গণতন্ত্র-সমাজের আরও আরও গণতন্ত্রায়ন by ইমতিয়াজ আহমেদ

রাষ্ট্রের মূল কাঠামোগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার বিষয়টি যথাযথভাবে রয়েছে কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। এর ফলে গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাহত হচ্ছে। যারা ক্ষমতায় থাকছে তারা সবকিছুর ওপর প্রাধান্য বিস্তার করছে এবং বিরোধীদের জন্য স্পেস থাকছে খুব কম।
আবার দলের মধ্যেও ভিন্নমতের প্রকাশের সুযোগ থাকছে না। প্রকৃতপক্ষে আমরা দেখছি এমন এক
চিত্র যেখানে জনগণ=রাষ্ট্র=সরকার=শাসক


এক মহাবীর একটি প্রকাণ্ড পাথর খণ্ড অনেক কষ্টে টেনে তুলল পাহাড়ের চূড়ায়। তারপর ঠেলে নিচে ফেলে দিল। কারণ সে পরীক্ষা করতে চেয়েছে যে, পাথরটি নিজের ভারেই নিচে গড়িয়ে পড়ে। এমন পরীক্ষার কী প্রয়োজন রয়েছে? বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করেছে। লাখ লাখ মানুষ এ জন্য আত্মদান করেছে। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল গণতান্ত্রিক অধিকার কায়েমের জন্য সংগ্রাম। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জনগণ তাদের দ্ব্যর্থহীন রায় ঘোষণা করেছিল আওয়ামী লীগের পক্ষে। কিন্তু পাকিস্তানের জঙ্গি শাসকরা এ রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে চায়নি বলেই বাংলাদেশের জনগণকে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক যে, এমন গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন দেশেও গত চার দশকে গণতন্ত্র নিয়ে চলছে অনেক পরীক্ষা। বাকশাল গঠন, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক ও সেনাপতিদের শাসন এবং ২০০৭ সালে সেনাবাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার_ প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা দেখছি যে, রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন জানায়নি।
আমরা জানি যে, আধুনিক যুগে গণতন্ত্র রাজনৈতিক দল ছাড়া চলতে পারে না। গণতান্ত্রিক সমাজে তারা জনগণকে সংগঠিত করে গণতান্ত্রিক উপায়ে। এ প্রক্রিয়া শান্তিপূর্ণও হয়ে থাকে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, দুই দফায় ঔপনিবেশিক শাসন এখানে চেপে বসেছিল। এ শাসকদের হটাতে আন্দোলন হয়েছে দীর্ঘস্থায়ী এবং তাতে সহিংসতার উপাদানও ছিল। তদুপরি রাজনৈতিক অঙ্গনেও মেরুকরণ ঘটে যথেষ্ট। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়েও এর প্রভাব থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। বিশেষ করে যখন ক্ষমতাসীনরা অগণতান্ত্রিক আচরণ করতে থাকে, তখন গণতন্ত্রের জন্যই সহিংস পন্থা বেছে নিতে হয়। 'হরতাল-সংস্কৃতিও' আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। প্রাক্-স্বাধীনতা ও একাত্তর-পরবর্তী সময়ের হরতাল নিয়ে সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত গবেষণা করেছেন। এ গবেষণার ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট প্রকাশিত 'সংবাদপত্রে হরতালচিত্র' গ্রন্থে দেখা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে হরতাল সংখ্যা বিস্ময়করভাবে বেড়ে চলেছে। আমরা কয়েক দফা সামরিক শাসনের অধীনে ছিলাম। কিন্তু লক্ষণীয় যে, সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই হরতাল আহ্বানের ঘটনা নেই। বরং হরতাল বেশি হয়েছে গণতান্ত্রিক শাসনামলে। এমনকি রাজনীতিসচেতন অনেকেও মনে করেন, হরতাল হচ্ছে 'গণতান্ত্রিক অধিকার'। তারা এটা ভুলে যান যে, হরতাল সফল করায় সহিংস পিকেটিংয়ের অবদান থাকে এবং এ ধরনের কর্মসূচি ক্ষুদ্র দোকানদার ও ব্যবসায়ী এবং দিনমজুরদের উপার্জনের পথ বন্ধ করে দেয়। ছাত্ররা ক্লাসে যেতে পারে না এবং মরণাপন্ন রোগীদের হাসপাতালে নেওয়ার কাজে বিঘ্ন ঘটে। হরতাল স্বেচ্ছায় পালন করতে হবে এবং তা অহিংস আন্দোলনের উপায়_ এটাই চেয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। কিন্তু এখন আমরা দেখছি যানবাহনে অগি্নসংযোগ, বোমাবাজি ও গোলাগুলির ঘটনা। গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত, কিন্তু তা ঘটে চলেছে। হরতালে শুধু কাজ বন্ধ থাকে না। তার অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়াও হয় ব্যাপক। বিশ্বব্যাংক একটি হিসাবে দেখিয়েছে, নব্বইয়ের দশকে হরতালের কারণে বাংলাদেশে বছরে জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর হিসাব হচ্ছে : হরতালের কারণে প্রতিদিন এক কোটি ৮০ লাখ ডলার ক্ষতি হয়।
গণতন্ত্রের ব্যবস্থার মধ্যেও অনেক রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। ১৯৯৭ থেকে ২০০৬, এ সময়ে অনেক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের পরবর্তী দুই বছরে রাজনৈতিক কারণে খুনের ঘটনা প্রায় ছিলই না।
স্বাধীনতার চার দশক অতিক্রান্ত হওয়ার বছরে আমরা এমন চিত্রের মূল্যায়ন করতে বসেছি। কেন এত রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ও হিংসা? এর একটি কারণ ধারণা করা হয় রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রের অভাব। এখানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মতো দল নেতাকেন্দ্রিক। মূল নেতা সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে জনপ্রিয়, কিন্তু দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা নেই। একইসঙ্গে দেখা যায়, অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের প্রতি অসহিষ্ণুতা। দলে মাস্তানরাও স্থান করে নেয় এবং নিজেদের উপস্থিতি ও অপরিহার্যতা প্রমাণ করতে সচেষ্ট থাকে।
রাষ্ট্রে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে প্রশাসন। কিন্তু গত দুই দশকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পর্যায়ক্রমিক শাসনামলে প্রশাসনে অনুগত লোকদের বসানোর প্রক্রিয়া আমরা দেখেছি। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় দলই নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর প্রশাসনে দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়েছে। তারা পছন্দের কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দিয়েছে এবং অপছন্দের ব্যক্তিদের করা হয়েছে ওএসডি। রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ার কারণে প্রশাসনের দক্ষতা হ্রাস পায়। ভয়ভীতিও কাজ করে। তারা ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করে এবং গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তা বিশেষ সমস্যার সৃষ্টি করে। নতুন প্রশাসন এলে তারা মামলা-মোকদ্দমায় পড়বে কিংবা হয়রানির শিকার হবে, এমন দুচিন্তা অনেকের মধ্যে কাজ করে।
জাতীয় সংসদও ঠিকভাবে কাজ করছে না। সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবেশেও সংসদ দেশের যাবতীয় সিদ্ধান্তের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারছে না। প্রধান বিরোধী দল পালাক্রমে সংসদ বর্জন করে চলেছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, নবম জাতীয় সংসদে 'সংসদ বয়কট' অতীতের বিষয় হবে। কিন্তু কথা রাখা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে সংসদে ক্ষমতাসীনরাই উপস্থিত থাকছে এবং ভিন্নমত আদৌ ধ্বনিত হয় না। এমনকি বিরোধী পক্ষের এক-দু'জন উপস্থিত হলেও তাদের কথা বলার তেমন সুযোগ ঘটে না। এ ক্ষেত্রে আমরা অতি সাম্প্রতিক একটি ঘটনা উল্লেখ করতে পারি। আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের ঘটনা নিয়ে স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিম সংসদে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ট্রেজারি বেঞ্চ তাতে সায় দেয়নি। দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের অভাবের সমস্যাও সংসদের কার্যক্রমে প্রতিফলিত হয়। সংবিধানের ৭০ (১) অনুচ্ছেদ এ ক্ষেত্রে বড় বাধা। সংসদের ফোরামেও সবাইকে কথা বলতে হবে এক সুরে। অথচ এটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত যে, ভিন্নমত ব্যতিরেকে গণতন্ত্র হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে এর চর্চা ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
পার্থক্য গড়ে দিতে পারত বিচার বিভাগ। কিন্তু এখানেও দল ও সরকারের প্রভাব সমস্যা সৃষ্টি করছে। সংবিধান বলছে, রাষ্ট্র নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথক সত্তা নিশ্চিত করবে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের ভিত্তিতে ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক লেগেই থাকে। সর্বোচ্চ আদালতের বিষয়ে অনেক সিদ্ধান্তের পর আমরা দেখি, বারের এক পক্ষ তাকে স্বাগত জানায় এবং আরেক পক্ষ প্রতিবাদ করে। আদালত অঙ্গনে পাল্টাপাল্টি মিছিল-সমাবেশও আয়োজিত হয়।
এসব অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বলতে পারি যে, রাষ্ট্রের মূল কাঠামোগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার বিষয়টি যথাযথভাবে রয়েছে কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। এর ফলে গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাহত হচ্ছে। যারা ক্ষমতায় থাকছে তারা সবকিছুর ওপর প্রাধান্য বিস্তার করছে এবং বিরোধীদের জন্য স্পেস থাকছে খুব কম। আবার দলের মধ্যেও ভিন্নমতের প্রকাশের সুযোগ থাকছে না। প্রকৃতপক্ষে আমরা দেখছি এমন এক চিত্র যেখানে জনগণ=রাষ্ট্র=সরকার=শাসক। একটি উদাহরণ এ ক্ষেত্রে দেওয়া যেতে পারে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে উল্লেখ করেছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে। পাঠ্যবইয়ের ক্ষেত্রে আমরা দেখি, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ইতিহাস হয়ে উঠেছে শাসকদের ইতিহাসে। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেছেন, পাঠ্যবইয়ের ইসলামীকরণের জন্য প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। ধর্মান্ধ শক্তি এ কাজ করেছিল তাদের রাজনৈতিক অভিলাষ থেকেই।
আমাদের জানা আছে যে, বাংলাদেশ পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু দেশের অগণতান্ত্রিক চরিত্র বুঝতে জনগণের সময় লাগেনি এবং প্রথম সুযোগেই তারা তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দেয়। তারা ভাষার ইস্যুকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ১৯৭১ সালে শাসকরা জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ করার জন্য গণহত্যার আশ্রয় নেয়। কিন্তু জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা দমন করা যায়নি। তারা একটি পৃথক গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার রাষ্ট্র কায়েম করতে সক্ষম হয়। এ ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কর্মকাণ্ড আমাদের যথেষ্ট সহায়তা করে। আমরা বলতে পারি, ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন থাকে সেক্যুলার ও গণতান্ত্রিক ভাবধারায় পুষ্ট। এমনকি মার্শাল ল' বা জরুরি আইনের কঠিন সময়েও তারা জনগণের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দমিয়ে রাখতে পারেনি। নারী-পুরুষ, তরুণ-তরুণী থেকে বৃদ্ধ, ধনী-দরিদ্র সবাই নেমে আসে এসব অনুষ্ঠান উপভোগের জন্য।
সিভিল সোসাইটির ভূমিকাও আমাদের মনে রাখতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর অন্যতম কেন্দ্র। এ প্রতিষ্ঠানের ওপরেই একুশের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। বিশ্বে এমন ঘটনা বিরল যেখানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীসহ লাখ লাখ মানুষ দেশের সাহসী সন্তানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসেন, কিন্তু আয়োজক একটি বিশ্ববিদ্যালয়। জাতির মননের প্রতীক বলে অভিহিত বাংলা একাডেমীর অবস্থানও এ ক্যাম্পাসেই। এখানে একুশের গ্রন্থমেলায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ হাজির হয়। তারা দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করে এবং মেটাল ডিটেক্টর অতিক্রম করে যায় কেবল সদ্য প্রকাশিত বইয়ের সানি্নধ্যে যাওয়ার জন্য।
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আরেকটি ক্ষেত্র নাটক ও সঙ্গীতের দলগুলো। এদের সংখ্যা অনেক এবং দলের সদস্যরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্মকাণ্ড এগিয়ে নেয়। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা কতটা মিলল, সেটা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন থাকে না। তারা ছোট-বড় নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করে এবং জনগণের মধ্যে তা সাড়া জাগায়। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ধর্মান্ধ জঙ্গি শক্তির ভয়ঙ্কর বোমা হামলা মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। তারা বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বকীয় পরিচয় তুলে ধরার এ অনন্য আয়োজনের মাত্রা ও গভীরতা উপলব্ধি করে এবং এ কারণেই তা থামিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু জনগণ তা মেনে নেয়নি। পরের বছরগুলোতে রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে জনসমাগম আরও বেড়ে গেছে। নববর্ষের অন্যান্য আয়োজনেও জনগণ ব্যাপকভাবে অংশ নিচ্ছে।
গণতন্ত্র ও সিভিল সোসাইটি একে অপরের জন্য অপরিহার্য। গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছাড়া সিভিল সোসাইটির বিকাশ ঘটে না। আবার সিভিল সোসাইটির ভূমিকা ছাড়া রাষ্ট্রের গণতন্ত্রায়ন ঘটে না। আমাদের দেশে গণতন্ত্র অনেক বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে। এটা ভালো দিক যে, কোথায় কোথায় সমস্যা হচ্ছে তা চিহ্নিত এবং সেগুলোর সমাধানে মনোযোগী হওয়ার সময় এসেছে। প্রথমত, নজর দিতে হবে দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র কায়েমে। কেন দলে গণতন্ত্র অনুপস্থিত সেটা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। জরুরি আইনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গণতান্ত্রিক দলগুলোতে গণতন্ত্র কায়েমের কথা বলেছিল। নির্বাচন কমিশনের তরফেও ছিল প্রচণ্ড চাপ। এটা পরিহাসতুল্যই বটে!
দ্বিতীয়ত, প্রধান দুটি দলে মেরুকরণ কমিয়ে আনতে হবে। কেন দুটি দলে দুই ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই-বা এমন মেরুকরণ, সেটা নিয়ে গবেষকরা কাজ করতে পারেন। দুই প্রধান নেতা কার্যত পরস্পরের মুখোমুখি হন না। জাতীয় সংসদে তাদের বিতর্ক করতে দেখা যায় না। বছরে তাদের একবারই সাক্ষাৎ ঘটে_ সেনাকুঞ্জে সশস্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে। কিন্তু ২০১০ সালে তাতেও ব্যতিক্রম_ বিএনপি চেয়ারপারসন গরহাজির থেকেছেন।
তৃতীয়ত, গণমাধ্যমের ভূমিকা। সমাজের গণতন্ত্রায়নে তারা অবদান রাখছে। এর আরও সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে।
চতুর্থত, শিক্ষার আধুনিকায়ন। তবে সবচেয়ে জোর দিতে হবে মান বাড়ানোর প্রতি। সেক্যুলার ও মাদ্রাসা উভয় ধরনের শিক্ষার সংস্কার আবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে ও বিদ্বেষ ছড়ায় এমন সবকিছু থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে।
চতুর্থত, গণতন্ত্রে সংস্কৃতির ইতিবাচক প্রভাব বাড়িয়ে যেতে হবে। আমি ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত দেশজুড়ে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে এবং প্রগতিশীলতার সপক্ষে ব্যাপক কর্মকাণ্ডের কথা বলেছি। এখন বছরের বাকি মাসগুলোকেও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ভরিয়ে দিতে হবে। আমরা ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাই। ১৭ আগস্ট প্রতিবাদে সোচ্চার হই জেএমবির দেশজুড়ে বোমা হামলার নিন্দায়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। এ মাসটি তাই নানা আয়োজনে পূর্ণ থাকে। অন্যান্য মাস এখনও উন্মুক্ত রয়েছে। এসব বিষয়ে আরও মনোযোগী হওয়া সময়ের দাবি। সাংস্কৃতিক গণতন্ত্রের শিকড় যত গভীরে প্রোথিত হবে সমাজের গণতন্ত্রায়নের লক্ষ্য অর্জন ততই সহজ হবে।

ইমতিয়াজ আহমেদ : রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.