আইন-শৃঙ্খলা কি ভেঙে পড়েছেঃ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে নারী নির্যাতন

খন দেশ শাসন করছে নারী নেতৃত্ব। প্রধানমন্ত্রী ও শাসক দলের সভাপতি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের উপনেতা সবাই নারী। বিরোধী দলের নেতা এবং দু'দু'বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীও নারী। এসবই তৃতীয় বিশ্বের এই দেশে নারীর ক্ষমতায়নের দৃষ্টান্ত হতে পারত, কিন্তু হয়নি। এর বড় প্রমাণ, দেশে নারী নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান ঘটনা।

এক বেসরকারি হিসাবে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর, আওয়ামী মহাজোট সরকারের ৯ মাসে দেশে ৩৩৮ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১৫৮ নারী ও ১৮০ মেয়েশিশু। ১৫৮ জন নারীর মধ্যে ৫০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ৬৮ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আর ১৮০ মেয়েশিশুর মধ্যে ২২ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা এবং ৫১ শিশু গণধর্ষণের কবলে পড়েছে। প্রতিদিন একাধিক এ ধরনের পৈশাচিক ঘটনার কথা পত্র পত্রিকায় ছাপা হলেও প্রকৃত ঘটনার সংখ্যা যে আরও অনেক বেশি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিদ্যমান সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা চেপে রাখার পক্ষেই কাজ করে। এজন্য রাজনৈতিক কারণও কম দায়ী নয়। সমাজের প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা যখন এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকে তখন ভুক্তভোগীরা আইনের আশ্রয় থেকেও বঞ্চিত হন। ক্ষমতার দাপট আর বিকৃত মানসিকতার প্রমাণ মেলে পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি ঘটনা থেকে। ১ সেপ্টেম্বর যশোরে দশম শ্রেণীর এক মুসলমান ছাত্রীকে সিঁদুর পরিয়ে ধর্ষণ করে যে শিশির ঘোষ, সে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত। ২৫ সেপ্টেম্বর পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় পূজামন্ডপ থেকে ফেরার পথে এক কিশোরীকে অপহরণ ও পালা করে ধর্ষণ করে ছাত্রলীগের ১০ কর্মী। ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকার সদরঘাটে ফাঁকা লঞ্চে ডেকে নিয়ে গণধর্ষণ করা হয় ১১ বছরের এক ভিক্ষুক কিশোরীকে। পিরোজপুরের এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের সময় জেলা ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক বন্ধুদের দিয়ে ভিডিও চিত্র ধারণ করে এবং সেই সিডি বাজারজাত করে। এ ধরনের বিকৃত ও পাশবিক ঘটনা এখন পত্রিকার পাতার নিয়মিত খবর। কোথায় চলেছি আমরা-এ প্রশ্ন মনেই সীমাবদ্ধ থাকে। ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কের কারণে ধর্ষকের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে এগিয়ে আসতে মানুষ ভরসা পায় না। একই কারণে সম্ভবত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরাও বিষয়গুলো ধামাচাপা দিতে সচেষ্ট। ভেবে অবাক হতে হয়, ১৯৯৬ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও নারী নির্যাতনের ঘটনা আলোড়ন তুলেছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জনৈক ছাত্রলীগ নেতা ধর্ষণের সেঞ্চুরি উৎসব করেও শাস্তি নয়, পুরস্কৃত হয়েছে। তাকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দেয়া হয়েছে। এ ধরনের দৃষ্টান্ত যদি নতুন করে কাউকে উৎসাহিত করে, তবে সে অপরাধের জন্য শুধু তাকেই নয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও দায়ী হতে হবে। কিন্তু দিনবদলের বর্তমান সরকার এ ধরনের কিছু করতে পারেনি। অপরাধীদের আটক করে বিচারের মুখোমুখি করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের ব্যর্থতার দায়ভার বইতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী এ বছরের জানুয়ারি মাসে ১৬ নারী ও শিশু ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ৮ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করে হয় আর ৬ জন গণধর্ষণের শিকার হন। পরের মাস ফেব্রুয়ারিতে নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার বেড়ে দাঁড়ায় ২৬ জনে। আর মার্চ মাসে এ সংখ্যা আরও বেড়ে হয় ৪৫। শুরুতেই ধর্ষক ও নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে এভাবে ক্রমবর্ধমান হারে নারী ও শিশুদের পাশবিকতার শিকার হতে হতো না। সরকার যুদ্ধাপরাধসহ অতীত অপরাধ নিয়ে যতটা ব্যস্ত, বর্তমান অপরাধ নিয়ে কেন এমন নিষ্ক্রিয়, সেটা বোধগম্য নয়। তবে সরকারের চরম ব্যর্থতার পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কার্যকর ভূমিকাও চোখে পড়ে না। উদ্বেগ প্রকাশ ছাড়া বেশিরভাগ সংগঠনের নিষ্ক্রিয়তা সত্যি বিস্ময়কর। ১৯৯৪ সালে দিনাজপুরে ইয়াসমীন ধর্ষণ ও হত্যাকান্ড নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, এখন কেন তা হচ্ছে না, সে প্রশ্নের জবাব নেই। এর পেছনে কি শুধু মূল্যবোধের অবক্ষয় বৃদ্ধি, না অন্য আরও কারণ আছে, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়। বর্তমানে ধর্ষকদের রাজনৈতিক পরিচয় কি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো অন্যদেরও দায়িত্ব পালনে নিরুৎসাহিত করছে? প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীদের অবস্থানও যখন নারী নির্যাতন বন্ধে বিন্দুমাত্র ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে না তখন বলতেই হয়, আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়া ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়াও ত্বরান্বিত হবে। এখনই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আমলে না নিলে পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। ক্রসফায়ারের নামে ক্রমবর্ধমান বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড তেমনই ইঙ্গিত দেয়।

No comments

Powered by Blogger.