শিশুটি আর নেই

২ ডিসেম্বর, বুধবার। সকালটা শুরম্নই হলো দুঃসংবাদ পেয়ে। অফিসের মিটিংয়ের জন্য তড়িঘড়ি করে তৈরি হচ্ছি। নাসত্মা খাওয়া শেষ। চা বানাচ্ছিলাম। তখনই এলো ফোন।
এ ফোনটা আরও সকালে দুইবার এসেছিল। রিসিভ করিনি। এবার করলাম। লামি নামের ছোট্ট অসুস্থ মেয়েটির বাবা লেবু খলিফা ফোন করেছেন। ভাবলাম মেয়েটির শরীর বোধহয় আরও খারাপ করেছে। কি খবর জিজ্ঞেস করা মাত্র জবাব এলো 'আপা, লামি মারা গেছে।' ধাক্কা খেলাম। প্রশ্ন করার আগেই ওর বাবাই বললেন, 'ঈদের পরদিন মারা গেছে।' একটি অল্প চেনা শিশুর জন্য আমার বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল। ফোনে লামির বাবা আমার প্রতি তাঁর অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে লাগলেন। আমি তাঁদের জন্য যা করেছি অপরিচিত কেউ কারও জন্য এতটা করে না.... ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি তাঁর কথায় তেমন কোন সাড়া দিলাম না। শুধু হুঁ, হ্যাঁ করে গেলা ম। আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। বুকের ভেতর চাপ নিয়ে অফিসের মিটিংয়ের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হলাম। এ পরিবারটির সঙ্গে আমার পরিচয় কয়েক মাস আগে। যখন ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ খেয়ে একে একে শিশুমৃতু্যর ঘটনা ঘটছিল। গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাসের ঘটনা। ঢাকা শিশু হাসপাতালে বিষাক্ত প্যারাসিটামলে মৃত ও চিকিৎসাধীন শিশুদের নিয়ে রিপোর্ট করতে এসে আমার স্বামী বৈশাখী টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার রকিবুল ইসলাম মুকুলের সঙ্গে পরিচয় হয় এ পরিবারটির। আমাদের পত্রিকায় অসুস্থ দরিদ্র মানুষকে সহায়তার জন্য 'মানুষ মানুষের জন্য' বিভাগ থাকায় মুকুল আমার ফোন নম্বর ওদের দিয়ে সাহায্যের আবেদন চেয়ে যোগাযোগ করতে বলে। আমার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে লামির বাবা ও তরম্নণী খালা চিকিৎসার কাগজপত্র নিয়ে জনকণ্ঠ অফিসে আসে। আমি ছবি চাইলে তারা জানায়, শিশুটির কোন ছবির কপি নেই। তবে মোবাইল ফোনে ছবি আছে। পরের দিন তারা আমাকে মোবাইল ফোনে তোলা লামির একটি ঝাপসা ছবি দিয়ে যায়। একটি শিশু ভীষণ অবাক ভঙ্গিমায় নিষ্পাপ মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছে ক্যামেরার দিকে। তবে জনকণ্ঠের মানুষ মানুষের জন্য বিভাগে এ শিশুটিকে নিয়ে লেখার পরও দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেভাবে সাহায্য আসেনি। পরিবারটি ফোনের পর ফোন করতে লাগল। 'আপা, লামির টেস্টের লাইগা ডাক্তার তাড়া দিতাছে। এক টেস্টেই চার হাজার টাকা লাগব। দোকানে ওষুধের অনেক টাকা বাকি পড়ছে।' ওদের চাপে একই সঙ্গে আমি অস্বসত্মি ও দিশেহারা বোধ করা শুরম্ন করলাম। একবার মনে হচ্ছিল সাহায্যের আবেদন চেয়ে লিখেছি, ওটাই আমার মূল দায়িত্ব। আবার মনে হচ্ছিল সাংবাদিক হিসেবে আরও কিছু দায়িত্ব আছে। আমরা সাংবাদিকরা অন্য পেশাজীবীদের তুলনায় অনেক অনেক বেশি মানবিক। এত সহজে আমরা হাল ছাড়ি না। মানুষ মানুষের জন্য বিভাগটি আগে দেখতেন জনকণ্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি ফজলুল বারী। তিনি এখন অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে থাকেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। যদি তাঁর সময়কার দাতাদের পাওয়া যায়। কিন্তু বারী ভাইয়ের সঙ্গে দাতাদের কয়েক বছর ধরে যোগাযোগ না থাকায় তিনি কারও ফোন নম্বর দিতে পারলেন না। তবে সুন্দর পরামর্শ দিলেন। তাঁর পরামর্শ মতো একদিন গেলাম শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. এ আর খানের কাছে। সব শুনে সংশিস্নষ্ট ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললেন। আমাকে বললেন, শিশুটি নিউরোমেটাবলিক ডিজঅর্ডার বা মসত্মিষ্ক ক্ষয়রোগে আক্রানত্ম। এ ধরনের শিশুরা পুরোপুরি ভাল না হলেও দীর্ঘ চিকিৎসায় অনেকখানি সুস্থ হয়ে ওঠে। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালের দরিদ্র তহবিল থেকে শিশুটির জন্য অর্থ সহায়তা দেন। তাঁর রম্নম থেকে বেরিয়ে শিশু হাসপাতালের তিনতলায় লামিকে দেখতে গেলাম। লামির তরম্নণী মা হাসিনা এক রকম অসহায় মুখ করে আমাকে বললেন, 'আপা প্রতিদিন ডাক্তার আইসা ইনজেকশন আনতে কয়। আমরা চুপ কইরা দাঁড়াইয়া থাকি।' বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন তিনি। বললেন, 'আপা ডাক্তার সেদিন রাগ কইরা কইছে চিকিৎসা না করতে পারলে হাসপাতাল থাইকা নাম কাটাইয়া যান গা। আপা ওর চিকিৎসার লাইগা ঘর বিক্রি করছি, মোবাইল, সাইকেল, ছাগলও বিক্রি করছি। অহন আর হাতে কিছু নাই।' সেদিন হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আমি প্রথম আলোর চীফ রিপোর্টার শরিফুজ্জামান পিন্টু ভাইকে ফোন দিলাম। তিনি তাঁর ইমেইলে লামির ছবিসহ লেখা পাঠাতে বললেন। একই কথা বললেন যুগানত্মরের সিনিয়র রিপোর্টার মনিরম্নজ্জামান উজ্জ্বল ভাই। নিয়ম না থাকলেও অল্প দিনের ব্যবধানে লামির জন্য সাহায্যের আবেদন চেয়ে আবারও লিখলাম জনকণ্ঠে। জনকণ্ঠের পাশাপাশি প্রথম আলো ও যুগানত্মরে লামির সাহায্যের আবেদন ছাপা হলো। সাহায্যও এলো। ব্যক্তিগতভাবেও কয়েকজনের কাছে সাহায্য চাইলাম। আমার আপু সাহায্য দিল। নিজেও দিলাম। সব মিলিয়ে যা অর্থ পাওয়া গেল তা শিশুটির দীর্ঘদিনের চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট না হলেও দরিদ্র পরিবারটি তাতেই খুশি হলো। তবে চিকিৎসা যে তেমন কিছু হয়নি তা স্পষ্ট হলো এত দ্রম্নত লামির মৃতু্যর মধ্য দিয়ে। গুরম্নতর ক্যান্সার রোগের যথাযথ চিকিৎসা করেও রোগীকে কয়েক বছর বাঁচিয়ে রাখা যায়। আর লামির রোগ তো এমন নয়। তার দ্রম্নত সুস্থ হয়ে ওঠার কথা না থাকলেও এত দ্রম্নত মারা যাওয়ার কথা নয়। হায়রে অভাগা দেশ! ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি এদেশের অসংখ্য লোক বিনাচিকিৎ সায় মারা যায়।
_নাজনীন আখতার

No comments

Powered by Blogger.