গরুর হাট-'বাসায় জায়গা নাই তাই কিনছে না, কাইল থেইকা কিনবো' by এস এম আজাদ

'গরু কিনি রাখবি কই? ঢাকাই তো কারো বাসায় জায়গা নাই, তাই কেউ গরু কিনছে না। দ্যাইখা চইলা যায়। কাইল (শুক্রবার) থেইকা কিনবো।' গরু বিক্রি হচ্ছে কি না জানতে চাইলে এভাবেই জবাব দেন বিক্রেতা মোশারফ হোসেন। তিনি গত বুধবার নাটোর থেকে ১৫টি গরু নিয়ে এসেছেন রাজধানীর আজমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠের হাটে।গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কয়েকটি কোরবানির পশুর হাট ঘুরে বিপুলসংখ্যক গরু দেখা গেছে। তবে জমে ওঠেনি বাজার। বিক্রেতা, ইজারাদার ও ক্রেতারা জানান, রাজধানীর বাসিন্দাদের কোরবানির পশু রাখার জায়গা নেই বলে শেষ সময়েই সবাই হাটে যাবেন।


আজ শুক্রবার থেকে পুরোদমে চালু হবে অস্থায়ী হাটসহ রাজধানীর সবকটি পশুর হাট। সীমান্ত এলাকা ও উত্তরাঞ্চল থেকে আসা গরু বিক্রেতারা অভিযোগ করেন, পথে চাঁদাবাজি ও ডাকাতির ভয়ে তাঁরা উৎকণ্ঠায় আছেন।
এদিকে রাজধানীর পশুর হাটগুলো ঘুরে অনিয়ম ও হয়রানির নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে। শহরের বেশ কিছু পয়েন্টে ইজারা না নিয়েই অবৈধ পশুর হাট বসিয়েছেন প্রভাবশালীরা। ইজারাদাররাও মানছেন না ইজারার শর্ত। নির্ধারিত জায়গা ইজারা নিয়ে বাজার বসাচ্ছেন রাস্তায়, ফুটপাতে। পুলিশ ও ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করলেও এসব অনিয়ম দূর হচ্ছে না।
আজ থেকে জমবে হাট : রাজধানীতে পশুর অস্থায়ী হাট বসানো সংক্রান্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি) বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আজ থেকেই হাট চালুর নির্দেশনা দেওয়া আছে। তবে গত মঙ্গলবার থেকে প্রতিটি পশুর হাটে গরু ও ছাগলসহ কোরবানির পশু এনে জড়ো করতে শুরু করেছেন বিক্রেতারা। ক্রেতারা বাজার ঘুরে দেখে গেলেও কিনেছেন খুব কমই।
গাবতলীর পশুর হাটে বিক্রি কিছুটা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন হাটের হাসিলঘরের কর্মী নজরুল ইসলাম। হাটে গিয়ে গরুর দাম যাচাই করে দেখছিলেন শ্যামলীর বাসিন্দা সোহরাব হোসেন ও মাকসুদুল ইসলাম। তাঁরা জানান, আগারগাঁও গিয়েছিলেন তাঁরা। এবার গাবতলী হাট দেখছেন। গরু কিনবেন শুক্রবার।
বনানী-কাকলী হাটের গরু বিক্রেতা আবদুর রহিম জানান, তিনটি গরু নিয়ে তিনি কুষ্টিয়া থেকে এসেছেন গত মঙ্গলবার। একটিও বিক্রি হয়নি। আজ-কালের মধ্যে বিক্রি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। আগারগাঁও, তালতলা, বনানী, উত্তরার আজমপুর ও গাবতলী হাট ঘুরে গতকাল কিছু গরু বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এদিকে রাজধানীর হাটগুলোয় পর্যাপ্ত গরু আসায় উত্তরাঞ্চল থেকে আনা অনেক গরু সদরঘাট এলাকা দিয়ে অন্যত্র নিয়ে যেতে দেখা গেছে। রাজধানীর বাজারে কম মূল্য পাওয়ার আশঙ্কায় মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় এসব গরু নিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
শর্ত মানছেন না ইজারাদাররা, আছে অবৈধ হাট : ইজারাদাররা ইজারার শর্ত মানছেন না। হাটের জন্য নির্ধারিত এলাকা ছাড়িয়ে বাজার চলে যাচ্ছে ফুটপাতে ও রাস্তায়। বসছে অবৈধ হাট। গত মঙ্গলবার থেকে হাটে বেচাকেনা শুরু করে বিক্রির টাকার ৫ শতাংশ হারে হাসিল আদায় করছেন ইজারাদাররা। অথচ ডিসিসি শুক্র, শনি ও রবিবারের জন্য হাসিলের এই হার নির্ধারণ করেছে।
গাবতলী মূল হাটের বাইরে জায়গা ভাড়া দিয়ে হাট চালু করেছেন বালু ব্যবসায়ীরা। উত্তরার আজমপুরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ ইজারা দেওয়া হলেও আজমপুর থেকে হাউস বিল্ডিং পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে পশু বিক্রেতাদের বসানো হচ্ছে। এতে বুধবার থেকে ৬ নম্বর সেক্টর, ৮ নম্বর সেক্টর, আজমপুর এলাকার বাসিন্দাদের স্বাভাবিক চলাচল এবং কাঁচাবাজারের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে হাট বসানো হয়েছে বাড্ডার নতুন বাজার এলাকায়। বর্ধিত অংশে চাঁদাবাজি করছে বিভিন্ন গ্রুপ। জানা গেছে, এবারের হাটের যাঁরা ইজারা পেয়েছেন তাঁদের বেশির ভাগই সরকারদলীয় নেতা-কর্মী। তাই তাঁদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলতে সাহস পাচ্ছেন না।
উত্তরার আজমপুরে ইজারাদার হাজী সাইদুর রহমান সরকারের প্রতিনিধি এস কে আজম বলেন, ইজারা অনুযায়ীই রাস্তায় হাট বসানো হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, হাজারীবাগ মাঠের পশুর হাটের পাশ দিয়ে গরুবোঝাই কোনো ট্রাক গেলে ওই ট্রাক জোর করে হাটে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। বেড়িবাঁধসহ আশপাশের রাস্তায় সাত-আটটি মাইক্রোবাসে টহল দিয়ে গরুবোঝাই ট্রাক অনেকটা জোর করে হাটে ঢোকানো হয়।
গত বুধবার ডিসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালত গোপীবাগের ব্রাদার্স ইউনিয়নের পাশের বালুর মাঠের হাটে অবৈধ বর্ধিত অংশ গুঁড়িয়ে দেন। গতকাল ওই এলাকায় গিয়ে নির্ধারতি স্থানের বাইরে গরু জড়ো করতে দেখা গেছে। ইজারাদার আবদুল মান্নান বলেন, 'এখানে ইজারা নেওয়া অংশেই হাট বসেছে। কিছু তো বাইরে যাবেই।' গত বুধবার গোলাপবাগ মাঠের পাশে সিটি করপোরেশন আদর্শ স্কুল মাঠ ও আশপাশে ডিসিসির খালি জায়গায় বসানো হাটের পাশে অবৈধ অংশ উচ্ছেদ করেন ডিসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালত। তবে সেখানে গতকালও হাট বসেছে।
পথে চাঁদাবাজি-ডাকাতি : গাবতলীর হাটে গরু নিয়ে এসেছেন বড় ব্যবসায়ী আনোয়ার মণ্ডল। তিনি জানান, তাঁর কাছে ৭০টি বড় গরু আছে। ফরিদপুর থেকে গরু আনার সময় আরিচা ঘাটে পুলিশ ও পুলিশের দালালদের প্রতি ট্রাকের জন্য ৩০০ টাকা করে দিতে হচ্ছে।
কুষ্টিয়া থেকে ১৫টি গরু নিয়ে গাবতলীতে এসেছেন হবিবুর মোল্লা। একটি ষাঁড়ের (পাবনাই সাই করজ) দাম হাঁকছেন আট লাখ টাকা। হবিবুর জানান, আসার পথে চাঁদাবাজির শিকার হননি তিনি। তবে ছিলেন আতঙ্কে। আর এ আতঙ্কের কারণ, চার দিন আগে যমুনা সেতুর এপারে কুষ্টিয়ারই নবী চৌধুরীর গরুবোঝাই ট্রাকসহ পাঁচটি ট্রাকে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। রাস্তায় গাছ ফেলে ট্রাকসহ ৪০টি গরু নিয়ে যায় ডাকাতদল। তবে গত মঙ্গলবার তিনি ঢাকায় আসার সময় ওই এলাকায় র‌্যাবের উপস্থিতি দেখেছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল থেকে ভারতীয় গরুসহ ৪০টি গরু নিয়ে গাবতলী আসেন তোজাম্মল হোসেন। তিনি জানান, নাটোরের বনপাড়া থেকে যমুনা সেতু পর্যন্ত রাস্তায়ও ডাকাতির ঘটনা ঘটে প্রায়ই। গত সোমবার টাঙ্গাইলে একই এলাকার গরু ব্যবসায়ী সেরাজুল বেপারির দুই লাখ টাকা লুট করে ডাকাতদল। গরু ব্যবসায়ীরা জানান, সম্প্রতি ভুয়া র‌্যাব-পুলিশ পরিচয়েও ডাকাতির ঘটনা বেড়েছে।
ভারতীয় গরু আসছে কম : বিক্রেতারা জানান, সীমান্তে ভারতীয় গরুর চালান কমে গেছে। কিছুদিন আগে বিএসএফ ভারতের বহরমপুর শেখপাড়া এলাকায় সীমান্তে ছয় গরু ব্যবসায়ীকে আটকে গাড়িচাপা দিয়ে হত্যা করায় ভয়ে সীমান্তে গরু আনতে কম যান ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সাতক্ষীরার সীমান্ত এলাকা থেকে গরু নিয়ে ঢাকায় আসার সময় সাতক্ষীরা পয়েন্টেই গরুপ্রতি দেড় হাজার টাকা চাঁদা আদায় করে পুলিশ।
ব্যবসায়ীরা জানান, বেনাপোলের পোর্টখালিতে একটি ট্রাক বোঝাই করতে স্থানীয় সিন্ডিকেটকে দুুই হাজার ৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। পথে নবারুন হাটে ট্রাক আটকে বাজার কমিটির নামে আরো ৫০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। ওই রুটের চাঁদাবাজির বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলেও কোনো লাভ হয়নি বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
পুলিশ কর্মকর্তাদের গাড়ি চালকরাও এসে হাত কচলাতে শুরু করেন : 'পুলিশকে সরকারের তরফ থেকে বেতন দেওয়া হলেও তারা যেন গরুর হাটে দায়িত্ব পালনকে অতিরিক্ত দায়িত্বই মনে করে। এ কারণে তাদের প্রতিদিন টাকাও দিতে হয়।' এমন অভিযোগ করলেন রাজধানীর একটি পশুর হাটের একজন পরিচালনাকারী। তিনি জানান, প্রতিদিন টহল পুলিশ ও স্থানীয় থানার পুলিশকে টাকা দিয়ে খুশি রাখতে হয়। তা না হলে পুলিশের টহল পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, 'এমনো হয়, বড় পুলিশ কর্মকর্তাদের গাড়ি চালকরাও এসে হাত কচলাতে শুরু করেন। ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা তাঁদের না দিলে আর যেতে চান না।'
পুরান ঢাকায় হাট পরিচালনাকারী এক কর্মকর্তা বলেন, 'গত বছর হাট শেষ হওয়ার পরও ইন্সপেক্টর পর্যায়ের এক পুলিশ কর্মকর্তা ছয় মাস টাকা নেওয়ার জন্য হাট কমিটির পেছনে ঘুরেছেন, যা দেখে কষ্টই লাগে।'
গতকাল পর্যন্ত গাবতলী ছাড়া অন্যান্য হাটে পুলিশের স্থায়ী ক্যাম্পের কার্যক্রম শুরু হয়নি। উত্তরার আজমপুর হাটে দায়িত্বরত এসআই জব্বারুল হোসেন জানান, তিন দিন ধরে হাটে ডিউটি করছেন তাঁরা। তবে দুটি পুলিশ কমান্ড পোস্ট চালু হবে আজ থেকে।
মোটাতাজাকরণ ওষুধ খাওয়ানো হচ্ছে : রাজধানীর কোনো হাটে গতকাল পশু চিকিৎসক ছিলেন না। গরু ব্যবসায়ীরা নিজেরাই যেন পশু ডাক্তার বনে গেছেন। হাটে গরুকে আকর্ষণীয় করে তুলতে মোটাতাজাকরণ ওষুধ খাওয়াচ্ছেন দেদার। ধূপখোলা মাঠে গরু নিয়ে আসা ব্যবসায়ী মো. হাফিজুর রহমান বলেন, অনেক দূর থেকে গরু নিয়ে আসা হয়েছে। ট্রাকে করে আনায় গরু পরিশ্রান্ত হয়ে যায়। এ কারণে গরুকে 'এফেনাক ভেট' ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়। পরে তাঁর কাছ থেকে ট্যাবলেট নিয়ে দেখা গেছে প্যাকেটের গায়ে একমি কম্পানির নাম লেখা। বারিধারা নতুন বাজারে এক ব্যবসায়ী জানান, তাঁরা গরুকে অ্যান্টাসিড খাইয়ে দেন। কারণ এত দূর থেকে এসে গরুর হজমে সমস্যা হয়।
ডিসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খলিল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেক হাটেই মোটাতাজাকরণ ওষুধ ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে। গতকাল মেরাদিয়া হাট থেকে ভারতীয় বিভিন্ন ধরনের ছোট এক বস্তা ওষুধ জব্দ করা হয়েছে।
খলিল আহমেদ আরো বলেন, হাটে বেশি টাকা হাসিল আদায়, রোগা গরু বিক্রি, ঝুঁকিপূর্ণ ওষুধ ব্যবহার, ইজারার শর্ত ভঙ্গ করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
বৈধ হাট : ডিসিসি সূত্রে জানা যায়, অস্থায়ী পশুর হাটগুলো হচ্ছে আরমানিটোলা খেলার মাঠ, তালতলা বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন খালি জায়গা, হাজারীবাগ মাঠ, আগারগাঁও বস্তির খালি জায়গা, লালবাগের রহমতগঞ্জ খেলার মাঠ, উত্তর শাহজাহানপুর খিলগাঁও রেলগেট বাজারসংলগ্ন মৈত্রী সংঘের মাঠ, উত্তরা আজমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠ, ব্রাদার্স ইউনিয়নসংলগ্ন বালুর মাঠ, মেরাদিয়া বাজার, বনানী-কাকলি (রেলওয়েসংলগ্ন খালি জায়গা), ধূপখোলা ইস্ট অ্যান্ড ক্লাব মাঠ (নতুন), ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট খেলার মাঠ, গোলাপবাগ মাঠের পাশে সিটি করপোরেশন আদর্শ স্কুল মাঠ ও আশপাশের ডিসিসির খালি জায়গা, বনরূপা আবাসিক প্রকল্পের খালি জায়গা, সাদেক হোসেন খোকা খেলার মাঠ, বারিধারা জি ব্লকের মাঠ এবং পোস্তগোলা শ্মশানঘাটসংলগ্ন মাঠ।

No comments

Powered by Blogger.