মন্ত্রীর ভাইসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা, একজন ছাড়া বাকিরা আ.লীগের by সেলিম জাহিদ, সুমন মোল্লা ও মনিরুজ্জামান

রসিংদীর মেয়র ও আওয়ামী লীগের নেতা লোকমান হোসেন হত্যার ঘটনায় ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ছোট ভাইসহ ১৪ জনকে আসামি করে থানায় মামলা হয়েছে। লোকমানের ভাই কামরুজ্জামান ওরফে কামরুল গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় নরসিংদী সদর থানায় মামলাটি করেন। মামলার আসামিদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকিরা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং স্থানীয় সাংসদ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ঘনিষ্ঠ বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।

মামলার আসামিরা হলেন: মন্ত্রীর ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, দলের জেলা শাখার সহসভাপতি আবদুল মতিন সরকার, দলের শহর কমিটির সাবেক কোষাধ্যক্ষ মোবারক হোসেন ওরফে মোবা, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোন্তাজউদ্দীন ভূঁইয়া, বিএনপির সদর থানা শাখার সভাপতি নুরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগ-সমর্থক ও ব্যবসায়ী মনোয়ার হোসেন, হিরন মিয়া, নরসিংদী কলেজের ছাত্র সংসদের সাবেক সহসভাপতি (ভিপি) তারেক আহমেদ, টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর একান্ত সহকারী (এপিএস) মাসুদুর রহমান মুরাদ, আওয়ামী লীগ-সমর্থক কবির সরকার, শহর যুবলীগের সভাপতি আশরাফ হোসেন সরকার, নরসিংদী কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি মিয়া মো. মনজুর, আমির হোসেন আমু ও মামুন।
আসামিদের মধ্যে মামুন হলেন সাবেক পৌর কমিশনার মানিকের ছেলে। আর হিরন মিয়া ও আমির হোসেন মানিকের ভাই। মানিক বিগত আওয়ামী লীগ সরকার (১৯৯৬-২০০১) আমলে খুন হন।
মামলা এজাহারে অভিযোগ করা হয়, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা মেয়র লোকমানের উত্থানে ঈর্ষান্বিত হয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেন। জেলা আওয়ামী লীগের আসন্ন সম্মেলনকে কেন্দ্র করে লোকমান সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী হিসেবে প্রচার চালাচ্ছিলেন। একই পদের জন্য মন্ত্রীর ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রচার চালাচ্ছিলেন। জনসমর্থন না পেয়ে সালাহউদ্দিন কিছুদিন ধরে লোকমানকে টেলিফোনে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আসছিলেন। এ ছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুল মতিন সরকার গত পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে লোকমানের কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। মতিন এর পর থেকে লোকমানকে হুমকি দিয়ে আসছিলেন। পরিবারের সদস্য ও হিতাকাঙ্ক্ষীদের লোকমান বিষয়টি জানিয়েছিলেন।
এজাহারে আরও বলা হয়, আসামি আশরাফ হোসেন সরকার, মিয়া মো. মনজুর, আমির হোসেন ও মামুন আরও সাত-আটজন অজ্ঞাতনামা আসামি আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মেয়র লোকমানের ওপর আক্রমণ করে। এর মধ্যে আশরাফ হোসেন প্রথমে লোকমানের বুকে গুলি করেন। তারপর মিয়া মো. মনজুর, আমির হোসেন ও মামুন যথাক্রমে গুলি করেন।
রাতে এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে মন্ত্রীর ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদের মোবাইল ফোনে কয়েক দফায় কল করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। এরপর ফোনে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠানো হলে তিনি ফোন বন্ধ করে দেন।
আবদুল মতিন সরকার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁকে কেন এই মামলায় আসামি করা হয়েছে, তা তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি দাবি করেন, ‘আমি এক মাস আগে লন্ডন থেকে আসার পর অসুস্থ। আর লোকমানের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। কয়েক মাস আগে সে আমার কাছ থেকে পৌরসভার জন্য ছয় বিঘা জমিও নেয়। তার বাড়িতে আমার যাতায়াতও ছিল।’
মামলা নিয়ে গড়িমসি: প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল রাত ১০টা ২০ মিনিটে মামলার এজাহার নিয়ে বাদী কামরুজ্জামান আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের শতাধিক নেতা-কর্মীসহ থানায় যান। তখন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন নিজ কক্ষে ছিলেন না। ১০টা ৫৫ মিনিটে তিনি কক্ষে এসে এজাহারটি গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি ঊর্ধ্বতন কাউকে মোবাইল ফোনে এজাহার ও আসামিদের নাম পড়ে শোনান। ওসি এজাহার গ্রহণ করলেও তা মামলা হিসেবে নথিবদ্ধ বা মামলার নম্বর দেননি। এ পর্যায়ে বাদীসহ উপস্থিত নেতা-কর্মীরা মামলার নম্বর না দিলে থানায় অবস্থানের ঘোষণা দেন। তখন ওসি এজাহারটি নিয়ে থানার বাইরে কোথাও যান। রাত ১১টা ৪২ মিনিটে ওসি আবার থানায় ফিরে এসে বাদীকে মামলার নম্বর জানান (নং-৬) এবং এজাহারের পাশে ৩০২/৩৪ ধারা লেখেন। এরপর ওসি টেলিফোনে আবার কারও সঙ্গে আলাপ করেন। রাত ১২টায় ওসি আগের ধারার সঙ্গে ১০৯ ধারা যুক্ত করে মামলাটি নথিবদ্ধ করেন।
হত্যার নেপথ্যে কারা: দুই দিন পার হলেও লোকমান হত্যার নেপথ্যে কে বা কারা আছে, সে সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য দিতে পারেনি পুলিশ।
নিহতের স্বজন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের একাংশ লোকমান হত্যার জন্য দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ ও তাঁর ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদকে ইঙ্গিত করে যেসব বক্তব্য দিয়েছে, তা আমলে নিয়ে পুলিশ কোনো তৎপরতা চালাচ্ছে কি না, সে ব্যাপারেও স্থানীয় কর্মকর্তারা কিছু বলতে রাজি হননি।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিজয় বসাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা হত্যাকাণ্ডের পেছনে ১৭-১৮টি ইকুয়েশন মাথায় রেখে কাজ করছি।’ তিনি বলেন, মনে হচ্ছে, খুনিকে বাইরে থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মেয়র লোকমান (৪২) শহরে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে দলীয় কিছু সমর্থক নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন। সাড়ে সাতটার দিকে সন্ত্রাসীরা কার্যালয়ের ভেতরে ঢুকে অতর্কিতে লোকমানকে গুলি করে।
গতকাল বিকেলে পুলিশ সুপার মো. আক্কাছ উদ্দিন ভূঞা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে বিভিন্ন কনসিডারেশন মাথায় রেখে কাজ হচ্ছে। বিষয়টি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে।’
জেলা ছাত্রলীগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা দাবি করেন, মেয়র লোকমান হত্যার ব্যাপারে তাঁরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন। মঙ্গলবার রাতে ঘটনার আগে স্থানীয় ছাত্রলীগের এক নেতা টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে মুঠোফোনে কিছু ইঙ্গিতবহ কথা বলেন। ছাত্রলীগের আরেক নেতা পাশ থেকে ওই কথোপকথনের কিছু অংশ শুনেছেন। ছাত্রলীগের ওই নেতার মুঠোফোন নম্বরসহ ঘটনাটি পুলিশকে জানানো হয়েছে বলেও দাবি করেন ওই নেতা।
আজ বিক্ষোভ সমাবেশ: লোকমান হত্যার প্রতিবাদে আজ শুক্রবার বেলা তিনটায় বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি পালন করবে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগ। শহরে পশ্চিম কান্দাপাড়ায় দলের জেলা কার্যালয়ের সামনে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
গতকাল আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা কালো ব্যাজ ধারণ করে শোক পালন করেছেন। নরসিংদী পৌরসভাসহ পৌর এলাকার বিভিন্ন বাড়িঘর ও প্রতিষ্ঠানেও কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। লোকমান হোসেনের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে দেশের ৩১১টি পৌরসভায়ও কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। লোকমান হোসেন মিউনিসিপ্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগীয় সভাপতি ছিলেন।
নরসিংদী পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মেয়র হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে বিকেল সাড়ে তিনটায় পৌরসভার সামনের সড়কে মানববন্ধন করেন।
এদিকে বিকেলে শহরের সাটিরপাড়া কালীকুমার বিদ্যালয় মাঠে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন স্থানীয় তাঁতশিল্পের শ্রমিকেরা। লোকমান হোসেন বাংলাদেশ পাওয়ার লুম অ্যাসোসিয়েশনেরও সভাপতি ছিলেন।
রাজিউদ্দিন রাজুর বিবৃতি: গতকাল এক বিবৃতিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু মেয়র লোকমান হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন এবং ষড়যন্ত্রকারীদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত বিচারের জন্য সবার সহযোগিতা কামনা করেছেন। তিনি বলেন, লোকমান হোসেনের হত্যাকাণ্ড আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অশুভ শক্তির গভীর ষড়যন্ত্র।
রাজিউদ্দিন আহমেদ অভিযোগ করেন, প্রকৃত হত্যাকারীদের আড়াল করতে একটি চিহ্নিত মহল ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। তারা অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে।
জেনেভায় আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের সম্মেলনে যোগদান শেষে দেশে ফেরার সময় গতকাল এই বিবৃতি দেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী।
মন্ত্রী বলেন, লোকমান ছিলেন নরসিংদীর গণমানুষের প্রাণপ্রিয় এক নেতা। দুষ্কৃতকারীদের হাতে তাঁর এ অকালপ্রয়াণ কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না। মন্ত্রী মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা ও তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। মন্ত্রী এ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দেন।
খায়রুল কবিরের রিমান্ড চেয়েছে পুলিশ: লোকমান হত্যার পর ওই রাতেই ঢাকার বাসা থেকে নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সাংসদ খায়রুল কবির খোকনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরদিন তাঁকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।
খায়রুল কবিরকে গতকাল আদালতে হাজির করে পুলিশ তাঁকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে। আদালত রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেননি।
আদালতের বারান্দায় খায়রুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, লোকমানের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের সময় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, পুলিশ তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করেনি।’

No comments

Powered by Blogger.