অর্থনীতিতে এখন জটিল পরিস্থিতি :সিপিডি

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলেছে, দেশের অর্থনীতি চারটি প্রধান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এগুলো হচ্ছে_ বিশ্ব অর্থনীতিতে আরেকটি মন্দার আশঙ্কা, অব্যাহত উচ্চ মূল্যস্ফীতি, সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় চাপ আরও গভীর হওয়া এবং বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে চাপ। গত অর্থবছরে রফতানি বেড়েছিল ৪১ শতাংশের বেশি। কর রাজস্ব আদায়ে ২৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। জনশক্তি রফতানিতে দুরবস্থা কিছুটা কাটিয়েও উঠেছিল। এই তিনটি মূল অর্জনের বিপরীতে চলতি অর্থবছরের শুরুতে অর্থনীতিতে অনেক চাপ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সংস্থাটি বলেছে, চলতি অর্থবছরে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন অনেক কঠিন হবে।


অর্থনীতির সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর সিপিডির এই পর্যালোচনা গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। এ বিষয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে গিয়ে সিপিডির সম্মানিত ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অর্থনীতি একটা জটিল পরিস্থিতির ভেতর ঢুকছে। নীতি নির্ধারকদের এ পরিস্থিতিকে স্বীকৃতি দিতে হবে।
পরিস্থিতি উত্তরণে পরিকল্পনা ঘোষণা করতে হবে। তিনি বলেন, ভর্তুকি যেভাবে বাড়ছে তা ধারণ করার সক্ষমতা বাংলাদেশের অর্থনীতির নেই। ভর্তুকির পরিমাণ যৌক্তিক করা খুবই জরুরি। এ জন্য দরকার গরিবদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রেখে জ্বালানি পণ্যের মূল্য বাড়ানো। ভর্তুকি কমানো অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এটা করতে গিয়ে সরকার যদি জনরোষের মুখোমুখিও হয়, তার পরেও অর্থনীতির স্বার্থে তা করা উচিত।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন সিপিডির গবেষণা বিভাগের প্রধান ড, ফাহমিদা খাতুন, ডায়ালগ ও কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ। সিপিডি সাধারণত জানুয়ারিতে অর্থবছরের প্রথমদিকের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর স্বাধীন পর্যালোচনা করে থাকে। কিন্তু এবার একটু ব্যতিক্রম। এর কারণ হিসেবে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক কিছু বিষয় উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে। এগুলো আলোচনায় আনা এবং নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এবার তারা একটু আগেভাগেই এ পর্যালোচনা করেছেন।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে আরেকটি মন্দার পূর্বাভাস দেখা দিচ্ছে। আগের বারের মন্দার তুলনায় এবার ধাক্কা সামলানো বাংলাদেশের জন্য অনেক কঠিন হবে। কেননা, মন্দা হলে তা উত্তরণে বড় প্যাকেজ ঘোষণার সামর্থ্য কমে গেছে। আগের বারের তুলনায় এখন অনেক বেশি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তিনি বলেন, সরকারের আয়ের তুলনায় ব্যয় অনেক বাড়ছে। বাজেটের ঘাটতি অর্থায়নে সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অনেক বেশি বেশি ঋণ নিচ্ছে। বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহারে অপরিপকস্ফতা রয়ে গেছে। বৈদেশিক সহায়তা ছাড় অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে কমেছে ৫৭ শতাংশ। আরেকটি আশঙ্কার খবর হলো, প্রথম তিন মাসে প্রধান বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি কমে গেছে। অন্যদিকে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। দাতাদের উন্নয়ন ফোরামের বৈঠক পিছিয়ে গেছে। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা এবং আইএমএফের কাছ থেকে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য সহায়তা প্রাপ্তির ব্যাপারে ইতিবাচক অগ্রগতি নেই। এ পরিস্থিতিতে সরকার বিদেশ থেকে উচ্চ সুদে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। সিপিডি মনে করে, সরকারের এ পদক্ষেপ সঠিক নয়।
তিনি বলেন, সরকার যা কর পাচ্ছে তার অর্ধেকের বেশি চলে যাচ্ছে ভর্তুকির পেছনে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি ধরা হয়েছিল সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে নতুনভাবে ভর্তুকির চাহিদা ধরা হয়েছে ৪৭ হাজার ৪শ' কোটি টাকা। কুইক রেন্টাল এবং ব্যক্তিখাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফলে ভর্তুকি আরও বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে হলে গরিব মানুষের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রেখে সরকারকে অবশ্যই জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে হবে। সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে, ভারতের চেয়ে জ্বালানি তেলের দাম যাতে কম না থাকে। জ্বালানি পণ্যের দাম বাড়াতে হবে ধাপে ধাপে এবং পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক বিষয়ে সমঝোতা থাকলে ভর্তুকি কমানোর মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। এসব আলোচনায় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। ভর্তুকি দিয়ে জ্বালানি পণ্যের দাম কমিয়ে রাখলেও মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে ওই টাকা আবার জনগণের পকেট থেকে চলে যাচ্ছে। এ কারণে বিনিয়োগ, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি টেকসই রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
শেয়ারবাজার প্রসঙ্গে ড. দেবপ্রিয় বলেন, একটা ভ্রান্ত নীতির ভিত্তিতে পুঁজিবাজার পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পুঁজিবাজারের কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া শুধু পুঁজি সঞ্চালন করে এটিকে ঠিক করা যাবে না। পুঁজিবাজার তদন্ত কমিটির রিপোর্ট কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কেউ যদি বেআইনি কাজ করে পার পেয়ে যায়, তাহলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যায়। নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রথমত বাংলাদেশে নতুন ব্যাংকের দরকার আছে বলে মনে হয় না। যদি লাইসেন্স দিতেই হয়, তাহলে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার শর্তগুলোর ব্যাপারে ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না।

No comments

Powered by Blogger.