারেনি। জাতীয় ইস্যুতে আন্দোলনের কথা বললেও দলটির সব কর্মকা- ছিল মূলত খালেদা জিয়ার পরিবার রক্ষা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার। ‘হরতাল’ না করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন বিএনপি এই ‘হরতাল’কেই যে কোন ইস্যুতে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তাই গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের চার বছর পূর্তিতে এসব দিকও গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন দেশের সচেতন মানুষ।
চার বছরের শুরুতে ব্যর্থতার কথা বলতে হলে উল্লেখ করতে হয় রাজনীতির তেমন গুণগত পরিবর্তন হয়নি। ২০০৬ সালের শেষে রাজনীতি যেমনটি সাংঘর্ষিক ছিল, ২০১৩ সালেও তা বজায় থাকার সম্ভাবনা আছে যার আলামত ইতোমধ্যে স্পষ্ট। এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা আগে আওয়ামী লীগ চাইত আর বিএনপির অবস্থা ছিল ঠিক বিপরীত। বিএনপি বলছে, এই ব্যবস্থা পুনরায় চালু না হলে তারা আগামী নির্বাচনে যাবে না। আওয়ামী লীগ বলছে, অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে এবং সেই সরকার কেমন হবে তা নিয়ে সংসদে আলোচনা হতে পারে।
সামগ্রিক রাজনীতি অতীতে যে পথে ছিল, চার বছরেও তার কোন হেরফের হয়নি। অভ্যন্তরীণ কোন্দল-দ্বন্দ্ব আর জনস্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থের রাজনীতির কারণে বিরোধী দল কোন ইস্যুতে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে যেমন ব্যর্থ হয়েছে। তেমনি বাঘা বাঘা নেতাকে সাইড লাইনে বসিয়ে চমকের কমিটি গঠন করলেও চার বছরে সাংগঠনিক কোন চমকই দেখাতে পারেনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বরং পুরনো সংঘাত-সাংঘর্ষিক রাজনীতির ধারায় চলেছে দেশের রাজনীতি। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্ব এমন এক জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে, তা আদৌ কোনদিন দু’পক্ষের কাছাকাছি আসতে পারবে কি-না এ নিয়ে সন্দেহ থেকেই গেছে।
বিরোধী দল হিসেবেও সম্পূর্ণ ব্যর্থ বিএনপি। পুরো বছরে অনেক জ্বলন্ত ইস্যু হাতে পেলেও তা কাজে লাগাতে পারেনি তারা। বরং অতিরিক্ত জামায়াত নির্ভরতা চার বছর ধরে হরতালের পর হরতাল, অবরোধ, ঢাকা থেকে চার বিভাগে লংমার্চসহ অনেক আন্দোলনের কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নামলেও হালে পানি পায়নি বিএনপি। তার ওপর যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষালম্বন করে তারা নিজেরা পায়ে কুড়াল মেরেছে।
সরকারের ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশের পাশাপাশি প্রধান বিরোধী দল বিরোধী দল বিএনপির গত চার বছরের কর্মকা-ে দারুণ হতাশ দেশের অধিকাংশ জনগণ।
বিভিন্ন জরিপে দেশের প্রায় ৬৩ ভাগ মানুষ বিএনপির কর্মকা-ে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করতে দেখা গেছে। হরতালসহ ধ্বংসাত্মক রাজনীতি যে জনগণ আদৌ পছন্দ করে না তা এসব জরিপে উঠে এসেছে। বিএনপির ১৮ দলীয় জোটের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান অংশীদার স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের এ দলের সঙ্গে ঐক্য সমর্থন করে না ৭৫ শতাংশেরও বেশি মানুষ। বরং যুদ্ধাপরাধীদের কঠোর দ-ের পক্ষেই দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ।

No comments

Powered by Blogger.