শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে, কমেছে খালেদা জিয়ার- সরকারের জনপ্রিয়তা কমেছে

সরকারি দল আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ২০১২ সালে আরও কিছুটা কমেছে। ২০১১ সালের ৩৮ শতাংশ থেকে ২০১২ সালে তারা নেমেছে ৩৫ শতাংশে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির জনপ্রিয়তা বেড়েছে সামান্যই। ২০১১ সালের চেয়ে ১ শতাংশ বেড়ে ২০১২ সালে তারা পেয়েছে ৪৪ শতাংশ মানুষের সমর্থন।
সরকারের শরিক দল জাতীয় পার্টির (এরশাদ) জনপ্রিয়তা ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ২০১১ সালে তারা পেয়েছিল ৮ শতাংশ মানুষের সমর্থন; এবার পেয়েছে ১২ শতাংশের। জামায়াতে ইসলামীর প্রতি মানুষের সমর্থন গত এক বছরে ১ শতাংশ কমে ৩ শতাংশ হয়েছে। প্রথম আলোর উদ্যোগে পরিচালিত এক জনমত জরিপে এ মতামত উঠে এসেছে।
২০১২ সালের নভেম্বর মাসে জনমত জরিপটি পরিচালনা করেছে দেশের খ্যাতিসম্পন্ন পেশাদার জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেড। বাংলাদেশের জনবিন্যাস অনুযায়ী মানুষের অবস্থান, বয়স এবং নারী-পুরুষ ও গ্রাম-নগরবাসী অনুপাতে উত্তরদাতা বেছে নেওয়া হয়। দৈবচয়নের ভিত্তিতে সারা দেশ থেকে নির্বাচিত এ উত্তরদাতার সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার। মহাজোট সরকারের প্রথম বছর পূর্তির সময় থেকে গত চার বছরে বার্ষিক ভিত্তিতে নিয়মিত এ জরিপ পরিচালনা করা হচ্ছে।
তবে এ জরিপে রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয়তায় শহর ও গ্রাম এবং নারী-পুরুষভেদে পার্থক্য লক্ষ করা গেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জনপ্রিয়তা শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি। পক্ষান্তরে জাতীয় পার্টির (এরশাদ) সমর্থকেরা গ্রামের চেয়ে শহরে বেশি। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি (এরশাদ) পুরুষদের কাছে বেশি জনপ্রিয়; বিএনপি নারীদের কাছে। বয়স্ক ও তরুণদের মধ্যে বিএনপি সমর্থন বেশি লক্ষ করা গেছে।
আঞ্চলিক দিক থেকে আওয়ামী লীগ ঢাকা বিভাগে বেশি জনপ্রিয়। কিন্তু চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে তাদের জনপ্রিয়তা জাতীয় গড়ের চেয়ে কম।
অন্যদিকে বিএনপি রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও সিলেটে বেশি জনপ্রিয়। ঢাকা বিভাগে বিএনপির জনপ্রিয়তা অপেক্ষাকৃত কম। জরিপে দেখা গেছে, জাতীয় পার্টির অবস্থান রংপুরে শক্তিশালী ও বরিশালে দুর্বল।
শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া: প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের আস্থা এ জরিপে ২০১১ সালের তুলনায় সামান্য বেড়ে ৬৫ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে খালেদা জিয়ার ভূমিকার প্রতি মানুষের আস্থা আগের বছরের তুলনায় ৯ শতাংশ কমে ৬৪ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
সরকারের মূল্যায়ন: জরিপে দেখা গেছে, সাধারণভাবে মানুষ সরকারের প্রতি অখুশি। বরাবরের মতো এ বছরও শিক্ষা খাত তার সাফল্যের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রেখে সর্বাধিক মানুষের (৯৩ শতাংশ) সন্তুষ্টি অর্জন করেছে। যোগাযোগ ও অবকাঠামো খাতও এবার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভালো (৫৮ শতাংশ) করেছে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগে মানুষের সন্তুষ্টির হার ২০১১ সালের চেয়ে ৮ শতাংশ বেড়ে ২৯ শতাংশ হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে অসন্তোষের হার এখনো বেশি (৭০ শতাংশ)।
এর বাইরে অন্য গুরুত্বপূর্ণ খাতের ওপর সরকারের উদ্যোগে মানুষ খুশি নয়। এর ফল হিসেবে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা গত চার বছরে ক্রমাগত কমেছে। তবে ২০১১ সালের তুলনায় এবার তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাসের হার কিছুটা কম (৩ শতাংশ)।
সরকারের প্রতি গ্রামের তুলনায় শহরের মানুষের অসন্তুষ্টির পরিমাণ বেশি দেখা গেছে। কৃষি ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে সরকারের কর্মকাণ্ডের প্রতি গ্রামের মানুষের সমর্থন শহরের তুলনায় বেশি ছিল। কৃষি খাত নিয়ে গ্রামের মানুষ সরকারের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। ধান ও পাটের মতো প্রধান ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়াকে এই নেতিবাচক মনোভাবের কারণ হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে।
সরকারি দল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর ওপর মানুষ অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। মানুষ মনে করছে, আওয়ামী লীগ তার দলীয় কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
মন্ত্রীদের হালহকিকত: সরকারের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর কাজের মূল্যায়নে জরিপে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। মন্ত্রীদের মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ধারাবাহিকভাবে মেঘলা আকাশে জ্বলজ্বলে তারকার মতো অবস্থান করে নিয়েছেন। ৯৫ শতাংশ মানুষ শিক্ষামন্ত্রীর কাজে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। নতুন দায়িত্ব পেয়ে অল্প সময়ের মধ্যে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এই তালিকায় দ্রুত দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছেন। তাঁকে সফল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ৬০ শতাংশ মানুষ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিকে ৪০ শতাংশ মানুষ সফল এবং ৩৩ শতাংশ মানুষ ব্যর্থ বলে চিহ্নিত করেছেন। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ৩৯ শতাংশ মানুষ তাঁকে সফল এবং ৫৫ শতাংশ অসফল বলে চিহ্নিত করেছেন।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরকে ৩১ শতাংশ মানুষ সফল বলে মনে করেছেন। তবে ৫৫ শতাংশ মানুষ অর্থমন্ত্রীকে এবং ৩৪ শতাংশ মানুষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অসফল বলে মত দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাফল্য-ব্যর্থতার বিষয়ে ১৭ শতাংশ মানুষ নিশ্চিত নয়। ১৮ শতাংশ মানুষ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি।
নির্বাচন: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তা ও হতাশার আভাস পাওয়া গেছে এই জরিপে। ৭৬ শতাংশ মানুষ মনে করছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না। ৫৯ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দুই দলের মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনা নেই। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সামরিক বাহিনীর সহায়তা দরকার হবে বলে মনে করেছেন ৮৯ শতাংশ মানুষ। বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে কি না, এ প্রশ্নে ৪৯ শতাংশ নেতিবাচক ও ৪৫ শতাংশ মানুষ ইতিবাচক মত দিয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি: দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে কি না, এ ব্যাপারে ইতিবাচক ও নেতিবাচক মত দিয়েছেন যথাক্রমে ৩৯ ও ৩৮ শতাংশ মানুষ। দেশের ৮৪ শতাংশ মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করেছেন। ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করেন, দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমেছে। ইলিয়াস আলীসহ অনেকের গুম ও অপহরণের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্পর্ক নেই বলে মনে করছেন ৫৪ শতাংশ এবং আছে বলে মনে করেন ৩১ শতাংশ মানুষ।
বিচার, দুর্নীতি ও অন্যান্য: বিচার বিভাগের অবনতি হয়েছে বলে ৪০ শতাংশ মানুষ মত দিয়েছেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে মানুষের এমন মনোভাব বাড়ছে। গত চার বছরে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপকে ইতিবাচক মনে করেন না দেশের অধিকাংশ মানুষ। ৪৯ শতাংশ মানুষ বলেছেন, দুর্নীতি আগের চেয়ে বেড়েছে। ২০০৯ সালের জরিপে এমন মত দিয়েছিলেন ৩৪ শতাংশ মানুষ। বর্তমান সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না বলে মনে করছেন ৫৬ শতাংশ উত্তরদাতা।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে সরকারের ওপর মানুষের আস্থা কমেছে। ২০০৯ সালে ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতা আশা করেছিলেন, সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারে যথার্থ পদক্ষেপ নিতে পারবে। ২০১২ সালে এসে এ বিষয়ে মানুষের আস্থা কমে ৪৪ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।
গ্রামীণ ব্যাংক ও মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি সরকারের আচরণে ৬০ শতাংশ মানুষ অসন্তোষ প্রকাশ করেছে; পক্ষান্তরে সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে ২৫ শতাংশ মানুষ। গণমাধ্যমের প্রতি সরকারের আচরণে মানুষের অনাস্থা ক্রমাগত হারে বেড়েছে। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের আচরণ সমর্থন করেননি ৫৩ শতাংশ মানুষ। মাত্র ২৫ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তাঁরা সরকারের আচরণ সমর্থন করেন।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে ভারতের সঙ্গে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক থেকে বাংলাদেশ লাভবান হয়েছে বলে মনে করেন না অধিকাংশ উত্তরদাতা। ৪৯ শতাংশ উত্তরদাতা এমন মত জানিয়েছেন। ৩৮ শতাংশ মানুষ বলেছেন, বাংলাদেশ এ সম্পর্ক থেকে লাভবান হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.