কিলিং মিশনে অংশ নেয় তিনজন

রসিংদীর জনপ্রিয় নেতা ও মেয়র লোকমান হোসেন হত্যার দুই দিন পেরিয়ে গেলেও ঘটনাটি এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারছে না নরসিংদীবাসী। কারো মুখেই নেই হাসি। বাড়িতে বাড়িতে ঝুলছে কালো পতাকা। তিন দিন পর কোরবানির ঈদ। কিন্তু লোকজনের মধ্যে নেই সেই আমেজ।এখনও তদন্তের তেমন কোনো অগ্রগতির কথা জানা যায়নি। তবে পুলিশ বলছে, জড়িতদের গ্রেপ্তারে তারা জোরেশোরে চেষ্টা চালাচ্ছে। খুনিদের ফেলে যাওয়া মোটরসাইকেলের সূত্র ধরে তারা এগোনোর চেষ্টা করছে।


নরসিংদী সদর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) কাসিফ সানোয়ার বলেন, 'কিলিং মিশনে তিনজন অংশ নিয়েছে। তারা মোটরসাইকেলে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আসে। তাদের একজন কালো মুখোশ পরে কার্যালয়ে ঢুকে পাঁচ থেকে ছয় ফুট দূর থেকে মেয়র লোকমান হোসেনকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। ঘটনার পরই তারা শহরের গলি দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়।'
এসআই কাসিফ সানোয়ার বলেন, 'খুনিরা দৌড়ে পালানোর সময় আশপাশের দোকানের লোকজন তাদের দেখতে পায়। কিন্তু তারা কেউ তাদের চিনতে পারেনি বলে জানায়। এতে আমাদের সন্দেহ হচ্ছে, অন্য কোথাও থেকে খুনিদের ভাড়া করে এনে লোকমান হোসেনকে হত্যা করা হয়েছে।'
এদিকে মেয়র হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তারকৃত জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির খোকনসহ ছয়জনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গতকাল খোকনের রিমান্ডের আবেদন নামঞ্জুর করেন ম্যাজিস্ট্রেট।
মেয়র লোকমান হত্যার প্রতিবাদে জেলা আওয়ামী লীগ ঘোষিত তিন দিনের শোক কর্মসূচি চলছে নরসিংদীতে। কর্মসূচির অংশ হিসেবে জেলার প্রতিটি ঘরে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন এবং লোকজন কালো ব্যাজ ধারণ করেছে। প্রিয় নেতা হত্যার বিচারের দাবিতে জেলার বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সভা-সমাবেশ করেছে বিভিন্ন সংগঠন। প্রতিটি অনুষ্ঠান থেকে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানানো হয়েছে।
ঈদে ঘরমুখী যাত্রীদের কথা বিবেচনা করে ছাত্রলীগের ডাকা তিন দিনের হরতাল স্থগিত করা হলেও নরসিংদী পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি। গতকাল সকাল থেকে ধীরে ধীরে শহরের দোকানপাট খুলতে শুরু করে। নরসিংদী বাস টার্মিনাল থেকে বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে গতকাল বাস ছেড়ে যায়।
লোকমানের বাড়ি শোকের সাগর : শহরের বাসাইলে লোকমান হোসেনের বাসভবন। সাদা ডুপ্লেঙ্ বাড়ি। লোকমান পৌরসভায় নিয়মিত অফিস করতেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে যাবতীয় কার্যক্রম সেখানেই সারতেন। তাই তাঁর বাসভবনটি ছিল অন্যান্য বাড়ির মতো স্বাভাবিক। কিন্তু গত মঙ্গলবার হঠাৎ করেই পাল্টে যায় চিরচেনা সেই বাড়ির চিত্র। হয়ে ওঠে লোকারণ্য। ঘটনার তৃতীয় দিন গতকালও কমেনি সাধারণ মানুষের ভিড়। শোকার্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সহানুভূতি জানাতে আসা লোকজনের চোখের পানি মিশে যেন বাড়িটি এখন শোকের সাগর। মা মজিদা বেগম কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। স্ত্রী বুবলী এখন অনেকটা নির্বাক। ছোট ভাই শামীম নেওয়াজ কালের কণ্ঠকে জানান, ভাই লোকমান ছিল বাড়ির সবার নয়নের মণি। সেই মানুষটির এমন বিদায় কেউ মেনে নিতে পারছে না।
কান্না ঘরে ঘরে : বিধবা রানু বেগম। ছোট্ট দুই মেয়ে তামান্না (৮) ও শান্তাকে (৭) নিয়ে নরসিংদী মডেল থানার পাশেই অভাবের সংসার তাঁর। তাঁকে বাড়ি থেকে সৎভাইরা তাড়িয়ে দিলে মেয়রের সহায়তায় জমি ফিরে পান। জমিতে মেয়র একটি ঘরও তুলে দেন। রানু বেগম দুই মেয়েকে নিয়ে গতকাল সকালে মেয়র লোকমানের বাড়িতে এসে তাঁর গাড়িটি ধরে কাঁদছিলেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'মেয়র সাবের কারণেই আমার জমি ফিরা পাইছি, সেখানে বাচ্চাদের জন্য ঘরও বানিয়ে দিছে।' কাঁদছিল তার দুই মেয়েও। তামান্না বলে, 'লোকমান কাকু আমাদের দুই বোনকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন।'
রানু বেগমের মতো নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা শতাধিক নারী বসে ছিলেন লোকমানের বাড়ির সামনে। কেন এসেছেন_এ প্রশ্নের উত্তরে নার্গিস আক্তার, জরিনা বেগম ও সফুরা বেগম বলেন, 'ভাই রে, মনডারে আর বুঝাইতে পারি না, কোনো কিছুর দরকার হলেই হের কাছে ছুইড্যা আইতাম, কোনো সময় না করত না। এমন একটা মানুষরে ক্যামনে ওরা মারল?' মনজিলা বেগম বলেন, 'সন্ত্রাসীরা আমার বাড়িডা দখল কইরা নিছিল, লোকমান ভাই বাড়িটা উদ্ধার কইরা দিছে। এই মানুষটারে মাইরা ফালাইছে, হুন্নাই বুকটা ফাইট্টা কান্দন আয়ে।'
গোপালদী এলাকার মা টেঙ্টাইলের মালিক আলী হোসেন বলেন, 'আমি ছিলাম একজন কারখানার শ্রমিক, সেই শ্রমিক থেকে হয়েছি একটি টেক্সটইল মিলের মালিক। এটা সম্ভব হয়েছে শুধু লোকমান ভাইয়ের কারণে। তাঁর মৃত্যুর কথা শোনার পর শুধু আমি না, আমার পরিবারের সবাই কাঁদছে।'
মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ : হত্যাকারীদের বিচার দাবিতে নরসিংদী সদর, মনোহরদী ও পলাশের ঘোড়াশালে মানববন্ধন করেছে বিভিন্ন সংগঠন। একই দাবিতে শহরের সাটিরপাড়া কালি কুমার উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে জেলা টেঙ্টাইল ফেডারেশন। জেলা টেক্সটইল ফেডারেশনের সভাপতি আবদুর রহমানের সভাপতিত্বে সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ও নরসিংদী সরকারি কলেজের ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস এস এম কাইয়ূম, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ আলম, লোকমান হোসেনের ছোট ভাই ও জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ, জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি শফিক রহমান ও শ্রমিক নেতারা।
সভায় বক্তারা বলেন, 'মেয়র লোকমান শুধু নেতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আমাদের ভাই। আর ভাইয়ের হত্যাকারীরা যতক্ষণ পর্যন্ত গ্রেপ্তার না হবে, ততক্ষণ শ্রমিকরা ঘরে ফিরে যাবে না। প্রশাসন যদি তাদের গ্রেপ্তার করতে গড়িমসি করে তাহলে নরসিংদীকে অচল করে দেওয়া হবে।'
অগ্রগতি নেই তদন্তে : লোকমান হোসেন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির খোকনসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অন্যরা হলেন সজীব দাস, মো. সোহেল, তৌহিদ সরকার, জাহিদুল ইসলাম ও সাজ্জাদ হোসেন। গ্রেপ্তারকৃতদের ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গতকাল আদালতে পাঠানো হয়। দুপুরে গ্রেপ্তারকৃত ছয়জনের পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়েছে পুলিশ। নরসিংদীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আশিকুল কবির আগামী ৯ নভেম্বর শুনানির দিন ধার্য করে তাঁদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। খোকনের পক্ষে অ্যাডভোকেট সানাউল্লা মিয়াসহ অন্য আইনজীবীরা জামিনের আবেদন করলে আদালত তা নামঞ্জুর করেন।
খোকনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লা মিয়া বলেন, 'আওয়ামী লীগের কোন্দলের কারণে মেয়র লোকমান হোসেন খুন হয়েছেন। এ হত্যার সঙ্গে খায়রুল কবির খোকনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এ হত্যার মোটিভ অন্যদিকে নেওয়ার জন্যই খোকনকে জড়ানো হয়েছে।' নরসিংদী সদর মডেল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) এ কে এম আজিজুর রহমান বলেন, 'সন্দেহভাজন হিসেবে খায়রুল কবির খোকনসহ ছয়জনকে আটক করা হয়েছে। নির্দোষ প্রমাণিত হলে অবশ্যই তাঁরা ছাড়া পাবেন।' নরসিংদীর পুলিশ সুপার ড. আক্কাস উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, 'আমরা জোরেশোরে কাজ করছি। আশা করছি শিগগিরই খুনিদের গ্রেপ্তার করতে পারব।'

No comments

Powered by Blogger.