আন্তর্জাতিক সম্মেলন সমাপ্ত- পানির অধিকার আদায়ে ঐক্যের আহ্বান

ভারতের টিপাইমুখ বাঁধবিরোধী আন্দোলনের আর কে রঞ্জন সিংহ এবং বাংলাদেশের বড়াল বাঁচাও আন্দোলনের এস এম মিজানুর রহমান। দুজনের মধ্যেই সাংস্কৃতিকসহ নানা পার্থক্য রয়েছে।
কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি মিল রয়েছে তাঁদের মধ্যে। উভয়েই সাধারণ মানুষের পানির ন্যায্য অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে শামিল। আঞ্চলিক পানি বিশেষজ্ঞ, অধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করেন, এ ধরনের মানুষের ঐক্যই বৈরিতার বাধা সরিয়ে সহযোগিতার পথ সুগম করতে পারে।
গতকাল শনিবার ‘দক্ষিণ এশিয়ার পানিসম্পদ: বৈরিতা থেকে সহযোগিতা’ বিষয়ে দুই দিনের সম্মেলনের শেষ দিনে এই অভিমত দিলেন বিশেষজ্ঞ ও আন্দোলনকর্মীরা। প্রকৃতিকে অপরিকল্পিতভাবে বাধা দেওয়ার নানা প্রকল্প রুখতে এবং পানির ওপর এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁরা এক হওয়ার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক (বেন) যৌথভাবে এই সম্মেলনের আয়োজন করে।
সমাপনী দিনে আলোচকেরা বলেন, শেষ বিচারে পানিসম্পদের বিষয়টি রাজনৈতিক। কিন্তু মানুষের জন্যই যে পানি, এটি যে সাধারণ আরেকটি পণ্য নয়, নয় রাজনীতির হাতিয়ার—এই বোধ জাগ্রত করার জন্যই চাই গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার মানুষের ঐক্য।
সকালের চারটি সমান্তরাল অধিবেশনের পর ‘ভারতের আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের প্রেক্ষাপটে তিস্তা নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদের ভবিষ্যৎ’ বিষয়ে সাধারণ অধিবেশন হয়। বাপার সহসভাপতি বজলুর রহমানের সভাপতিত্বে এই অধিবেশনে মুখ্য আলোচক ছিলেন ভারতের পরিবেশবিষয়ক সংগঠন টক্সিকস ওয়াচ অ্যালায়েন্সের সমন্বয়ক গোপাল কৃষ্ণ। তিনি আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পকে এই উপমহাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে এক বিনাশী প্রকল্প আখ্যা দেন। তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্প ঔপনিবেশিক চিন্তার ধারাবাহিকতা। কেবল মনুষ্যত্বের দাবিতেই এর প্রতিবাদ করা উচিত।’
পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক জয়া মিত্র বলেন, জলবিদ্যুৎ তৈরি করতে গঙ্গার উৎসমুখ থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৭টি বাঁধ তৈরি করা হয়েছে।
ভারতের আসাম রাজ্যের কে কে ছত্রধর বললেন, ব্রহ্মপুত্র পাড়ের মানুষ হলেও এই নদীতে তাঁর অঞ্চলের মানুষের কোনো অধিকার নেই। চীনে জন্ম নেওয়া এই নদীতে বড় বাঁধ দিয়ে চীন উৎপাদন করছে বিদ্যুৎ। যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে ভারতেও।
যৌথ নদী কমিশনের সাবেক সদস্য তৌহিদুল আনোয়ার খান ভারতের আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রাযুক্তিক এবং প্রাকৃতিক দিক থেকে ক্ষতিকর একটি প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করেন।
গতকাল ‘ফারাক্কা ব্যারাজ এবং গঙ্গা অববাহিকার সমস্যা’ বিষয়ে আরেক সাধারণ অধিবেশনের প্রধান অতিথি সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ‘ফারাক্কা দুই বাংলার মধ্যে অবিশ্বাস স্থাপন করেছে।’
ভারতের সাংবাদিক চন্দ্র শেখর ভট্টাচার্য বলেন, এটি আজ বাস্তব যে ফারাক্কা শুধু বাংলাদেশই নয়; ভারতেরও কয়েক কোটি মানুষের জীবন-জীবিকায় বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। যুক্তরাষ্ট্রের লক হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. খালিকুজ্জামান বৈজ্ঞানিক উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখান, বাংলাদেশ গত পাঁচ বছরে ফারাক্কা চুক্তি অনুযায়ী প্রাপ্য পানির চেয়ে কম পেয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘ফারাক্কা ব্যারাজ একটি বিনাশী প্রকল্প শুধু নয়, এটা আমাদের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার একটি কৌশলও। এর মতো আরও অনেক প্রকল্প আছে, যেগুলো আলোচনায় আসে না।’
সভাপতি কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ এই উপমহাদেশের মানুষের মধ্যকার ঐতিহাসিক বন্ধন যাতে নষ্ট না হয়, তার জন্য সহযোগিতা ও সমঝোতার মাধ্যমে পানিসমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান।
সমাপনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বেনের বৈশ্বিক সমন্বয়কারী নজরুল ইসলাম। প্রধান অতিথি ছিলেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান।
সম্মেলনের সুপারিশ পড়ে শোনান বাপার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল। পরিবেশবিষয়ক প্রতিবেদনের জন্য দৈনিক ইত্তেফাক-এর সাংবাদিক আসিফুর রহমান, দৈনিক ডেইলি স্টার-এর পিনাকী রায় এবং হবিগঞ্জ থেকে প্রকাশিত দৈনিক খোয়াইকে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.