মহাজোট সরকার : শিক্ষা খাতে এক বছরের সফলতা-ব্যর্থতা by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

আজ ৬ জানুয়ারি ২০১৩ মহাজোট সরকার তার মেয়াদের চার বছর শেষ করে পঞ্চম বর্ষে পদার্পণ করল। সরকারের বিভিন্ন খাতের মতো শিক্ষা খাতেও রয়েছে সফলতা ও ব্যর্থতা।
ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকার স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি যুগোপযোগী ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে; বর্তমানে এর বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গত এক বছরে সরকার শিক্ষা বিষয়ে কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনয়ন ও সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে, যার সুফল আমরা পাচ্ছি এবং আরো পাব বলে আশা রাখছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কারিকুলাম সংস্কার, সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির সম্প্র্রসারণ, শিক্ষা আইন প্রণয়ন, কোচিং বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন, উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি ও হেকাপ প্রজেক্টের সম্প্র্রসারণ, শিক্ষায় মাল্টিমিডিয়া প্রয়োগের ব্যবস্থা এবং অটিজম ও অন্যান্য প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর শিক্ষার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি। পাশাপাশি অতীতের শিক্ষা কার্যক্রমগুলো সফলতার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে একটি শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। শিক্ষা খাতে সরকার সফলতার সঙ্গে এগিয়ে চললেও শিক্ষকদের আর্থিক কোনো পরিবর্তন আজও হয়নি। বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও শিক্ষকরা পৃথক বেতন কাঠামোর মুখ দেখেননি। অথচ সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো গঠনের অঙ্গীকার করেছিল।
আসা যাক, সরকারের সফলতার দিক নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে। শিক্ষার্থীদের চাহিদা ও প্রয়োজনের দিকে নজর রেখে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর পর কারিকুলাম সংস্কার করা প্রয়োজন। বর্তমানে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হয়, তা লেখা হয়েছে ১৭ বছর আগে ১৯৯৫ সালে প্রণীত কারিকুলাম অনুসারে। এ সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান, বিশেষ করে প্রযুক্তির জগতে অভাবনীয় বিপ্লব ঘটে গেছে। এর প্রতিফলন আমাদের পাঠ্যপুস্তকে নেই। এ লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ৫৫০ জন শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, গবেষক নিয়ে প্রায় দুই বছর ধরে নতুন যুগোপযোগী কারিকুলাম বা শিক্ষাক্রম প্রস্তুত করে এর ভিত্তিতে নতুন পাঠ্যপুস্তক তৈরি করেছে। নতুন শিক্ষাক্রম অনুসারে ১১১টি নতুন বই লেখা হয়েছে। এ বছর ১ জানুয়ারি সরকার এই নতুন বই প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসা, কারিগরিসহ সব ধারার শিক্ষার্থীর মধ্যে বিতরণ করেছে। কারিকুলাম যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে কারিকুলামের বৈশিষ্ট্য, নম্বর বিন্যাস, বিষয় সংযোজন-বিয়োজনসহ প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করা হয়েছে। নতুন বিষয় হিসেবে ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, জীবনমুখী শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি, শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও খেলাধুলা, ক্যারিয়ার এডুকেশন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, চারু ও কারুকলা যুক্ত করা হয়েছে। বইয়ের বোঝা কমানো এবং নতুন কোনো বিষয় যোগ করার পরামর্শের আলোকে পুরনো বিষয়গুলো থেকে ৮০০ পৃষ্ঠা প্রাথমিক স্তরে কমানো হয়েছে। আবার বর্তমানে প্রয়োজনীয় কিছু নতুন বিষয়ও যুক্ত করা হয়েছে। নতুন এ কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের শিক্ষার গুণগত মান এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে সহায়ক হওয়ার আশা রাখে।
শহর কি গ্রাম শিক্ষা-কোচিং আমাদের একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে এবং বাণিজ্যে রূপ নিয়েছে। কোচিংয়ের নামে শিক্ষা বাণিজ্য বন্ধের লক্ষ্যে সরকার সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসা নামক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বন্ধ নীতিমালা-২০১২ অনুমোদন করেছে। সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে গঠিত এক কমিটি এ-সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। নীতিমালায় সরকারি ও বেসরকারি (এমপিওভুক্ত) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং সেন্টারে পড়ানোর ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও নিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে পড়ানোর অনুমোদন দেওয়া হয়। এ ছাড়া নিজ প্রতিষ্ঠানের পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে অতিরিক্ত ক্লাস করানোর বিধান রাখা হয়। সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের অনুমতি নিয়ে এবং উপার্জিত অর্থের ১০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে জমা দিয়ে অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়া যাবে। নীতিমালা লঙ্ঘন করলে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানভেদে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। পুরো বিষয়টি মনিটর করার জন্য বিভাগীয় পর্যায় থেকে উপজেলা পর্যন্ত মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নীতিমালা লঙ্ঘনের দায়ে জরিমানা ও অন্যান্য শাস্তি আরোপ করা হয়েছে। আমরা আশা করি, এ নীতিমালা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হলে কোচিংয়ের নামে শিক্ষা বাণিজ্য বন্ধ হবে। শুধু তা-ই নয়, কোচিংয়ের নামে ছাত্রীদের যৌন হয়রানি ও শ্লীলতাহানিও বন্ধ হবে- এমন ধারণা আমরা করতে পারি। শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনায় বিদ্যমান আইনকানুনের সংখ্যা খুব বেশি নয়। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় প্রজ্ঞাপন, অফিস আদেশ, পরিপত্র, সার্কুলার ইত্যাদি জারি করে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান চলছে; তবে এসব বিষয়ে যখনই কোনো মামলা হয়, যথাযথ আইন না থাকায় সরকারপক্ষ প্রায়ই হেরে যায়। শিক্ষাক্ষেত্রে প্রচলিত নানা অনিয়ম-অসংগতি দূর করা এবং আরো উন্নত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে।
শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষার্থীদের পাঠ সহজে বুঝতে ও শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে। এ লক্ষ্যে সরকারি পর্যায় থেকে বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর সহায়তায় ছাত্রছাত্রীদের তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিতকরণের লক্ষ্যে শিক্ষাদান সহজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ল্যাবের মাধ্যমে কম্পিউটার শিক্ষার ক্ষেত্রে দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। কিন্তু মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে পাঠদান যেমন সময় বাঁচায়, তেমনি পাঠদান সহজে বোধগম্য ও আকর্ষণীয় হয়। এ লক্ষ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ে কম্পিউটার শিক্ষার পাশাপাশি মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে পাঠদান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। একটি বিদ্যালয়ে কম্পিউটারসহ একটি ল্যাব তৈরি করতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে, এর চেয়ে অনেক কম খরচে একটি কম্পিউটার বা ল্যাপটপ এবং মাল্টিমিডিয়ার অন্য যন্ত্রপাতির সাহায্যে একটি শ্রেণীকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের পাঠদান সহজ হবে। এ জন্য বিষয়বস্তু তৈরি ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে পাঠদান কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এ পদ্ধতির সাহায্যে এখন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এ বছর থেকে আমাদের গ্রামগঞ্জে থাকা বিদ্যালয়গুলোতে পাঠদান করা হবে।
সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি প্রবর্তন বর্তমান সরকারের শিক্ষা সংস্কারের একটি বড় অধ্যায়। ২০১০ সালে প্রথম এসএসসি পরীক্ষায় এ পদ্ধতি চালু হয় এবং এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। গত বছর নতুন তিনটি বিষয় এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এবং ২০১৩ সালে আরো তিনটি যুক্ত হবে। এইচএসসি পরীক্ষায় ২০১২ সালে প্রথম বাংলা বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু হয়েছে। ২০১৩তে এর সঙ্গে যুক্ত হবে নতুন আটটি বিষয় এবং ২০১৪ সাল থেকে উচ্চতর গণিতসহ ১৩টি বিষয় সৃজনশীল প্রশ্নের আওতায় আসবে। সৃজনশীল পদ্ধতির এ সম্প্রসারণ শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে পাথেয় হিসেবে কাজ করবে বলে অনেকের ধারণা। উচ্চশিক্ষার সম্প্র্রসারণ, গুণগত মান বৃদ্ধি এবং পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা নিরসন এবং এর প্রসারের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার দ্রুত বাস্তবায়ন আমরা দেখতে চাই। এ ছাড়া গত বছর বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে গবেষণার জন্য ২৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৬টি গবেষণা উপপ্রকল্পে ১৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের আর্থিক সাহায্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে কাজ করবে। বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধীদের প্রতি সরকার অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। তাদের শিক্ষা নিশ্চিতকরণের জন্য অটিস্টিক শিশুদের ছাত্রাবাস তৈরি, শিক্ষা উপকরণ, আসবাব, একাডেমিক কাম প্রশাসনিক ভবন সমন্বিত একটি বিশেষায়িত অটিজম একাডেমী প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করেছে। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য আরো অনেক উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তব রূপ পায়নি। যেমন- মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী কাউন্সেলিং ব্যবস্থা, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্টুডেন্ট প্রতিনিধি প্রবর্তন, বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার কমানো, শিক্ষা অধিদপ্তরে দুর্নীতি কমানো প্রভৃতি ক্ষেত্রে তেমন সাফল্য আসেনি।
শিক্ষা খাতে এসব সফল উদ্যোগ গ্রহণ করার পর এ কথা থেকে যায় যে এগুলো বাস্তবায়নের জন্য যাদের প্রয়োজন তাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়োজনগুলো মেটানোর ব্যবস্থা গ্রহণ শুধু প্রতিশ্রুতির মধ্যেই রয়ে যাবে, নাকি বাস্তব রূপ নেবে। আজ যখন দেখি শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির জন্য তাঁদের মাঠে নামতে হয়, এমপিওভুক্তির জন্য অবস্থান ধর্মঘট করতে হয়, তখন কষ্টের সীমা থাকে না। আশা করি, সরকার শেষ সময়ে হলেও শিক্ষকদের কষ্ট লাঘবের জন্য কিছু একটা করবে। আমরা খুবই আনন্দিত যে ৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণের ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর বাবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন ১৯৭৩ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করেছিলেন, তেমনি তাঁর সুযোগ্য কন্যাও একই কাজ করতে যাচ্ছেন। তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
neazahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.