অঙ্গীকার পূরণ না হলেও অর্থনীতি বিপর্যস্ত নয় by ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

গত চার বছরে অর্থনীতির চিত্র ছিল মিশ্র। সরকারের কিছু সফলতা আছে। তেমনি কিছু ব্যর্থতা আছে। সব মিলিয়ে অর্থনীতিকে এখন বিপর্যস্ত বলা যাবে না। তবে মানুষের প্রতি সরকারের যে অঙ্গীকার ছিল, তা পূরণ হয়নি।
আর ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ হতে যে ধরনের অর্থনৈতিক অগ্রগতি দরকার, তা অর্জিত হয়নি। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর লক্ষ্য পূরণ হয়নি।
সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে নিত্যপ্রয়োজীয় পণ্যের দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ২০০৯ অর্থবছর থেকে ২০১২ অর্থবছর পর্যন্ত নিয়মিতভাবে পণ্যের দাম বেড়েছে। এখন কিছুটা কমেছে। তবে দেখা যাক, সেটা কত দিন কম থাকে। সরকার পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে একটি 'মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ' করার কথা বলেছিল। সেটি করা হয়নি। সরকার একটি প্রতিযোগিতা আইন করেছে। তবে আইনের অধীনে এখনো প্রতিযোগিতা কমিশন করা হয়নি। ওই কমিশন হলে সেটি পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে কতটুকু কার্যকর হবে তা নিশ্চিত নয়। আওয়ামী লীগ তার ইশতেহারে বলেছিল, নিত্যপণ্যের দামের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হবে। চাঁদাবাজি দূর করা হবে। তবে চাঁদাবাজি কী অবস্থায় আছে, তা মন্ত্রীদের কথায়ই বোঝা যায়। আর সিন্ডিকেট কোথায় আছে, তা কিভাবে ভাঙা যাবে, তা পরিষ্কার নয়।
নির্বাচনী ইশতেহারে মুদ্রামান সুরক্ষার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত টাকার মান ডলারের বিপরীতে কমেছে। এখন কিছুটা বাড়লেও আগের অবস্থায় যায়নি। সরকারের শুরুতে ডলারের দাম ছিল ৬৮ দশমিক ৮ টাকা। আর ২০১২ সালের নভেম্বরে তা ৮১ দশমিক ৫ টাকা ছিল। মাঝে ডলারের দাম আরো বেশি ছিল।
বিনিয়োগে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। মোট জিডিপির এখন ২৫ শতাংশের মতো বিনিয়োগ হচ্ছে। এখানে তেমন উন্নতি হয়নি। প্রবৃদ্ধি ৭ থেকে ৮ শতাংশে নিতে হলে জিডিপির ৩২ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়। এখন দেখা যাচ্ছে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির গতি কমে গেছে। এতে বোঝা যায়, বিনিয়োগে তেমন গতি নেই।
বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার আংশিক সফল। কারণ এ সাফল্য বেশি মূল্য দিয়ে অর্জন করতে হয়েছে। ২০০৯ সালের মার্চে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ৪১৬২ মেগাওয়াট। এটি ছয় হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছিল। তবে মূল্য অনেক খানি বেড়েছে। কারণ এ বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ডিজেল পুড়িয়ে দ্রুত ভাড়াভিত্তিক কেন্দ্রগুলো দিয়ে। ফলে দাম বেড়েছে।
দারিদ্র্য বিমোচনে আগের যে ধারাবাহিকতা ছিল এ সরকার তা রক্ষা করেছে। ২০০০ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী লোক ছিল ৪৮.৯ শতাংশ। ২০০৫ সালে তা ৪০ শতাংশে নেমে যায়। ২০১০ সালে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের হার ছিল ৩১.৫ শতাংশ। ফলে দেখা যাচ্ছে, ধারাবাহিকভাবে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে। তবে আওয়ামী লীগ তার ইশতেহারে ২০১৩ সালের মধ্যে যে লক্ষ্য অর্জনের কথা বলেছিল, তা অর্জিত হচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে। কারণ ২০১৩ সালের মধ্যে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের হার ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা কঠিন। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে দুই বছরে সাড়ে ছয় শতাংশ মানুষকে দারিদ্র্যসীমার ওপরে নিয়ে আসতে হবে।
রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেশ ভালো ছিল। কৃষির উৎপাদন বেড়েছে। যদিও ২০১৩ সালের মধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশের চাহিদা ও এ নিয়ে প্রক্ষেপণ নিয়ে ঝামেলা আছে। গত বছর কিন্তু কৃষি উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ভালো হয়নি। আগামী মৌসুমে ভালো হবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কারণ কৃষক ভালো দাম পায়নি। এতে বোরো চাষে উৎসাহ হারানোর আশঙ্কা আছে। ফলে উৎপাদন বাড়ানোর ধারা টেকসই হবে কি না, তা নিশ্চিত নয়। ডিজেলের দাম সর্বশেষ দফা বাড়ার ফলে উৎসাহ আরো একটু কমবে।
মধ্য আয়ের দেশ হতে হলে আমাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি আট শতাংশে নিতে হবে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি অর্জনে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। সরকারের ২০১১-১২ অর্থবছরে ৭ শতাংশ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু গেল বছর আমরা অর্জন করেছিলাম ৬.৩ শতাংশ। আগামী বছর সেটা ৬ শতাংশের বেশি হবে না বলে আশঙ্কা রয়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমিয়ে দিলে বিনিয়োগ তেমন বাড়বে না। ফলে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন পূরণ কঠিন হবে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়নের হার কিছুটা বেড়েছে। তবে গুণগত কোনো পরিবর্তন নেই। সুশাসন অর্থনীতির ওপরে প্রভাব ফেলে। সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যে অঙ্গীকারগুলো করেছিল, এর বেশির ভাগ পূরণ হয়নি।

টেলিফোন সাক্ষাৎকারের অনুলিখন : রাজীব আহমেদ

No comments

Powered by Blogger.