ডিএসইতে ৪০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন

দের আগের শেষ লেনদেন দিবসে শেয়ারবাজারে লেনদেনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ধস নেমেছে। গতকাল দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন হয়েছে মাত্র ১৮১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। গত ৪০ মাসের মধ্যে এটিই ডিএসইতে সর্বনিম্ন লেনদেন। এর আগে ২০০৮ সালের ৯ জুলাই ডিএসইতে সর্বনিম্ন ১৩০ কোটি ৯২ লাখ টাকার লেনদেন হয়েছিল। চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি ৬৮ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। তবে সূচকের অস্বাভাবিক পতনের কারণে ওইদিন ৫ মিনিটের মাথায় লেনদেন স্থগিত হয়ে গিয়েছিল।


ডিএসইর ইতিহাসে একদিনে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ২৪৯ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। গত বছর ৫ ডিসেম্বরে লেনদেনের এ রেকর্ড হয়। কিন্তু এক বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে ডিএসইর লেনদেন ২০০ কোটি টাকার নিচে নেমে এসেছে। ২০০৮ সালের তুলনায় শেয়ারাবাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে তালিকাভুক্তির সংখ্যা। বর্তমান বাজারের গভীরতা অনুযায়ী, দৈনিক এক হাজার কোটি টাকার লেনদেন হওয়া উচিত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কিন্তু বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে না আসায় লেনদেনের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঈদুল আজহার কারণে অনেক বিনিয়োগকারী বাজারে সক্রিয় না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপারে ডিএসইর সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমেদ খান বলেন, ঈদুল আজহার কারণে বিনিয়োগকারীদের টাকা অন্যদিকে যাচ্ছে। কোরবানি দেয়ার জন্য তারা টাকা ব্যবহার করছেন। এর ফলে লেনদেন কম হয়েছে। এছাড়া বেশ কিছুদিন ধরে ব্যাংকগুলো বাজারে যে সাপোর্ট দিচ্ছিল ঈদের আগে তাদেরও টাকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সেটিও করতে পারেনি। এ দুটি কারণে লেনদেনের পরিমাণ কমে গেছে। ঈদের পর বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়লে লেনদেন আবার বেড়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসইর) সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও অ্যালিয়েন্স ক্যাপিটাল আসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়ালি উল মারুফ মতিন বলেন, বিনিয়োগকারীদের বাজারে অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার কারণে লেনদেনের পরিমাণ কমেছে। গত কয়েকদিন ধরে দেখা গেছে, বাজার কিছুটা পতনমুখী হলে এক ধরনের সপোর্ট দেয়া হতো। কিন্তু গতকাল সে সাপোর্ট ছিল না। তবে ঈদের পর বাজারে গতি ফিরে আসবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি আরও বলেন, শেয়ারবাজার এখন বিনিয়োগের জন্য খুবই অনুকূল। অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দর যে কোনো সময়ের চেয়ে সর্বনিম্নে রয়েছে। এ অবস্থায় বাজারে বিনিয়োগ না বাড়ার কোনো কারণ নেই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্যাংকের ব্রোকারেজ হাউসের নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর নতুন করে বিনিয়োগের ক্ষমতা নেই। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও তহবিল সঙ্কটে ভুগছে। তহবিলের অভাবে মার্জিন লোন দেয়াও বন্ধ হয়ে গেছে। বেশিরভাগ মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলোর প্রায় একই অবস্থা বলে জানান তিনি। বর্তমানে শেয়ারবাজার বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আকর্ষণীয় হলে কি হবে, অর্থ না থাকায় কেউ বিনিয়োগ করছে না।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, গত ডিসেম্বর মাসে শেয়ারবাজারে বিপর্যয়ের পর লেনদেনের পরিমাণ কমতে থাকে। দেখা দেয় তীব্র তারল্য সঙ্কট। তারল্য প্রবাহ বাড়াতে ৫ হাজার কোটি টাকার বাংলাদেশ ফান্ড গঠনের উদ্যোগ নেয় আইসিবি। বাংলাদেশ ফান্ড গঠিত হলে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসার পাশাপাশি তারল্য প্রবাহ বাড়বে বলে আইসিবি’র পক্ষ থেকে আশাবাদ ব্যক্ত করা হলেও বাস্তবে তার প্রভাব বাজারে পড়েনি। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। নানামুখী চাপের বাজেটে শেয়ারাবাজারে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয়। কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত সে সুযোগ কেউ নেয়নি বলে এনবিআর চেয়ারম্যান জানিয়েছেন। কালোটাকা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এনবিআরের পক্ষ থেকে কোনো প্রশ্ন করা না হলেও দুদক বা সরকারি অন্য কোনো সংস্থা প্রশ্ন করতে পারবে—অর্থমন্ত্রীর এমন ঘোষণার কারণে কালোটাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হয়নি বলে অনেকে মনে করেন। তবে সম্প্রতি এসইসি চেয়ারম্যান কালোটাকা বিনিয়োগ করা হলে দুদক বা কোনো সংস্থার পক্ষ থেকে টাকার উত্স সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না বলে জানিয়েছেন। কিন্তু এতেও বাজারে কালোটাকা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো গতি আসেনি।
ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের বিষয়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে বলেন, ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করবে কি করবে না, এটি ব্যাংকের নিজস্ব বিষয়। এটি ঘোষণা দেয়ার কিছু নেই। বাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যাংকগুলো তার নিজস্ব ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনা করবে। যদি কেউ মনে করে, বাজার বিনিয়োগের অনুকূল তাহলে সে এখানে বিনিয়োগ করবে নচেত্ করবে না। ব্যাংকের বিনিয়োগের ঘোষণার ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আবারও ক্ষতির মুখে পড়েছেন বলে মনে করেন তিনি।
বাজার পরিস্থিতি : এদিকে গতকাল সূচকের নিম্নমুখী প্রবণতার মধ্যে ডিএসইতে লেনদেন শুরু হয়। পাঁচ মিনিটের মাথায় সূচক ২৮ পয়েন্ট কমে যায়। আর সাড়ে ১১টায় সূচক কমেছিল ৩৮ পয়েন্ট। এর পর বেশ কয়েকবার ওঠানামা করে সূচক। দিন শেষে ডিএসইর সাধারণ মূল্যসূচক দশমিক ৪৪ পয়েন্ট কমে ৫,২০৮ দশমিক ৯৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এদিন ডিএসইতে ২৪২টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ১০৮টির দাম বেড়েছে, কমেছে ১২০টির আর অপরিবর্তিত রয়েছে ১৪টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম। ডিএসই’র বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকায়।
অন্যদিক চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক মূল্যসূচক ৬৭ দশমিক ৭৪ পয়েন্ট কমে ১৪৭৭৫ দশমিক ৫৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। সিএসইতে লেনদেন হওয়া ১৫৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দাম বেড়েছে ৭৯টির, কমেছে ৬১টির আর অপরিবর্তিত রয়েছে ১৬টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম। স্টক এক্সচেঞ্জটিতে ২২ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। ডিএসইতে লেনদেনের শীর্ষে থাকা ১০টি প্রতিষ্ঠান হলো—বেক্সিমকো, গ্রামীণফোন, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ইউসিবিএল, এনবিএল, এমআই সিমেন্ট, ঢাকা ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক ও সিটি ব্যাংক।
নয় দিনের ছুটি শুরু : সাপ্তাহিক ও ঈদুল আজহার ছুটি মিলিয়ে পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ থাকবে টানা নয় দিন। আজ থেকে এ ছুটি শুরু হবে। ছুটি শেষে আগামী ১৩ নভেম্ব থেকে ডিএসইতে আবার লেনদেন শুরু হবে।

No comments

Powered by Blogger.