লোকমান হত্যাকাণ্ড-খুনি ও নির্দেশদাতা অত্যন্ত প্রভাবশালী by শাহেদ চৌধুরী ও প্রীতিরঞ্জন সাহা

রসিংদী শহরে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। সর্বত্র স্বজন হারানোর শোকে কাতর মানুষজনের আহাজারি চলছে। তবে শহরের পরিবেশ আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। একটানা দু'দিন বন্ধ থাকার পর গতকাল বৃহস্পতিবার শহরের দোকানপাট, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালত খুলেছে। কোথাও অপ্রিয় কোনো ঘটনা ঘটেনি।এদিকে নরসিংদীর মাটি-মানুষের প্রিয় নেতা শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও নরসিংদী পৌরসভার দু'দফায় নির্বাচিত মেয়র আলহাজ লোকমান হোসেন হত্যার ব্যাপারে গতকাল রাত পৌনে ৯টা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।


লোকমান হোসেনের ছোট ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি কামরুজ্জামান কামরুল জানান, তারা মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে লোকমান হোসেন হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে গ্রেফতারকৃত জেলা বিএনপি সভাপতি খায়রুল কবীর খোকনকে জামিন না দিয়ে নরসিংদী কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ তাকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন
করলেও আদালত তা নামঞ্জুর করে আগামী ৯ নভেম্বর শুনানির দিন ধার্য করেছেন।
লোকমান হোসেনের খুনিদের গ্রেফতার ও হত্যাকা ের পরিকল্পনাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে গতকাল নরসিংদী এবং মাধবদী পৌরসভায় প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। সমাবেশে কয়েকজন বক্তা বলেন, এ খুনের মদদদাতারা অত্যন্ত প্রভাবশালী। শহরের প্রায় প্রতিটি বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে শোকের প্রতীক কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। শোকাহত মানুষজন কালো ব্যাজ ধারণের মাধ্যমে তাদের প্রিয় নেতাকে স্মরণ করছে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, লোকমান হোসেনের প্রিয় সংগঠন স্থানীয় বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের শীর্ষে কালো পতাকা উড়তে দেখা যায়নি। অথচ মঙ্গলবার রাত ৮টা ১০ মিনিটের দিকে এ কার্যালয়েই নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীর গুলিতে নিহত হন লোকমান হোসেন। বর্তমানে কার্যালয়টি বন্ধ।
বুধবার মেয়র অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বানে বৃহস্পতিবার দেশের ৩১১টি পৌরসভায় কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ এবং বিকেল ৪টা থেকে ৫টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করা হয়। লোকমান হোসেনের কর্মস্থল নরসিংদী পৌরসভা কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন করেছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও পৌর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
জেলা আওয়ামী লীগের ডাকে আজও কালো পতাকা উত্তোলন এবং কালো ব্যাজ ধারণের কর্মসূচি রয়েছে। আজ সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মিলাদ মাহফিল, বিশেষ দোয়া, বাদ জুমা জেলার সব মসজিদে মিলাদ ও মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা করা হবে। বিকেল ৪টায় জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
মামলা হয়নি : নরসিংদীর পুলিশ সুপার ড. আক্কাছ উদ্দিন ভূঁইয়া গতকাল রাত সোয়া ৭টায় জানান, মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকা ের বিষয়ে এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি। হত্যাকারীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এ হত্যাকা ে জড়িত সন্দেহে এরই মধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এদিকে লোকমান হোসেন হত্যাকা ের পর তিনদিন পেরিয়ে গেলেও গতকাল পর্যন্ত এর রহস্য উন্মোচিত হয়নি। এ নির্মম হত্যাকা ের কোনো কারণও জানা যায়নি। হত্যাকা ে জড়িত সন্দেহে নরসিংদী জেলা বিএনপি সভাপতি খায়রুল কবীর খোকনসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করা হলেও এ নিয়ে এখানকার জনমনে বিভ্রান্তি রয়েছে। কম-বেশি সবাই তাদের গ্রেফতারের ঘটনাকে রাজনৈতিক হিসেবে মূল্যায়ন করছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও লোকমান হোসেনের আত্মীয়স্বজন এ হত্যাকা ের পেছনে আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতা কলকাঠি নেড়েছেন বলে প্রকাশ্যে অভিযোগ করেন।
বিএনপি নেতা খোকনের জামিন নামঞ্জুর : আলহাজ লোকমান হোসেন হত্যাকা ে জড়িত সন্দেহে মঙ্গলবার রাতে ঢাকার খিলগাঁওয়ের বাসা থেকে গ্রেফতার করা খায়রুল কবীর খোকনের জামিন নাকচ করা হয়েছে। তাকে নরসিংদী জেলা কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রেফতারকৃত অন্য পাঁচজন জাহেদুল ইসলাম, তৌহিদ সরকার, সঞ্জীব দাস, সোহেল ও সাজ্জাদ হোসেন নরসিংদী জেলা কারাগারে রয়েছেন।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে খায়রুল কবীর খোকনকে কড়া পুলিশ পাহারায় নরসিংদীর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আশিকুল খবীরের আদালতে আনা হলে বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা ভিড় জমায়। এ সময় আদালত প্রাঙ্গণে প্রবেশ ছিল সীমিত। খোকনের জামিন নামঞ্জুর হয়। পুলিশ তাকে পাঁচদিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করলেও আদালত তা মঞ্জুর না করে ৯ নভেম্বর শুনানির দিন ধার্য করেন।
'কে, কারা খুন করেছে তা আমরা জানি' : নরসিংদীর প্রয়াত মেয়র আলহাজ লোকমান হোসেনের মা মাজেদা বেগম, স্ত্রী বুগলি বেগম, চার ভাই কামরুজ্জামান কামরুল, খলিল, শাহীন, শামীম নেওয়াজ, তিন বোন রুবি, রোজি ও রেমি এক বাক্যে বলেছেন, 'কে, কারা লোকমান হোসেনকে খুন করেছে এবং খুন করিয়েছে, তা আমরা জানি।'
তারা বুধবার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, তথ্য সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন, উপ-প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট মোল্লা মোহাম্মদ আবু কাউসার ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমের কাছে এ তথ্য দিয়েছেন। জানাজায় অংশগ্রহণের পর আওয়ামী লীগ নেতারা লোকমান হোসেনের বাড়িতে যান।
ওই সময় লোকমান হোসেনের বাড়িতে উপস্থিত ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস এসএম কাইয়ুম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে মেয়র লোকমান হোসেনের পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তারা বলেন, লোকমান হোসেন হত্যার বিচারের দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
এসএম কাইয়ুম জানান, আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলার সময় লোকমান হোসেনের আত্মীয়স্বজন ন্যায়বিচার নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে তারা খুনের নির্দেশদাতা ও পরিকল্পনাকারীদের খুঁজে বের করার দাবি জানান। তারা বলেন, খুনি ও নির্দেশদাতারা প্রভাবশালী। তারা শক্তিমান রাজনৈতিক নেতা।
এ সময় আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের নাম জানতে চাইলে লোকমান হোসেনের পরিবারের সদস্যরা সাত থেকে আটজনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের দু'জন নেতার নাম উল্লেখ করেন। আওয়ামী লীগ নেতারা খুনি এবং খুনের সঙ্গে জড়িতরা যত শক্তিশালীই হোক না কেন তাদের বিচারের আওতায় আনার বিষয়ে লোকমানের পরিবারকে আশ্বস্ত করেন।
শহরের অবস্থা থমথমে : এখনও শহরজুড়ে শোকের আবহ বিরাজ করছে। স্বর্ণপদকজয়ী দেশের শ্রেষ্ঠ মেয়র লোকমান হোসেনকে হারানোর শোকে কাতর মানুষ এখনও বাকরুদ্ধ। শহরে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে অতিরিক্ত পুলিশ ও র‌্যাব সদস্য সতর্কাবস্থায় দায়িত্ব পালন করছে।
তবে অজানা আতঙ্ক কাটেনি। যানবাহন চলাচল করলেও সংখ্যায় কম। সন্ধ্যার পর থেকে শহরে ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়। রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা হয়ে যায়। এক ধরনের আতঙ্ক আর অজানা আশঙ্কায় ভুগছে এ জনপদের মানুষ।
প্রতিবাদ সমাবেশ : আলহাজ লোকমান হোসেন হত্যার প্রতিবাদে গতকাল নরসিংদীর সাটিরপাড়া কালী কুমার উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পাওয়ার লুম শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন ও মাধবদী এসপি ইনস্টিটিউশন মাঠে সদর থানা ছাত্রলীগ প্রতিবাদ সমাবেশ করে। সমাবেশ দুটি থেকে অবিলম্বে খুনিদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করা হয়।
সাটিরপাড়া কালী কুমার উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের প্রতিবাদ সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও নরসিংদী সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস এসএম কাইয়ুম। এ সমাবেশের কয়েকজন বক্তা মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকা ের জন্য প্রভাবশালী দুই নেতার নাম উল্লেখ করে তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।
সমাবেশে বক্তৃতা করেন শামীম নেওয়াজ, শাহ আলম মিয়া, শফিকুল ইসলাম শফিক, আবদুর রহমান, ফররুখ আহমেদ, আবদুস সালাম, নজরুল ইসলাম খান, এএইচএম জাহাঙ্গীর আলম, ডা. সুদর্শন বিশ্বাস, সোহেল ভূঁইয়া, আনোয়ার হোসেন, মোজাম্মেল হক সরকার, আফাজ উদ্দিন, আবদুল মান্নান, মাজহারুল ইসলাম, ওসমান মোল্লা, নূরুল ইসলাম, বাদল মিয়া, মুজিবুর রহমান প্রমুখ।
মাধবদী এসপি ইনস্টিটিউশন মাঠে মোহাম্মদ জাকারিয়ার সভাপতিত্বে প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তৃতা করেন সফর আলী ভূঁইয়া, পরিমল চন্দ্র ঘোষ রঞ্জিত, বোরহান উদ্দিন, আলমগীর হোসেন ভূঁইয়া, আনোয়ার হোসেন, তপন কুমার সূত্রধর, শাহিনুর রহমান, শাহিন মাহমুদ, খায়রুল ইসলাম খান, আবদুল বাকির, আবে দাউদ, মাহবুব হাসান, এনামুল হক শাওন, দেলোয়ার হোসেন, মাসুদ রানা প্রমুখ।
ট্রেন চলাচল শুরু : নরসিংদী রেলস্টেশনের স্টেশন মাস্টার মরন দাস জানান, বুধবার রাত থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-নোয়াখালী রুটে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। বিক্ষুব্ধ জনতা মঙ্গলবার রাতে সিগন্যাল রুম, কন্টোল রুম, বুকিং গোডাউনসহ স্টেশনের বিভিন্ন অফিস কক্ষ ভাংচুর ও অগি্নসংযোগ করে। বুধবার সকাল ১০টায় ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জগামী আন্তঃনগর ট্রেন এগার সিন্ধুরের ১৩টি বগিতে আগুন ও ভাংচুরের পর ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। এসব ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা এবং হামলায় ৫ কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে বলে স্টেশন মাস্টার জানান।
লোকমানের বাড়িতে উপচেপড়া ভিড় : গতকালও মেয়র আলহাজ লোকমান হোসেনের বাসাইলের বাসভবনে শোকাহত মানুষের উপচেপড়া ভিড় ছিল। বাসভবনে সাধারণ মানুষের ভিড়ের চাপ কমছে না। গতকাল সকাল থেকে দিনভর মানুষজন শোকাহত পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেয়। এ সময় লোকমানের আত্মীয়স্বজনের আহাজারিতে সমবেত সবাই আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে। অনেকেই বুক চাপড়ে কাঁদেন। অফুরন্ত ভালোবাসা আর অশেষ শ্রদ্ধায় নরসিংদীর মাটি-মানুষের প্রিয় নেতা লোকমান হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জানান তারা।
বাসভবনে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ : স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা গতকাল লোকমান হোসেনের বাড়িতে গিয়ে শোকাহত পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেন। এ সময় লোকমানের মা মাজেদা বেগম, স্ত্রী বুগলি বেগম, দুই সন্তান সালপি, নাজা, চার ভাই কামরুজ্জামান কামরুল, খলিল, শাহীন, শামীম নেওয়াজ, তিন বোন রুবি, রোজি ও রেমিসহ আত্মীয়স্বজন বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের আর্তনাদ ও বুকফাটা আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।
এ সময় নেতৃবৃন্দের মধ্যে মধ্যে জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট আসাদোজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান, শহর সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ভূঁইয়া, সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক অহিভূষণ চক্রবর্তী ও সদর উপজেলা সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ার উপস্থিত ছিলেন। তারা অবিলম্বে লোকমান হোসেন হত্যার বিচারের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের জানান।

No comments

Powered by Blogger.