মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানি এবং প্রতারণা by খুরশিদ আহমেদ খান

৭ অক্টোবর পত্রিকান্তরে দেখলাম বানিজ্য মন্ত্রনালয় নাকি ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডসহ ৪৫ টি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি'র নিবন্ধন বাতিল করতে জয়েন্ট স্টক রেজিসট্রারকে নির্দেশ দিয়েছে। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, এরা নাকি "ভুয়া ঠিকানা" এবং "মিথ্যা তথ্য" দিয়ে নিবন্ধন নিয়েছে। অন্য আরেক পত্রিকে দেখলাম, সরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় নাকি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানিগুলোর সম্পর্কে "খোজ-খবর" নিচ্ছে।

রাজশাহী জেলার বাগমারা এবং পঞ্চগর জেলায় ইতিমধ্যেই ডেসটিনি ২০০০ এর বেশ কিছু সংখ্যক প্রতারিত মামলা করেছেন, প্রবাদ সমাবেশ করছেন এবং জেলা প্রশাসক কে স্বারকলিপিও দিচ্ছেন। এই যখন অবস্থা, এবং অনেকেই যখন ডেসটিনি ২০০০ কে নিয়ে শংকা প্রকাশ করছেন, এবং এটিকেও আরেক UNIPAY2U বলে  মনে করছে, তখন অনেক গুলো দৈনিক পত্রিকায় ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড একটি সুচতুর বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজেদের সম্পর্কে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করেছে। ওদের দাবি, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড নাকি কোনো অনিয়ম করছেনা। ভালো কথা! কিন্তু, পর্তিকে ডেসটিনি যে বিজ্ঞাপন প্রচার করলো লাখ-লাখ টাকা খরচ করে, তাতে একটা বিষয় কিন্তু ওরা সুচতুর ভাবে এড়িয়ে গেছে। আর সেটি হলো, সারা দেশে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড-এর ৩৬ লাখের বেশি এজেন্টের মাধ্যমে তথাকথিত "বৃক্ষ রোপন" প্রকল্পের নামে এই প্রতিষ্ঠান হাজার-হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ইতিমধ্যেই, যদিও, গৃহীত অর্থের এক hajar ভাগের এক ভাগ জমিও ডেসটিনি'র নেই। যারা বৃক্ষ রোপন প্রকল্পে মত মুনাফার লোভে বিনিয়োগ করেছেন, তারা ২০১২ থেকেই ক্রমশ মুনাফা অর্জনের কথা। কিন্তু ভুয়া প্রকল্পের নামে সাধারণ মানুষের হাজার-হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড এখন পত্রিকা, টিভি চ্যানেলেই কেবল বিনিয়োগ করেনি বরং অনেক ভুয়া জমি কেনার নামে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের পরিচালকরা কোটি-কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গেছেন। 

কথায় বলে, মুখ নাকি মনের আয়না। ঠিক তেমনিভাবে, একটা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট হলো ওদের আয়না। বেশ কিছু বছর ধরেই, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, মাল্টি লেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম কোম্পানিগুলো লাখ-লাখ মানুষকে বড় অংকের মুনাফার লোভ দেখিয়ে বিলিয়ন-বিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়ে কেটে পড়ছে। বাংলাদেশেও GGN থেকে শুরু কর সাম্প্রতিক সময়ে UNIPAY2U নামক ফটকাবাজ এমএলএম কোম্পানি নিরীহ মানুষদের ঠকিয়ে কোটি-কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে কেটে পড়লো। সরকারদলীয় একজন সংসদ সদস্য UNIPAY2U এর মালিকানায় থাকায় এদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থাও নিলোনা সরকার! আগামী ১-২ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রতারণার ঘটনা ফাঁস হবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। আর যে প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষদের ঠকিয়ে হাজার-হাজার কোটি টাকা নিয়ে কেটে পড়বে, সেটির নাম ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড। আসুন, এই প্রতিষ্ঠানের কিছু অজানা তথ্য আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করি।

কানাডা ফেরত জনৈক মোহাম্মদ রফিকুল আমিন ১৯৯৯ সনে প্রথম GGN নামে একটা এমএলএম কোম্পানি খুলে বসেন। মাত্র দের বছরের মাথায় ওই প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে শটকে  পরে। পরবর্তিতে এই রফিকুল আমিনই আবারও আরেকটি ফটকা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেন - ২০০০ সনেই। নাম, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড। প্রথমেই তার এসব অবৈধ কর্মকান্ডে বাধা আসে। কিন্তু তিনি প্রশাসন এবং মিডিয়া'র কিছু লোককে হাত করে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। এপর্যায়ে তিনি রাজনীতিবিদ ফেরদৌস আহমেদ কোরেশিকেও হাত করেন। শোনা যায়, রফিকুল আমিন, কোরেশী'র স্বল্প প্রচারিত দৈনিক পত্রিকায় ৩ কোটি টাকা দান করেন। প্রথম দিকে যদিও ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড তেমন একটা সুবিধা করতে পারছিলনা, কারণ মানুষের মন থেকে তখনো GGN এর শংকা কাটেনি। কিন্তু ধুরন্দর রফিকুল আমিন, টাকা হাতানোর নতুন ফন্দি আটেন। তিনি "বৃক্ষ রোপন" প্রকল্পের মাধ্যমে, সাধারণ মানুষকে বিরাট লাভের টোপ দেখিয়ে ২০০৬-২০০৯ সময়ে কম করে হলেও আট হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। একাজ করতে তিনি নিয়োগ করেন ছত্রিশ লাখ "দালাল বাহিনী"। ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের ওয়েবসাইটেই এই বিশাল দালাল বাহিনীর কথা শিকার করা হয়েছে। দেখুন ডেসটিনি'র ওয়েবসাইট: www.destiny-2000.com

বর্তমানে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের নাম পাল্টে রাখা হয়েছে, 'ডেসটিনি গ্রুপ'। আর এই ফটকাবাজি প্রতিষ্ঠানের মনোগ্রামটা বসুন্ধরা গ্রুপ-এর মনোগ্রামের হুবহু নকল। ডেসটিনি গ্রুপ এখন দৈনিক ডেসটিনি নামে একটা পত্রিকা চালায়। প্রচার সংখাবিহীন এই পত্রিকাটি হলো এই ফটকাবাজ প্রতিষ্ঠানের রক্ষা বর্ম। প্রতিদিনই পত্রিকাটি অন্তত ৩০-৪০ হাজার টাকা লোকশান দিচ্ছে। ঠিক একইভাবে ধুরন্দর রফিকুল আমিন বৈশাখী টিভি কিনে নিয়েছে ৫০ কোটি টাকায়। এটিও ফটকাবাজ ডেসটিনি'র আরেক রক্ষাকবচ। এই পত্রিকায় সরকার দলীয় একজন সাংবাদিককে মাসিক ৭ লাখ টাকা বেতনে নিয়ক দেয়া হয়েছে, যাতে উনি ডেসটিনিকে যেকোনো আইনি বিপদ থেকে বাচাতে পারেন। ডেসটিনি'র চেয়ারম্যান বানানো হয়েছে সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল হারুনকে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ডেসটিনি তিন কোটি টাকা দান করেছে। কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকেও নিয়মিত মাসোয়ারা দিচ্ছে।  কারণ একটাই - বিপদ থেকে রক্ষা।

ডেসটিনির ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠাতা সহস্যদের ছবি দেয়া থাকলেও, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তারিকুল হুদা সরকারের ছবি নেই। এখানে দেখুন: http://destiny-2000.com/index.php?option=com_content&task=view&id=48&Itemid=80

আরেক জায়গায় ডেসটিনির "হাই অফিসিয়াল"-দের ছবি আছে, যেখানে জনৈক নোয়েল জি কেরি (Noel G. Carey)-এর নাম থাকলেও ছবি নেই। কারণ কি? এখানে দেখুন: http://destiny-2000.com/index.php?option=com_content&task=view&id=52&Itemid=৯২ । ওয়েবসাইটে ওই বিদেশির পরিচয় দেয়া আছে "Overseas Director" হিসেবে।

এবার ফটকাবাজ ডেসটিনির আরো কিছু গোমর। এই লিঙ্কটায় দেখুন: http://destiny-2000.com/index.php?option=com_content&task=view&id=19&Itemid=42 । আপনি দেখবেন Destiny Electric & Electronic Industries Ltd নামক প্রতিষ্ঠানের নাম। কিন্তু বাস্তবে এধরনের কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই নেই। আর ডেসটিনি মাল্টি-পারপাস কপারেটিভ সোসাইটি নামক প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের অনুমোদন ছাড়াই ব্যাঙ্কিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

সবচেয়ে অবাক তথ্য পাবেন একই পৃষ্ঠায় Destiny Tree Plantation Limited and Alysha Destiny Agro Complex Limited নামক দুটি প্রতিষ্ঠানের তথাকথিত বৃক্ষরোপন কার্যক্রমে।  ডেসটিনি দাবি করছে, ওরা নাকি ৬,২৯৩ একর জমিতে চুরান্নব্বই লাখ গাছ লাগিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এসব গাছের কোনো অস্তিত্বই নেই। ডেসটিনি'র ৩৬ লাখ দালালের প্রত্যেকে ৪তি করে গাছ বিক্রি করেছেন। সে হিসেবে প্রতিজনের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে ১৫০০-২০০০ টাকা। অর্থাত, হাজার-হাজার কোটি টাকার প্রতারণা।

Best Air Limited নামে একটা প্রতিষ্ঠান আছে ওই একই জায়গায়। কিন্তু বাস্তবে, এধরনের কোনো বিমান প্রতিষ্ঠানই নেই।  কেবল বারিধারার কাছে শাহজাদপুরে একটা ছোট অফিস ছাড়া। নিরীহ নাগরিকদের কাছে এই অস্তিত্ব বিহীন প্রতিষ্ঠানের শেয়ারও বিক্রি হয়েছে শত-শত কোটি টাকার।

এবার  দেখুন ফটকাবাজ ডেসটিনি'র অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ফিরিস্তি:

Destiny-Hitachi Electric Industries Limited
Destiny Medical College and Hospital LimitedDestiny Media and Publications LimitedDestiny Environment Savings Energy LimitedConfigure Engineers and Construction Company LimitedDestiny Builders LimitedDestiny Tea LimitedDestiny Life Insurance Company Limited (according to Registrar of Joint Stock Companies in Bangladesh, no such company is registered with them. In other words, it is a fake enterprise of Destiny 2000 Group)Configure Housing LimitedBondhishahi Cold Storage Limited
Telebarta Limited (according to Registrar of Joint Stock Companies in Bangladesh, no such company is registered with them. In other words, it is a fake enterprise of Destiny 2000 Group)D2K Express Limited
Destiny Transit Limited


সবশেষে  , ডেসটিনির  ওয়েব সাইটের নিচেই দেখবেন একটা ডিজিটাল ঘড়ি উল্টো দিকে চলছে। বলা হচ্ছে ৫০০ দিনের মধ্যেই নাকি বাংলাদেশ অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন অর্জন করবে। বাটপারি আর কাকে বলে! হাতি-ঘোড়া গেল তল, ভেরা বলে কত জল!

ডেসটিনির মালিক রফিকুল আমিন (যিনি কানাডার নাগরিক) এবং এর পরিচালকদের অধিকাংশই এখন বিদেশে বাড়ি-গাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিনছেন। কারণ, ২০১২-২০১৪ সনের মধ্যেই ডেসটিনি হবে " হাওয়া-হাওয়া" আর বিনিয়োগকারীদের মাথায় পড়বে বাজ! এখনো সময় আছে, ফটকাবাজ এসব প্রতারকদের কবল থেকে রক্ষা পাবার। সরকার যদি এখনি ডেসটিনি ২০০০ সহ অন্যান্য মাল্টি লেভেল মার্কেটিং কোম্পানির বিষয়ে খোজ-খবর নেয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের হাজার-হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাহলে নিশ্চই কয়েক লাখ মানুষ চূড়ান্ত প্রতারণার হাথ থেকে বাচবেন। অন্যথায়, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের পরিচালকরা যদি গোপনে বিদেশে কেটে পরেন, তাহলে বিশাল এক জনগোষ্ঠির ভয়াবহ বিপদের জন্য সরকারকেও অপরাধী হতে হবে।

---
খুরশিদ আহমেদ খান
৯০০ বলিরপাড়া, সড়ক ১৭,
আগ্রাবাদ সিডিএ
চট্টগ্রাম

No comments

Powered by Blogger.