দীর্ঘসূত্রতার জটে আটকে আছে দুদকের এক হাজার ৭শ' মামলা- জট খুলতে পৃথক বেঞ্চ গঠন দাবি

হাসান নাসির/সুজন ঘোষ, চট্টগ্রাম অফিস বাংলাদেশে কোন ব্যক্তিত্বের শততম জন্মদিন উদ্্যাপনের ঘটনা বিরল। কারণ গড় আয়ু এতটাই কম যে, কারও বয়স ৭০ হলেই আমরা বলি যথেষ্ট আয়ু পেয়েছেন।
'সওগাত' সম্পাদক নাসির উদ্দিনের জন্মশতবার্ষিকী পালনের পর ঘটা করে আর এমন দিবস পালিত হয়নি। বিনোদ বিহারী চৌধুরীর শততম জন্মদিন পালনের উৎসব শেষ হলো ১০ জানুয়ারি রবিবার। এ নিয়ে ব্যাপক আয়োজন চট্টগ্রামে।
প্রবীণ বিপস্নবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। জন্ম ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারি। শতবর্ষে পা দিয়েছেন তিনি। ব্রিটিশ আমল, পাকিসত্মান আমল এবং সর্বশেষ স্বাধীন বাংলাদেশ_ এ ত্রিকালদশর্ী বিনোদ বিহারী চৌধুরী যেন এখনও তরম্নণ। বয়সের ভারে কিছুটা নুয়ে পড়লেও মনের জোর হারাননি এখনও। আলোচক হিসেবে মধ্যমণিরূপে তাঁর উপস্থিতি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। শতবর্ষেও তিনি চলেছেন একজন টগবগে যুবকের মতোই। তবে গত ২৮ ডিসেম্বর সহধর্মিণীকে হারিয়ে যাপন করছেন নিঃসঙ্গ জীবন। কিন্তু অনুরাগীদের ভালবাসায় সিক্ত এ বিপস্নবী।
বিনোদ বিহারী চৌধুরীর শতবর্ষ উদ্্যাপন পরিষদের উদ্যোগে ৩ দিনের কর্মসূী গত শুক্রবার শুরম্ন হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে। এতে ঘোড়ার গাড়ি ও বাদ্য যন্ত্র সহকারে যোগ দেয় চট্টগ্রামের সর্বসত্মরের মানুষ। কর্মসূচীতে এছাড়াও ছিল শিশু-কিশোর_নারী-মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ, চিত্র প্রদর্শনী, সেমিনার, আলোচনাসভা, ব্রতচারী, পিঠা উৎসব, শপথ অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি। এ বিপস্নবীর জন্মদিনে যোগ দিতে ছুটে এসেছেন নোবেল শানত্মি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, বিচারপতি হাবিবুর রহমান, শিৰাবিদ প্রফেসর আনিসুজ্জামান, সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. ভারতী রায়সহ দেশ-বিদেশের বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কমর্ী, সাহিত্যিকসহ বিভিন্ন সত্মরের মানুষ। শততম জন্মদিনের এ আয়োজনগুলো ছিল চট্টগ্রাম নগরীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, জে এম সেন হল, মুসলিম হল ও ডিসি হিলের মঞ্চে।
আজীবন সংগ্রামী বিনোদবিহারী চৌধুরীর জন্ম চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার উত্তর ভূর্ষি গ্রামে। বাবা কামিনী কুমার চৌধুরী ছিলেন আইনজীবী। মায়ের নাম বামা চৌধুরী। ১৯২৯ সালে তিনি মেট্রিক পরীৰায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে রায়বাহাদুর বৃত্তিলাভ করেন। জেল-জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করে এবং হুলিয়া মাথায় নিয়ে কাটে তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের একটি বড় অংশ।
মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি যোগ দেন তৎকালীন বিপস্নবী দল যুগানত্মর-এ। আসেন মাস্টারদা সূর্য সেন, তারকেশ্বর দসত্মিদার, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও মধুসূদন দত্তসহ বিপস্নবীদের সংস্পর্শে। এদের মধ্যে প্রথম তিনজনকেই শহীদ হতে হয় ফাঁসিতে ঝুলে। আর শেষোক্ত জন শহীদ হন ঐতিহাসিক জালালাবাদ যুদ্ধে। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল অননত্ম শিং ও গণেশ ঘোষের নেতৃত্বে বিপস্নবীরা পুলিশের অস্ত্রগার দখলে নেয়। সে দলে ছিলেন বিনোদবিহারী চৌধুরীও। অস্ত্রাগার দখল করে তারা ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পতাকা উত্তোলন করেন এবং মাস্টারদা সূর্য সেনকে রাষ্ট্রপতি পদে বরণ করে অস্থায়ী গণতান্ত্রিক বিপস্নবী সরকারের ঘোষণা দেন। পরিকল্পনামাফিক একই দিনে অন্য বিপস্নবীরা দখল করে নেয় ফৌজি অস্ত্রাগার ও টেলিফোন ভবন। সেদিন উৎপাটিত হয় ধুম ও লাঙ্গলকোট রেল স্টেশন সংলগ্ন রেল লাইন। বিপস্নবীরা ১৮ থেকে ২২ এপ্রিল পর্যনত্ম চার দিনের জন্য চট্টগ্রামকে স্বাধীন রাখেন। এ চারদিন ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ হয় জালালাবাদ পাহাড়ে। এ যুদ্ধ ইতিহাসে জালালাবাদ যুদ্ধ নামে পরিচিত।
অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর বিপস্নবী বিনোদবিহারী চৌধুরীকে ধরতে হন্যে হয়ে খোঁজে তৎকালীন পুলিশ। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরিয়ে দেয়ার জন্য ৫শ' টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। এরপর ১৯৩৩ সালে তিনি গ্রেফতার হন। জেল খাটেন একটানা ৫ বছর। ১৯৩৬ সালে ডিস্টিংসন পেয়ে তিনি বিএ পরীৰা দিয়ে উত্তীর্ণ হন। ১৯৩৮ সালে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর আবার গৃহবন্দী হন। বন্দী থাকাকালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইংরেজী শাস্ত্রে এমএ এবং বিএল পরীৰায় অংশ নিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী বিনোদবিহারী চৌধুরীর ১৯৩৯ সালের শেষদিকে 'দৈনিক পাঞ্চজন্য' পত্রিকার সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হন। এর পাশাপাশি ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম আদালতে যোগ দেন আইনজীবী হিসেবে। এ সময় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সহ সম্পাদক হন। ১৯৪১ সাল থেকে আবারও জেলজীবন। চট্টগ্রাম কারাগার, ঢাকা কারাগার ও বকসা বন্দী শিবিরে কেটে যায় ৫ বছর। বেরিয়ে আসেন ১৯৪৫ সালের দিকে। এরপর ১৯৪৬ সালে তিনি কংগ্রেসের চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন।
ধমভিত্তিক পাকিসত্মান সৃষ্টির পর অনেকে দেশানত্মরী হলেও থেকে যান বিপস্নবী বিনোদবিহারী চৌধুরী। বিভিন্ন ৰেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখায় তাকে একাধিকবার কারাবরণ করতে হয় পাকিসত্মান আমলেও। সর্বশেষ কারাবরণ করেন ১৯৬৫ সালে। তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন ১৯৬৯ এর গণঅভু্যত্থান ও ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে। ২০০০ সালে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেছেন। এর আগে আরও পেয়েছেন দৈনিক জনকণ্ঠ ও দৈনিক ভোরের কাগজের বিশেষ সম্মাননা।
উলেস্নখ্য, এ বিপস্নবীর জন্মশতবার্ষিকী পালন উপলৰে গত ৮ জানুয়ারি থেকে নেয়া হয় বিসত্মারিত কর্মসূচী। কর্মসূচীর আযোজক বিপস্নবী বিনোদবিহারী জন্মশত উৎসব উদ্্যাপন পরিষদ। রবিবার কর্মসূচীর শেষ দিনে তাকে দেয়া নাগরিক গণসংবর্ধনা। নগরীর জেএমসেন হলে বিকেলে অনুষ্ঠিত গণসংবর্ধনায় প্রধান অতিথি ছিলেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সংবর্ধনার জবাবে প্রবীণ বিপস্নবী বিনোদবিহারী বলেছেন, মানুষের স্নেহ, প্রীতি, ভালবাসা আমাকে এ বয়সে আজও আন্দোলিত করে। তাদের ভালবাসায় আমি ধন্য। মানুষের সেবা করার জন্য এবং অত্যাচারিত নিপীড়িত নির্যাতিতদের সহযোগিতা করার জন্য ছয় কুড়ি বছর বেঁচে থাকতে চাই।
তরম্নণ প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বলেন, সাহস অর্জন কর, শিরদাঁড়া সোজা কর। অন্যায় অসত্যের বিরম্নদ্ধে জেগে ওঠো। তোমাদের হাতে দেশ পাল্টাবে। এ জন্য এখন থেকে প্রস্তুত হতে হবে। তিনি তরম্নণদের অহঙ্কার, অহমিকা ত্যাগ করার আহবান জানান। একই সঙ্গে তরম্নণদের দুর্বলতা, কাপুরম্নষতা, ভীরম্নতা ত্যাগ করে দেশ ও জনগণের কল্যাণে নিবেদিত করার উপদেশ দেন। মাস্টারদা সূর্য সেনের স্মৃতি রোমন্থন করে এ বিপস্নবী বলেন, মাস্টারদার মনে কোন ধরনের অহঙ্কার অহমিকা ছিল না। তিনি ছিলেন উদার মনের বিশাল মানুষ। সহজ সরল জীবন যাপনেই অভ্যসত্ম ছিলেন। কিন্তু তিনিই ছিলেন অন্যায় অসত্যের বিরম্নদ্ধে দৃঢ় ও কঠিন। বিপস্নবী বিনোদবিহারী দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, আমার দেশ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশ। কিন্তু এদেশে এখনও ধনী গরিবের বৈষম্য বিদ্যমান। এগুলো আমাকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দেয়। আমরা এমন স্বাধীনতার জন্য বিপস্নবে অংশ নেইনি। আগামীতে বৃহত্তর পরিসরে একটি গ্রন্থ রচনার আশাবাদ ব্যক্ত করেন বিপস্নবী বিনোদবিহারী চৌধুরী। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বাংলাদেশে অনেক সমস্যা-সঙ্কট বিদ্যমান। দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য, জলবায়ু সমস্যা আমাদের তরম্নণ সমাজের কাছে তুলে ধরতে হবে। তাদের মনে সাহজ জাগিয়ে তুলতে হবে। কারণ তারম্নণ্যের দুঃসাহসই পারে বিদ্যমান সঙ্কট দূর করতে। যেমন করেছেন মাস্টারদা সূর্য সেন ও তার সহযোগী একদল তরম্নণ। বিপস্নবী বিনোদবিহারীকে দেশের গর্ব আখ্যায়িত কেের তিনি আরও বলেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অস্ত্রাগার দখল করে অগি্নযুগের বিপস্নবীরা ভারতবাসীর মনে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগিয়ে তুলতে সামর্থ্য হয়। তারা অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। এ জন্য তারা নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়েছেন। নিজেদের সর্বস্ব ত্যাগ কেের মানুষের মুক্তির জন্য তারা আন্দোলন থেকে পিছপা হননি। তারা আমাদের হৃদয় ও উদ্দীপনার প্রতীক। অনুষ্ঠানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমানও বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, বিপস্নবী বিনোদ বিহারী এক শ' বছর ধরে আদর্শের পতাকা তরম্নণের মতো বহন করে চলেছেন। তিনি আমাদের প্রতিনিয়ত সৎ পথে থাকার নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন এবং ভবিষ্যতেও দিয়ে যাবেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন প্রফেসর আনিসুজ্জামান জামান, আতাউর রহমান খান কায়সার, ড. ভারতী রায়, আনত্মর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরম্নল ইসলাম, অর্থনীতিবিদ প্রফেসর সিকান্দার খান, অধ্যাপিকা মাহফুজা খানম।
এর আগে গত ৮ জানুয়ারি এ বিপস্নবীর শতবর্ষে পদার্পণ উপলৰে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে স্থাপিত শহীদ ৰুদিরাম মঞ্চে ৩ দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করা হয়। দ্বিতীয় দিনে ৯ জানুয়ারি মুসলিম ইনস্টিটিউট হল মিলনায়তনে শতবর্ষের আলোকে বাংলা ও বাঙালী ১৯১০-২০১০ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারের তিনটি অধিবেশনে চারটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.