টিকিয়ে রাখতে হবে অস্তিত্ব, শিখছে নিজস্ব ভাষা- কলাপাড়ায় অন্য রকম লড়াই রাখাইনদের by মেজবাহউদ্দিন মাননু

রাখাইন উয়েনের বয়স এখন ২৬ বছর। রাখাইন ভাষায় কথা বলছেন। পারেন বাঙালীদের ভাষাও। কিন্তু লিখতে পারেন না নিজস্ব ভাষার বর্ণমালা, এমনকি চেনেন না। একই অবস্থা তারই ছোট ভাই ছান মং এর। ছান মং ২০ বছরের তরুণ।
এভাবে প্রায় দুই যুগ আগ থেকে জন্ম নেয়া রাখাইন অধিবাসীদের শতকরা ৯৮ জন নিজস্ব ভাষা চেনে না। পারে না লিখতে। শুধু কথাবার্তা বলতে পারেন। তবে দুই ভাই এখন নিজস্ব ভাষা শেখার কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন। এজন্য তাদের প্রবল আগ্রহ। ধর্মীয় দীক্ষা নেয়ার সময় উভয়কে বাংলায় লিখে দেয়ার পরে তারা তা পাঠ করেছেন। কলাপাড়ার আদিবাসী রাখাইন অধিবাসীরা তাদের নিজস্ব ভাষা এভাবে হারিয়ে ফেলছে। উয়েনের পিতা মংতেন লা জানালেন, তিনি বিয়ের পর থেকেই নাইয়রিপাড়ায় বসবাস করে আসছেন। তাঁর স্ত্রী মাতেন জানালেন, আর্থিক দৈন্যের কারণে তাঁদের ভাষায় পরিচালিত স্কুলগুলো প্রায় কুড়ি বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে।
এই দম্পতি জানান, রাখাইন ভাষার বই পাওয়া যায় না। নিজস্ব জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে রাখাইনরা সাগরপারের জনপদ কলাপাড়ায় এখন পরিণত হয়েছে ক্ষয়িষ্ণু জাতিতে। অথচ একসময় এতদাঞ্চল পরিচালিত হতো রাখাইনদের দাপুটে নিয়ন্ত্রণে। রাখাইন পল্লীতে প্রবেশ করতে অনুমতি লাগত। পাড়ার হেডম্যানরা (মাদবর) নিয়ন্ত্রণ করত নিজেদের পাশাপাশি গোটা জনপদ। এখন পাড়াগুলো হয়ে গেছে বিলুপ্ত। প্রত্যেকটি পাড়ায় রয়েছে দেবোত্তর সম্পত্তি। যা অধিকাংশ দখল করে নেয়া হয়েছে। জীবিকার অবলম্বন জমিজমা হারিয়ে এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে এমন দাবি অধিকাংশের। বর্তমানে যারা রয়েছে তাদের নিজস্বতা হারিয়ে গেছে। চলছে অন্যের রঙে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় বই পড়ছে এরা। তারপরও দুএকটি রাখাইন পল্লীতে প্রায় তিন বছর আগে থেকে আবার শুরু হয়েছে রাখাইন ভাষা শেখার স্কুল। ছোট্ট পরিসরে পরিচালিত এমন একটি স্কুল রয়েছে নাইয়রিপাড়ায়। মন্দির সংলগ্ন এলাকায় ১২ জন ছেলে এবং ১৬ জন মেয়ে শিখতে পারছে নিজস্ব ভাষা। শিক্ষক মংতেন লা জানালেন, বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস তাদের এই স্কুল পরিচালনায় সহায়তা করছে। নাইয়রিপাড়ার ১১টি পরিবারের সন্তান ছাড়াও পাশের কালাচানপাড়া ও মোথাওপাড়ার শিশুরাও এই স্কুলে নিজস্ব ভাষা শেখার সুযোগ পাচ্ছে। ২৬ বছরের উয়েন নিজস্ব ভাষা চেনে না, কিন্তু তার ১০ বছরের ছোট বোন ঠিকই নিজস্ব ভাষায় লিখতে পারে। পারছে পড়তে। তবে নির্দিষ্ট শিক্ষক রেখে তাদের বেতন-ভাতা দিতে পারলে এই স্কুল স্থায়িভাবে টেকানো সম্ভব হতো বলে মংতেন লার মতো সকলের অভিমত। চরম দৈন্যের মধ্যেও মাত্র ১৫শ’ টাকা সম্মানির বিনিময়ে ভাষা শেখার স্কুলটি চালাচ্ছেন মংতেন লা ও মাতেন দম্পতি। উভয়ে যে যখন সুযোগ পান তখনই ছোট্ট শিক্ষার্থীদের নিয়ে শুরু করেন ভাষা শেখার স্কুলটি। নিজের টংঘরের সঙ্গে ব্ল্যাকবোর্ড টানিয়ে সকাল-বিকেল পরবর্তী প্রজন্মকে নিজস্ব ভাষা শেখাতে লেগে যান।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মাতেন তিন শিশুকে নিজস্ব ভাষা শেখাচ্ছেন। নিজ সন্তানের মতো এই মা তার মাতৃভাষা শেখাচ্ছেন মমত্ব দিয়ে। শিশু সেইমে, উমেন ও মাসেই উচ্চৈঃস্বরে পড়ছেন তাদের নিজস্ব বর্ণমালা। প্রত্যেকর হাতে বইয়ের ফটোকপি। বই সঙ্কটে তাদের ফটোকপি করতে হয়েছে। মাসেই জানান, সে ৪র্থ শ্রেণীতে ইসলাম ধর্মের বই পড়েছেন। ধর্মীয় বিষয়ে ইসলাম ধর্মের বই পড়ে পরীক্ষা দেয় মাসেই। হাতেমপুর রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সে একমাত্র রাখাইন শিশু। স্কুলে বাধ্য হয়ে ইসলাম ধর্ম পড়লেও বাড়িতে ঠিকই নিজস্ব ভাষার বই পড়ছে। মাতেন জানালেন যখন মাছ, কাকড়া ধরার মৌসুম থাকে তখন স্বামী মংতেনলা ওই কাজে নেমে পড়েন। জীবিকার প্রয়োজনে মাছ ও কাঁকড়া-কুইচ্চা ধরেন মংতেন লা। আর স্ত্রী মাতেন ভাষা শেখার স্কুল চালান। এভাবে বর্তমানে কলাপাড়া উপজেলার বৌলতলী এবং আমখোলাপাড়ায় আরও দু’টি রাখাইন শিশুর ভাষা শেখার স্কুল পরিচালিত হচ্ছে। তবে বিভিন্ন ডোনার সংস্থা সহায়তার হাত গুটিয়ে নেয়ায় আমখোলার ভাষা শেখার স্কুলটি বন্ধের উপক্রম হয়েছে। এভাবে কলাপাড়ার আদিবাসী রাখাইন জনপদের অন্তত দেড় হাজার জনগোষ্ঠী তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে নিজস্ব ভাষা শেখার যে স্বপ্ন দেখছিল তা আবার ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কারিতাস সমন্বিত সমাজ উন্নয়ন প্রকল্প বরিশাল অঞ্চলের ইনচার্জ মেইন থিন প্রমীলা জানান, ২০০৭ সাল থেকে কলাপাড়ার বৌলতলীতে এবং নাইয়রিপাড়ায় ১১ সাল থেকে রাখাইন ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র চলছে। যার বইসহ যাবতীয় সহায়তা কারিতাস করে আসছে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রকল্প প্রথম পর্যায়ের সহায়তা দিচ্ছে। পরবর্তীতেও এই প্রকল্পের সহায়তা থাকবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তবে স্কুল সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করার প্রয়োজন রয়েছে বলে প্রমীলা মন্তব্য করেন। প্রবীণ রাখাইন নেতা উসুয়ে হাওলাদার জানান, রাখাইন ভাষা শেখার স্কুলগুলো চালু করতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এছাড়া রাখাইনপাড়া যেসব এলাকায় রয়েছে সেইসব এলাকার স্কুলগুলোতে রাখাইন শিক্ষক নিয়োগ দেয়াও প্রয়োজন। তাহলে নিজস্ব ধর্মীয় বই পড়া সম্ভব হবে।

No comments

Powered by Blogger.