কণ্ঠস্বর-বিশ্বকাপ ক্রিকেট, ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ by রাহাত খান

আমরা যারা বাংলাদেশে বাস করি, গ্রামেগঞ্জে যাই, এনজিওদের কর্মকাণ্ডেরও কম-বেশি হদিস রাখি, তাদের কাছে ক্ষুদ্রঋণে দেশের গরিব মানুষের দারিদ্র্যদশা ঘুচেছে কি-না সেটা চট করে মেনে নেওয়া খুব কঠিন।
কাগজে-পত্রে, তথ্য-পরিসংখ্যানে যা-ই থাকুক, বাস্তবে ক্ষুদ্রঋণে গরিবের গরিবি দশা কিন্তু তেমন ঘোচেনি


বিশ্বকাপ ক্রিকেট এবং শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস_ এ দুটি বিষয়ই এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচ্য বিষয়। বাংলাদেশের অনেকের মতো বাংলাদেশের ক্রিকেটে মহাউৎসাহ জন্মেছিল আমার ও আমার বারো বছরের ছেলে ঋদ্ধির। তবে এই সেদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজের আগুনঝরা বোলিংয়ে বাংলাদেশ যেভাবে ৫৮ রানে আত্মহত্যা করল, তাতে টেলিভিশনে বিশ্বকাপের ক্রিকেটগুলো তত আর টানে না এখন।
এখন শুনছি, সাকিব আল হাসান এবং সিডন্সের কাছ থেকে যে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, এখনও কয়েকটা খেলা বাকি আছে, বাংলাদেশ এবার ঘুরে দাঁড়াবে। বাংলাদেশের এই ঘুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছাটা ক্রিকেট খেলতে নেমে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে ইয়া আলি বলে মাঠ থেকে লম্বা দেওয়া নয়তো! এ রকম নির্মম রসিকতাও কেউ কেউ করছেন। আমি অবশ্যই এ নির্মম কৌতুককারীদের দলের নই। ব্যক্তিগতভাবে আমার প্রচণ্ড সম্মানবোধ, ভালোবাসা এবং সমর্থন রয়েছে গত ১০-১১ বছরের মধ্যে বিশ্ব ক্রিকেটে বেশ কয়েকটি ভালো জয় পাওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের প্রতি। হাজার কোটি টাকা খরচ করেও বাংলাদেশের পক্ষে যা করা সম্ভব হতো না, বাংলাদেশের মাত্র দুই প্রজন্ম বয়সী ক্রিকেট দলটি সেই অসামান্য কাজটি ইতিমধ্যে সম্পন্ন করেছে। বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের পতাকাকে বিশ্বজনের কাছে পরিচিত করে তুলেছে। যে কয়টি জয় বাংলাদেশের দুই প্রজন্মের ক্রিকেট দল লাভ করেছে, তাতে গোটা বাংলাদেশ যেমন আনন্দ সাগরে ভেসেছে, তেমনি বিশ্বের শতকোটি লোকও বাংলাদেশকে আগের মতো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করে সম্মান ও সমীহ করতে শিখেছে। এটা কম বড় পাওয়া নয়।
ক্রিকেট মহান অনিশ্চয়তার খেলা ঠিকই। এই যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ৫০ ওভারে ৫৮ রানের বেশি করতে পারল না, এটা ক্রিকেটের সেই বিশেষত্বের অংশ হিসেবেই আমাদের মেনে নিতে হবে। তবে হারজিত যা-ই হোক না কেন, ক্রিকেটে ঢিল ছোড়াছুড়ি, দুয়ো দুয়ো বা ভুয়া ভুয়া রব তোলা কিন্তু ভদ্রজনোচিত আচরণ নয়। বলতেই হয়, ক্রিকেটের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ জানানোর নামান্তর সেটা। এ ধরনের লোকদের বরং ক্রিকেটের মাঠে না যাওয়াই তো ভালো। সেদিন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সামান্য রান করায় বাংলাদেশের মানুষকে যত না দুঃখিত, ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হতে হয়েছে, খেলাশেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়দের বহনকারী বাসে ঢিল মেরে, খেলার সময় নানা রকম বিদ্রূপাত্মক হট্টগোল তুলে বাংলাদেশের মানুষকে বোধকরি তার চেয়েও বেশি অপমান ও লজ্জার দায় বইতে হয়েছে। সেদিনের ক্রিকেট মাঠে কিছুসংখ্যক উচ্ছৃঙ্খল ও আত্মসম্মান জ্ঞানহীন বাংলাদেশির ঢিল ছোড়াছুড়ি এবং অভব্য আচরণের জন্য লজ্জাবোধ করাও বোধকরি যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এমন লজ্জাজনক ঘটনা আর ঘটেনি।
বাংলাদেশের অনেকের মতো, হারজিত যা-ই হোক, আমিও বাংলাদেশ ক্রিকেটের ঘোর সমর্থক। বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনুরাগী দর্শক। গত কয়েক বছর বাংলাদেশের ক্রিকেট অসামান্য উন্নতি করেছে। বিশ্বের কোনো ক্রিকেট খেলিয়ে দেশই বাংলাদেশের ক্রিকেটকে আগের মতো, আর যা-ই হোক দুর্বল মনে করে না; বরং বিশ্ব ক্রিকেটের অনেক রথী-মহারথী বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে যে কোনো বড় শক্তিশালী ক্রিকেট দলের জন্য বিপজ্জনক প্রতিপক্ষ বলে মনে করেন। এমনও তারা বলে থাকেন যে, বর্তমানের বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বিশ্বের যে কোনো শক্তিশালী ক্রিকেট দলকে হারিয়ে দিতে সক্ষম।
আবার বলি, বাংলাদেশের অনেকের মতো আমিও বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনুরাগী সমর্থক। ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দলের বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়ায়, আবার তারা কোয়ার্টার ফাইনালের প্রায় হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের বৃত্তে ফিরে আসুক, মনেপ্রাণে সেটাই কামনা করি। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে 'ম্যাচ উইনিং' বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ই তো আছেন।
তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দু'একটা গুরুতর বিচ্যুতি আছে, যা উল্লেখ না করলেই নয়। যেমন নিয়ম হলো, ক্রিজে ব্যাট নিয়ে থাকার সময় বিপক্ষ দলের বোলারের করা বলের গতি ও প্রকৃতি বুঝে এরপর ব্যাট চালানো কিংবা টেকনা দিয়ে আত্মরক্ষা করা। বল বুঝে ব্যাট চালানোটাই ক্রিকেটের আদি ব্যাকরণ। বোলিংয়ের ব্যাপারে বল করার নিয়ম ক্রিজে দাঁড়ানো ব্যাটসম্যানের দুর্বলতাকে জেনে ও বুঝে সেই মতো বুদ্ধি ও চাতুর্যের সঙ্গে বল করা। বাংলাদেশের ব্যাটিং-বোলিং দুই-ই মোটামুটি ভালো। কিন্তু বল না বুঝে কেউ যদি চার বা ছক্কা হাঁকাতে চায় কিংবা ব্যাটসম্যানের দুর্বলতা ও পিচের অবস্থা না বুঝে কেউ যদি ক্রিজে যেমন খুশি বল হাঁকায়, তাহলে সাধারণ নিয়মবিধি না মানার কারণে যে শাস্তি তাদের প্রাপ্য, সেই শাস্তিই তারা পাবে। অর্থাৎ চার বা ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে ব্যাটসম্যান হারাবে তার উইকেট এবং বোলারকে নিতে হবে অযথা রান দেওয়ার শাস্তি। বল না বুঝে বেপরোয়া ব্যাট চালানো কিংবা বল হাঁকানো, এ বিষয়টি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে আরও নিখুঁতভাবে শিখতে হবে এবং জানতে হবে বলে অনেক ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ মনে করেন।
আরেকটা দুঃখজনক ঘটনা বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে প্রায়ই ঘটে। দেখা যায়, প্রথম সারির দু'জন বা তিনজনের কম রানে পতন ঘটল তো মিডল অর্ডারও কেমন যেন নেতিয়ে পড়ে। আর এরপরে বাংলাদেশি জার্সিধারী 'টাইগার'দের সাজঘর থেকে মাঠে আসা এবং অতিদ্রুত সাজঘরে ফিরে যাওয়াটা অনেক সময়ই একটা সাধারণ ও স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়। আয়ারল্যান্ডের বা নেদারল্যান্ডসের মতো ছোট দলগুলোও ২০-২৫ ওভার পর্যন্ত উইকেট বাঁচিয়ে যদ্দুর সম্ভব, নিজেদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলে যায়। বড় দলগুলোর কথা ছেড়ে দিলাম, বর্তমান বিশ্বকাপে 'ক্ষুদ্র' দল আয়ারল্যান্ড যেমন খেলছে, যেমন লড়াই দিচ্ছে, ইংল্যান্ডের মতো দলকে বিশাল রান তাড়া করে জিতেছে, তা দেখে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের উচিত কিছু শেখা। বাংলাদেশের কাছে আয়ারল্যান্ড হেরেছে বটে, তবে এমন লড়াই দিয়েছে এবারের বিশ্বকাপ প্রত্যাশী ভারতের বিরুদ্ধে এবং উইকেট বাঁচিয়ে রানের পর রান যোগ করে আরেক বিশ্বকাপ প্রত্যাশী ইংল্যান্ডকে যেভাবে ধসিয়ে দিয়েছে, তা বর্তমান বিশ্বকাপের দুটি হৈচৈ ফেলে দেওয়া ঘটনাই বটে। সন্দেহ নেই, অনেকদূর এগোতে হলে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে আরও অনেক কিছু শিখতেও হবে।
বিশ্বকাপ ক্রিকেট সম্পর্কে এ পর্যন্ত। এবার আসা যাক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রসঙ্গে। বিশাল মাপের প্রতিভাধর ব্যক্তি তিনি। বাংলাদেশের গৌরব। আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের দারিদ্র্যদশা ঘোচানো এবং এভাবে সমাজকে অস্থিরতা থেকে রক্ষা করে দেশ ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ২০০৬ সালে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারও লাভ করেছেন। দেশবরেণ্য তো বটে, বিশ্বের নানা দেশ, নানা গুরুত্বপূর্ণ ও গোষ্ঠীর কাছে তিনি বিশেষ সম্মানের পাত্র। হিলারি ক্লিনটন কিংবা বারাক ওবামা, স্পেনের রানী সোফিয়া কিংবা জার্মান চ্যান্সেলর মার্কেলের সঙ্গে দেখা করতে পারেন তিনি অনায়াসে। গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের ব্যবসা বহুকাল করেছেন, এখন তিনি সারাবিশ্বে নিক্ষেপ করেছেন আরেক মহান আইডিয়া, সোশ্যাল বিজনেস বা সামাজিক ব্যবসা। নানা দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, রাজা ও রানীরা তো বটেই, তার এই আইডিয়া লুফে নিয়েছে বিশ্বে বহু নামকরা মাল্টিন্যাশনাল বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানও। শান্তিতে যেমনই হোক কিংবা শান্তি চুলোয় যাক না কেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে ড. ইউনূসের মতো প্রতিভাধর ব্যক্তি বর্তমান বিশ্বে কমই আছেন। তাকে শ্রদ্ধেয় এবং অবশ্য ব্যক্তি হিসেবে গণ্য না করার কোনো কারণ নেই।
হালে বাংলাদেশ ব্যাংক ড. ইউনূসকে অব্যাহতি দিয়েছে এই কারণ দেখিয়ে যে, প্রবিধান অনুযায়ী ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংকপ্রধানের পক্ষে আর থাকতে পারেন না। এ নিয়ে ড. ইউনূসের করা একটি রিট আদালতে খারিজ হয়ে গেছে। মামলার বিষয়ের বাইরে ড. ইউনূস সংক্রান্ত দু'একটি বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে একটি বিশেষায়িত ব্যাংক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ড. ইউনূস এ ব্যাংকের প্রবক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা দুই-ই। তিনি গত কয়েক যুগে গ্রামীণ ব্যাংককে একটি অত্যন্ত লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। এতটাই লাভজনক এবং গ্রামীণ ব্যাংক এতটাই বিত্তশালী যে, কয়েক বছর আগে এই ব্যাংক থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা স্থানান্তর করতে কোনো অসুবিধা হয়নি। অসুবিধা হবে কেন। গ্রামীণ ব্যাংকে আছে হাজার হাজার কোটি টাকা, অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে বিশাল অঙ্কের টাকা। ধরা যাক বৈধভাবেই, কর্জ দিতে তো কোনো বেগ পাওয়ার কথা নয়।
আমার বিনীত একটি জিজ্ঞাসা আছে। সব ব্যাংককে গ্রামীণ ব্যাংকে দেয় সুবিধাগুলো (সুদের হার ৪০ শতাংশ হওয়া, কোনো কো-লেটারেল না থাকা, ব্যবসা-বাণিজ্যে ট্যাক্স মওকুফ পাওয়া) দিলে তারাও তো লাভে-মুনাফায় ফুলেফেঁপে উঠতে পারত। তাদের সেসব সুবিধা দেওয়া হয়নি। কেন, কারণটা খুব সহজ। গ্রামীণ ব্যাংক ড. ইউনূসের নেতৃত্বে দেশের গরিব মানুষের দারিদ্র্য ঘোচানোর এবং সমাজে তাদের মানুষের মতো মানুষ হয়ে বসবাস করার মহান দায়িত্ব পালন করছে।
সবই ঠিক আছে। তবে আমরা যারা বাংলাদেশে বাস করি, গ্রামেগঞ্জে যাই, এনজিওদের কর্মকাণ্ডেরও কম-বেশি হদিস রাখি, তাদের কাছে ক্ষুদ্রঋণে দেশের গরিব মানুষের দারিদ্র্যদশা ঘুচেছে কি-না সেটা চট করে মেনে নেওয়া খুব কঠিন। কাগজে-পত্রে, তথ্য-পরিসংখ্যানে যা-ই থাকুক, বাস্তবে ক্ষুদ্রঋণে গরিবের গরিবি দশা কিন্তু তেমন ঘোচেনি। ক্ষুদ্রঋণে কেউ উপকৃত হয়নি, তা বলছি না। তবে গ্রামীণ ব্যাংকের এবং এ ধরনের উচ্চ সুদ গ্রহণকারী ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান কিংবা এনজিওদের দ্বারা দারিদ্র্য মোচন কমই হয়েছে। এককালে কাবুলি মহাজনরা যেমন 'আসল নেহি, সুদ মাংতা' বলে উচ্চহারে ঋণ নেওয়া হতভাগাদের ওপর চড়াও হতো, গ্রামীণ ব্যাংকও বহু ক্ষেত্রে তা-ই করে। সুদ ও আসল না পেলে তারা গরিব ঋণগ্রহীতার দুধের গাভী নিয়ে যায়, ঘরের টিনের চাল খুলে নিয়ে যায়, গ্রামের গরিব মেয়ের নাকের সোনার নথ পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায়_ বিশেষায়িত ব্যাংক তো, সেই রকম ক্ষমতা গ্রামীণ ব্যাংককে দেওয়া আছে। বহুকাল মিডিয়ায় কাজ করেছি, এমন সংবাদও প্রচুর ছাপা হয়েছে যেখানে গ্রামীণ ব্যাংক এবং এ রকম উচ্চহারে সুদ খাওয়া এনজিওর কাছ থেকে পাঁচ হাজার, ১০ হাজার টাকা নিয়ে বহু দরিদ্র মানুষ দেনার দায়ে সর্বস্ব হারিয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। উচ্চহারে গরিব মানুষকে ক্ষুদ্রমাত্রার ঋণ দিয়ে দরিদ্র ঘোচানো সম্ভব নয় কিছুতেই। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল গরিব মানুষকে তাদের সামর্থ্যের আওতায় নিচুহারে ঋণ দিয়ে গ্রামের অমানুষ কুসীদজীবীদের হাত থেকে রক্ষা করা, হাজার, লাখ কোটি টাকা কামানো নয়। হাজার হাজার কোটি টাকা অন্য কোম্পানিতে স্থানান্তরের চেয়ে ঋণের হার পাঁচ-সাত পার্সেন্টে নামিয়ে গরিব মানুষকে তাদের ঠেকার সময় সাহায্য করাই উচিত গ্রামীণ ব্যাংকের মতো ব্যাংকের। এ রকম ৩০-৪০ পার্সেন্ট সুদ নেওয়া আইন করে বন্ধ করছে না কেন সরকার_ এটা সময়ের প্রশ্ন। ৩২ কিংবা ৪০ পার্সেন্ট সুদ না নিলে যদি কোনো বিশেষায়িত ব্যাংকের না চলে, তাহলে না-ই চলুক? এমন চশমখোর, গরিব মানুষকে শোষণ করে হাজার হাজার কোটি টাকা কামানো ব্যাংকের কী দরকার আমাদের মতো গরিব দেশের।
ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করে শুধু বাংলাদেশকে নয়, বিশ্বের নানা দেশে বসবাসরত বাংলাভাষীদের অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা লাভ করেছেন। তিনি দেশের গৌরব নিঃসন্দেহে। বাংলাদেশের মিডিয়া, বিশেষ করে একটি প্রধান বাংলা আর একটি ইংরেজি দৈনিক ড. ইউনূসের বিষয়টি নিয়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ করছে, তার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমিও একমত। একজন নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্বকে হেয় করে আমরা নিজেরাই নিজেদের হেয় করছি। কথাটা সত্য। তবে একটা প্রশ্ন তবু জাগে। দারিদ্র্য ঘোচানো তো গ্রামীণ ব্যাংকের দ্বারা হয়নি; অন্তত আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান তা-ই বলছে। তাহলে শান্তির জন্য কেন ড. ইউনূসকে পুরস্কার দেওয়া?
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আসলে গ্রেনেড হামলার কত ঘটনা ঘটেছে। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ওপর হামলা, কমিউনিস্ট পার্টির জনসভায় হামলা, পহেলা বৈশাখে ছায়ানট সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা, ২১ আগস্ট বিরোধী দলের জনসভায় হামলা, ড. শামস কিবরিয়ার মতো বিশাল মাপের মানুষকে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে মেরে ফেলা, আহসানউল্লাহ মাস্টারকে মেরে ফেলা, কত আর বলব_ কই শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস তো এসব হীন সশস্ত্র ঘটনা সম্পর্কে কখনও টুঁ শব্দটি করেননি। কেন করেননি, কেন মাইনাস ওয়ান থিওরি সমর্থন করেছিলেন, অন্তত মৌন সম্মতি তো ছিল, এসব প্রশ্ন স্বভাবতই জাগে। কেননা ড. ইউনূসকে তো নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল শান্তির জন্য। শান্তি প্রচার কিংবা শান্তি প্রতিষ্ঠার কোন কাজটা তিনি করেছিলেন, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে সেটা জানার অধিকার এ দেশের মানুষের আছে বৈকি।
তবে যা-ই হোক, ড. ইউনূস একজন বিশ্বনন্দিত এবং শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তাকে যাতে কোনোভাবে হেনস্তা কিংবা অসম্মানের শিকার না হতে হয়, সরকারকে সেটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। ৭১ বছর বয়স ইউনূসের। তিনি যাতে সম্মান নিয়ে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অব্যাহতি পান বা অব্যাহতি নেন, সেটা মনেপ্রাণে প্রত্যাশা করি আমি।

রাহাত খান : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.