মুশফিকের কিছু পাওয়া

'ছোট্ট একটা ছেলে।' টেলিভিশনে দেখা সমর্থকরা আদর করে কখনও কখনও এমনই বলে থাকেন। এর কারণও আছে যথেষ্ট। ২৪ বছর বয়সেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ছাত্রটি যখন মুচকি হাসেন তখন তাকে নিষ্পাপ স্কুলপড়ূয়ার মতোই দেখায়; কিন্তু হেলমেট মাথায় যখন বোলারকে বাউন্ডারির বাইরে আছড়ে ফেলেন, তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রকাণ্ডদেহী অধিনায়ক ড্যারেন স্যামিও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নেন বাংলাদেশ অধিনায়ককে। মুশফিকের ব্যক্তিত্ব, মেধা, ধৈর্য আর দক্ষতার প্রশংসা করেন দেবেন্দ্র বিশু। 'আমিও হয়তো গড়পড়তা ক্যারিবীয়দের মতো দীর্ঘদেহী নই, মুশফিকও অনেকটা তেমন। কিন্তু মুশফিক দেখিয়ে দিয়েছে শারীরিক উচ্চতাই সবকিছু না।


আপনাদের অধিনায়ক যথেষ্ট ক্ষুরধার বুদ্ধি রাখেন। গোটা সিরিজে তিনি আমাদের যথেষ্ট উদ্বেগে রেখেছিলেন। সেই টি২০ ম্যাচে শেষ ওভারে ছক্কা হাঁকিয়ে শুরু, এরপর শেষ টেস্টেও যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারেননি।' সেদিন আধবেলায় ম্যাচ শেষ হওয়ার পর দূর থেকে মুশফিককে দেখিয়ে এমনই প্রশংসা করে যান বিশু। মাত্র কয়েকদিনের দেখাতেই বিশু মুশফিকের মধ্যে যে অধিনায়কের গুণ দেখতে পেয়েছিলেন, সেটা কিন্তু মুশফিকের জন্য একটা চ্যালেঞ্জই ছিল।
সিরিজে অন্তত সে চ্যালেঞ্জকে কিছুটা সফল করতে পেরেছেন মুশফিক। প্রায় চার বছর পর দলকে টি২০ ম্যাচ জিতিয়েছেন, তাও নিজে শেষ ওভারের এক বল আগে থাকতে ছক্কা হাঁকিয়ে। বিশ্বকাপে বাংলাদেশিদের ৫৮ রানের বদলা নিয়েছেন চট্টগ্রামে ৬১ রানে ক্যারিবীয়দের অল আউট করিয়ে। চট্টগ্রাম টেস্টে দুই ইনিংসে ডিক্লেয়ার করে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাস গড়েছেন।
এক মাস সিরিজে টুকে রাখা নোটখাতাটি খুলে খতিয়ান বের করতে গিয়ে বারবারই মনে হয়েছে, নতুন অধিনায়কের অভিষেকটা এরচেয়ে আর কিইবা ভালো হতে পারত! যেখানে ত্রিশের ওপর রানের গড় থাকা ব্যাটসম্যান হাতেগোনা দু'তিনজন, সেই দলের নেতৃত্ব দিয়ে জয় ছিনিয়ে আনাটা একশ' আটটা নীলপদ্ম খুঁজে আনার মতোই শক্ত। এরপরও নিজে পারফর্ম করে সবার সামনে উদাহরণ দাঁড় করিয়েছেন অধিনায়ক। সিরিজের একমাত্র টি২০ ম্যাচটিতে ৪১ রানে অপরাজিত থেকে দলকে জয়ী করিয়েছেন। ওয়ানডে সিরিজেও বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রান করেছেন অধিনায়ক নিজেই। ৩ ম্যাচে ১০০ রান করেছেন, সর্বোচ্চ ৬৯ রান। এটা এক ধরনের দুঃখের ব্যাপার যে, টপ অর্ডারের কেউই এরচেয়ে বেশি রান করতে পারেননি, অথচ সেটাই ছিল স্বাভাবিক। মুশফিকের পরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮২ রান করেছেন নাঈম ইসলাম। সাকিব ৭৯, নাসির ৫৯ আর তামিম করেছেন ৫৮ রান। ইমরুলের অবস্থা আরও করুণ, তিন ওয়ানডেতে ওপেন করতে নেমে তিনি করেছেন মাত্র ৫৩ রান। কোনো দলের টপ অর্ডারের অবস্থা যখন এমন, তখন সেই দল বিপক্ষকে ৬১ রানে অল আউট করার ঘটনাটা সত্যিই অকল্পনীয়। তবে সেটাই বাস্তবে রূপ পেয়েছে তৃতীয় ওয়ানডেতে বোলারদের কারণে। আরও একটু ছোট করে বললে সাকিবের কারণে। ১৬ রানের খরচায় ৪ উইকেট নিয়েছিলেন সাকিব। নবাগত নাসির হোসেনও সেদিন ২ উইকেট নিয়েছিলেন।
ওয়ানডে সিরিজ চট্টগ্রামে ভালোয় ভালোয় শেষ হওয়ার পর টেস্টে আশরাফুল, কাপালি ও শফিউলকে বাইরে রেখে নতুন একটা চ্যালেঞ্জে নামতে হয় মুশফিককে। যেখানে প্রথম টেস্টেই ইলিয়াস সানিকে অভিষেক ঘটিয়ে বাজিমাত করেন অধিনায়ক। অভিষেক ম্যাচে ৭ উইকেট নিয়ে রেকর্ডও গড়েন সানি; কিন্তু সবাই জানে, দু'দিন কাদাবৃষ্টিতে নষ্ট হওয়ায় আফসোস করে নখ কামড়ানো ছাড়া কিছুই করার ছিল না অধিনায়কের। এরপর ঢাকা টেস্টের আগেই দুটি মেডিকেল বুলেটিন পড়ে আরেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় মুশফিককে। আঙুলে চিড় ধরে রিয়াদের, আর ইলিয়াস সানির পেটের পীড়া! গোটা সিরিজে টস জয়ের পর শেষ টেস্টে এসেই হার। এরপর আর কিছুই অধিনায়কের পরিকল্পনা মতো হয়নি। তারপরও দুই টেস্ট সিরিজে ১৩৯ রান করেছেন মুশফিক। ভালো বলার মতো যথেষ্ট স্কোর এটা নয়, তারপরও যখন তামিম ১৮৬, সাকিব ১৬৮, নাফীস ১০৭, নাঈম ৮৪, নাসির ৭৯ আর ইমরুলের ৬১ রানের তুলনা আসে, তখন বলতেই হয়, মুশফিকের চেষ্টা ছিল কিছু করার। অধিনায়ক মুশফিকের অনবদ্য ব্যাটিং মন কাড়লেও তার কিপিং নিয়ে পুরনো কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। ছোট্ট কাঁধে অধিনায়কত্ব, টপ অর্ডারের ব্যর্থতার দায় সামলানোর পর উইকেটের পেছনে গ্গ্নাভস হাতে মুশফিক নিজেও হয়তো তার পারফরম্যান্স নিয়ে খুশি হবেন না।
এরপরও বাংলাদেশ ক্রিকেটে অধিনায়ক মুশফিকের এ যাত্রা অনেকটাই সফল। মুশফিকের ভাষায়, ' ভালো হয়েছে, তবে আরও ভালো হতে পারত।'

No comments

Powered by Blogger.