আবাসিক সঙ্কটে নেমে যাচ্ছে উচ্চশিক্ষার মান

রাজধানীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আবাসিক সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে উচ্চশিক্ষার মানের ওপর। বিদ্যমান এ সঙ্কট মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট নয় বলে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। শিক্ষানীতির খসড়া নীতিমালায় উচ্চশিক্ষার বিষয়ে বেশ কিছু প্রস্তাব করা হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসন সমস্যা সমাধানের নির্দেশনা নেই। আবাসিক হল পরিচালনায়ও যে পুরনো নীতিমালা রয়েছে, তাও যুগোপযোগী নয়।

এ অবস্থায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন-তা কোনোক্রমেই উচ্চশিক্ষা লাভের অনুকূল থাকছে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আবাসন সুবিধা বাড়েনি। আবাসন সুবিধা রয়েছে-এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নেই পর্যাপ্ত ভবন ও হল। এদিকে সরকারি-বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে কোনো আবাসন সুবিধা গড়ে তোলা হয়নি। এ অবস্থায় 'মেস' কিংবা 'সাবলেটে' ভাড়া দিয়ে থাকছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। অসংখ্য ছাত্রছাত্রী দূরদূরান্ত থেকে অসহনীয় ভোগান্তি সহ্য করে রাজধানীতে এসে ক্লাস করতে গলদঘর্ম হচ্ছে। সব মিলিয়ে তারা পড়াশোনার ন্যূনতম সুযোগ ও পরিবেশ পাচ্ছে না। অধিক চাপ, কায়িক শ্রম এবং মানসিক যাতনা ভোগ করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অনেক শিক্ষকও এরকম দুর্বিষহ সঙ্কট মোকাবিলা করছেন। আবাসিক সঙ্কটের এই ভোগান্তি স্বভাবতই বেশি যাতনাদায়ক হয়ে পড়েছে উচ্চশিক্ষার্থী ছাত্রীদের বেলায়। যারা হলে রয়েছে, তারাও নানা দুর্ভোগ মোকাবিলা করছে। অন্যদিকে যারা দুঃসহ যানজট এবং যানবাহন সঙ্কটের মধ্যে দূরদূরান্ত থেকে রাজধানীতে এসে ক্লাস করছে, তাদের দুঃসহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিদিন। একমাত্র ভুক্তভোগীর পক্ষেই এ যাতনা অনুভব করা সম্ভব। এ অবস্থায় অনেক শিক্ষার্থী লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে দিতেও বাধ্য হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও আবাসিক সঙ্কট নতুন কিছু নয়। হলের প্রতিটি কক্ষে, কমনরুমে, এমনকি মসজিদের মেঝেতেও বিছানা করে থাকতে হচ্ছে অনেক শিক্ষার্থীকে; সেখানেই পড়ালেখা করতে হচ্ছে তাদের। একই অবস্থা বিরাজ করছে আবাসিক ব্যবস্থা রয়েছে-এমন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজগুলোতেও। তিতুমীর কলেজের একটি মাত্র হলের অবস্থা এতই জরাজীর্ণ যে, তাতে পড়াশোনার পরিবেশ নেই বললেই চলে। যদিও সিট ভাড়া বাড়ছে প্রতি বছর। অভিযোগ আছে, এই ঘোরতর আবাসন সঙ্কটের মধ্যেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে থাকা একাধিক হলে দখল নিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ী। এছাড়া প্রায় সব হলেই রয়েছে বহিরাগতদের উপদ্রব। তারা অবৈধভাবে সিট দখল করে বাস করছে। জানা গেছে, দেশের সবচেয়ে বড় মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় ইডেনে প্রায় ২০ হাজার ছাত্রী আবাসিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ভুক্তভোগীদের অনেকের মতে, হলে থাকা বাবদ ছাত্র সংগঠন নেত্রীরা বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে থাকে। ছাত্রাবাসগুলোতেও এ ধারা বিদ্যমান। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে 'মেস'-এর ব্যবস্থা করা হলেও তাতে লেখাপড়ার সহায়ক পরিবেশ অনুপস্থিত। এদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ১ হাজার ৮০৯টি কলেজের সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ; কিন্তু আবাসন ব্যবস্থা তদারকির দায়িত্ব মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের ওপর ন্যস্ত। অথচ হল পরিচালনার জন্য এই অধিদফতর আজও সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করেনি। ফলে আবাসন সঙ্কটের ভোগান্তি বেড়েছে। এই দুঃসহ আবাসন সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারি শিক্ষানীতিতে পরিবর্তন আনা জরুরি। বাস্তবতার ভিত্তিতে নতুন নীতিমালা করার পাশাপাশি নতুন আবাসিক হলের সংখ্যা বাড়ানো, পুরনো হল মেরামত, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে থাকা হল বা ভবন জবরদখলমুক্ত করা এবং বহিরাগতদের হলে অনুপ্রবেশ বন্ধ করার পদক্ষেপ নেয়া আবশ্যক। একইসঙ্গে আবাসিক ব্যবস্থা নেই-এমন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক। সর্বোপরি, রাজধানীর আশপাশে আবাসিক সুবিধাসহ নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ ঢাকা শহর এমনিতেই আবাসিক সঙ্কটে নিমজ্জিত। এদিকে লক্ষ্য রেখেই নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে শিক্ষার মান ধরে রাখা সম্ভব হবে না। এজন্য সবার আগে দরকার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা।

No comments

Powered by Blogger.