‘সিংহ পুরুষ’-এর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: বিবিসির এক সাবেক সাংবাদিকের সত্য বিকৃতি, ‘এবসার্ড’ কথাবার্তা by মহিউদ্দিন আহমদ

গাফ্্ফার ভাই,-আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী-লন্ডন থেকে টেলিফোনে আমাকে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না; আমি যেন দ্রুত তাঁকে টেলিফোন করি, বললেন মোনায়েম সরকার। মোনায়েম সরকার খুবই ঘনিষ্ঠ গাফ্ফার ভাইয়ের।
তিনি ঘনিষ্ঠ আমারও, ‘বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ-এর মহাপরিচালক মোনায়েম সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একজন রাজনীতিঘনিষ্ঠ মানুষ প্রবলভাবে বঙ্গবন্ধু ভক্তও।‘হোস্ট’ এবং বন্ধুবৎসল হিসেবেও তাঁর সুখ্যাতি। গাফফার ভাই কি এমন জরুরী বিষয়ে আমাকে খুঁজছেন, মোনায়েম সরকার তা ঠিক বলতে পারলেন না। তবে এটুকু বললেন, লন্ডনের প্রভাবশালী ইংরেজী দৈনিক ‘গার্ডিয়ান’এ বিবিসি বাংলার এক সাবেক সাংবাদিক সিরাজুর রহমানের একটি চিঠি ছাপা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এই চিঠিতে তিনি ইতিহাস বিকৃতি ঘটিয়েছেন,-তার প্রতিবাদ করতে হবে, এবং আমাকেই সেই প্রতিবাদটি করতে হবে।
গাফ্্ফার ভাইকে ঠিক তখ্খুনি টেলিফোন করতে পারিনি, কারণ আমি তখন ঘরের বাইরে। কিন্তু বাসায় ফেরার আগেই, মোনায়েম সরকারের টেলিফোনের কয়েক মিনিটের মধ্যেই, গাফ্্ফার ভাইয়ের টোলিফোন পেলাম।
সময়টা বছর দেড়েক আগের, ২০১১এর মে মাসের শেষ দিকের। গাফ্্ফার ভাই টেলিফোনে বললেন, বিবিসি বাংলার সিরাজুর রহমান গার্ডিয়ানে ২০১১-এর ২৪ মে তারিখে প্রকাশিত এক চিঠিতে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই যে ১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি ভোরে, পাকিস্তান কারাগারে নয় মাসের বন্দী জীবন থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডনে আসলেন, তখন নাকি যুক্তরাজ্যের তখনকার ভারতীয় হাইকমিশনার আপা ভাই পন্থ বঙ্গবন্ধুকে হিথ্রো বিমানবন্দরে ‘রিসিভ’ করেছিলেন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার খবরটি সিরাজুর রহমানই সেই ৮ জানুয়ারি সকালে লন্ডনের ‘ক্ল্যারিজেস’ হোটেলে বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দিয়েছিলেন। গাফ্্ফার ভাই আমার আগের কয়েকটি লেখায় এবং ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়ও হয়তো জেনেছিলেন যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পথে, আজ থেকে একচল্লিশ বছর আগে, ১৯৭২এর ৮ জানুয়ারি ভোরে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে যে তিনজন বাংলাদেশীর বঙ্গবন্ধুকে প্রথম অভ্যর্থনা জানানোর সৌভাগ্য হয়েছিল তাদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। ছিলাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পুরোটা দিন, সেদিন রাত ১২টা পর্যন্ত। সুতরাং আমার প্রত্যক্ষ এবং চাক্ষুস অভিজ্ঞতার আলোকে সিরাজুর রহমানের উদ্ভট ‘এবসার্ড’ এসব কথাবার্তার তথ্যভিত্তিক প্রতিবাদ আমিই করতে পারি।
আমার প্রতি গাফ্ফার ভাইয়ের এই আস্থা বিশ্বাসের জন্য তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তাঁর এই আস্থা-বিশ্বাসের কারণও ছিল। ১৯৯৬ এর ৮, ৯, ও ১০ জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধুর এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ওপর তখন আমার ‘বিধির বিধান কাটবে তুমি এমন শক্তিমান’ শিরোনামের দীর্ঘ লেখাটি দৈনিক ‘সংবাদ’এর তখনকার সম্পাদক, আমার কলাম লেখক জীবনের গুরু, মরহুম বজলুর রহমান খুব আগ্রহ নিয়েই কয়েক কিস্তিতে ছেপেছিলেন। ঐ লেখায় বর্ণিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এখানেও একটু উল্লেখ করতে চাই।
বঙ্গবন্ধু লন্ডনে এসে পৌঁছেছেন শুনে লন্ডনে দ্রুত ফিরে আসেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, তার সপ্তাহান্তের অবকাশ বাতিল করে। বিকেলে বঙ্গবন্ধু তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রীট-এ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সরকারী বাসভবনে ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে। বঙ্গবন্ধু এ সাক্ষাতকালে মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার ও জনগণের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সাহায্যের জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানান; ব্রিটিশ সরকারের দ্রুত স্বীকৃতির জন্যও অনুরোধ করেন।
সেদিন দুপুরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হোটেলে দেখা করে ডেভিড ফ্রস্ট তাকে একটি সাক্ষাতকার দেয়ার অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু ডেভিড ফ্রস্টকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। ডেভিড ফ্রস্ট পরের সপ্তাহেই বাংলাদেশ সফরে এসে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন। আর পরের সপ্তাহেই বিবিসিতে এই সাক্ষাতকারটি প্রচারিত হয়েছিল।
সেই সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন ’৭১-এর আগে এবং পরে দুই দুইবারের প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন। তবে ’৭১-এ তিনি ‘লেবার পার্টির’ প্রধান এবং ব্রিটিশ ‘হাউস অব কমনস’-এ বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর তখন আরও দেখা করেছিলেন সেই সময় কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেল আর্নল্ড স্মীথ, পিটার শোর এমপি, বাংলাদেশে গণহত্যার উপর ‘সানডে টাইম্স’ পত্রিকায় দীর্ঘ রিপোর্ট প্রকাশ করে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছিলেন যে পাকিস্তানী-গোয়ানীজ সাংবাদিক, সেই এন্থনি ম্যাস্কানেহাস্, দীর্ঘদিন লন্ডন প্রবাসী বিশিষ্ট নেতা তসদ্দুক আহমেদ এবং আরও কিছু বিশিষ্টজন। এসবের বিস্তারিত বর্ণনা আছে আমার দৈনিক সংবাদ-এ প্রকাশিত কয়েক কিস্তির লেখায়। কয়েক বছর আগে দৈনিক ‘যুগান্তরে’ও “সিংহ পুরুষের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, ‘ভয় নেই আমি এসে গেছি’” শিরোনামে আমার এই বিষয়ে আরও একটি লেখা ছাপা হয়েছিল।
খুব সম্ভব দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকাতে পনেরো ষোল বছর আগে প্রকাশিত সিরাজুর রহমান তাঁর এক লেখায় প্রথম দাবি করেছিলেন যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার খবর তিনিই বঙ্গবন্ধুকে প্রথম জানিয়েছিলেন। তখনও বজলুর রহমানের অনুরোধে দৈনিক সংবাদের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত আমার ছোট একটি লেখায় সিরাজুর রহমানের এই উদ্ভট দাবির প্রতিবাদ করে প্রকৃত তথ্য বর্ণনা করেছিলাম।
গাফ্ফার ভাইয়ের সাথে এই বিষয়ে আমাদের মধ্যে কয়েক দফা টেলিফোনে কথাবার্তার পর গাফ্্ফার ভাই গার্ডিয়ানে প্রকাশিত সিরাজুর রহমানের সেই চিঠিটি মোনায়েম সরকারের মাধ্যমে আমাকে পাঠান। ২০১১-এর ২১ মে’তে গার্ডিয়ানে “ওঃ’ং হড়ঃ ঃযব ধৎরঃযসবঃরপ ড়ভ মবহড়পরফব ঃযধঃ’ং রসঢ়ড়ৎঃধহঃ. ওঃ’ং ঃযধঃ বি ঢ়ধু ধঃঃবহঃরড়হ” শিরোনামে প্রকাশিত ইয়ান জ্যাকের প্রবন্ধটিও পাঠিয়ে দেন। এই প্রবন্ধে শর্মিলা বসুর একটি বইয়ের ‘রিভিউ’ ছিল। শর্মিলা বসু তার বহুল সমালোচিত বইটিতে একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল তা বিশ্বাস করে না; এই তিরিশ লাখ সংখ্যাটির বিরুদ্ধে শর্মিলা বসুর ‘ক্যাম্পেইন’ এবং এই ক্যাম্পেইনে, বলতে গেলে, সিরাজুর রহমানের সমর্থনও ওই চিঠিতে। সিরাজুর রহমানের এই চিঠিটি ইয়ান জ্যাকের প্রবন্ধের প্রতিক্রিয়ায় তিনি লিখেছিলেন।

দুই
সিরাজুর রহমানের চিঠিতে কি ছিল তা দেখতে পাঠকদের হয়তো আগ্রহ থাকবে। তাই পুরো চিঠিটিই নিচে উদ্ধৃত করছি।
“Mujib’s confusion on Bangladeshi deaths
Ian Jack (21 May) mentions the controversy about death figures in Bangladesh’s liberation war. On 8 January 1972 I was the first Bangladeshi to meet independence leader Sheikh Mujibur Rahman after his release from Pakistan. He was brought from Heathrow to Claridge’s by the Indian high commissioner Apa Bhai Panth and I arrived there almost immediately.
Mujib was puzzled to be addressed as ``your Excellency” by Mr. Panth. He was surprised, almost shocked, when I explained to him that Bangladesh had been liberated and he was elected president in his absence. Apparently he arrived in London under the impression that East Pakistanis had been granted the full regional autonomy for which he had been campaigning. During the day I and others gave him the full picture of the war. I explained that no accurate figure of the casualties was available but our estimate, based on information from various sources, was that up to “three lakh’’ (30,00,000) died in the conflict.
To my surprise and horror he told Dd Frost later that “three millions of my people” were killed by the Pakistanis. Whether he mistranslated ``lakh” as “million” or his confused state of mind was responssible I don’t know, but many Bangladeshis still belive a figure of three million is unrealistic and incredible.
Serajur Rahman
Retired deputy head, BBC Bengali Service”
এই চিঠিতে সিরাজুর রহমান দাবি করেছেন; (১) বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির পর লন্ডনে সিরাজুর রহমানই প্রথম বাংলাদেশী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেদিন সাক্ষাত করেছিলেন, (২) হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাজ্যে তখন ভারতীয় হাইকমিশনার আপাভাই পন্থই বঙ্গবন্ধুকে ক্ল্যারিজেস হোটেলে নিয়ে আসেন, (৩) বঙ্গবন্ধুর ক্ল্যারিজেস হোটেলে পৌঁছার পরপরই সিরাজুর রহমানও প্রায় তখ্খুনি, ক্ল্যারিজেস হোটেলে পৌঁছেন, (৪) বিমানবন্দর আপা পন্থ যখন বঙ্গবন্ধুকে ‘ইওর এক্সেলেন্সি’ বলে সম্বোধন করলেন, তখন বঙ্গবন্ধু অবাক হয়ে যান, বঙ্গবন্ধু প্রায় মূর্ছাই যান; তাঁকে কেন ‘ইওর এক্সেলেন্সি’ সম্বোধন করা হআে সিরাজুর রহমানকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করেন; উত্তরে (৫) বাংলাদেশ ইতোমধ্যে মুক্ত হয়ে গিয়েছে এবং তাঁর অর্বতমানেই তাঁকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়েছে, এ খবরও তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেন। সিরাজুর রহমান উপরে উদ্ধৃত তাঁর এই চিঠিতে এই দাবিও করেছেন, (৬) তিনিই বঙ্গবন্ধুকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তিন লাখ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বলেছিলেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই তিন লাখ সংখ্যাটিকে ৩০ লাখ, ‘থ্রি মিলিয়ন’, বানিয়ে ফেলেন। এই তিন লাখ সংখ্যাটিকে বঙ্গবন্ধু যে ‘থ্রি মিলিয়ন’ বানিয়ে ফেললেন তা তাঁর ‘কনফিউজড মাউন্ড’-এর কারণে কিনা তা সিরাজুর রহমান জানেন না; তবে তিরিশ লাখ মানুষের মৃত্যু, অনেক বাংলাদেশীই অবাস্তব এবং অবিশ্বাস্য বলে মনে করে, বলেছেন সিরাজুর রহমান তার এই চিঠিতে ।
সেদিনের আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমার সকল শক্তি দিয়েই বলতে পারি, উপরে নম্বর দিয়ে যে ৬টি বিষয়ের উল্লেখ করেছি তার প্রত্যেকটি মিথ্যা, পুরো মিথ্যা এবং ডাহা মিথ্যা।
এক এক করেই এখন ব্যাখ্যা করি। সিরাজুর রহমান বলেছেন তিনিই বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার খবর দিয়েছিলেন; তিনিই প্রথম বাংলাদেশী ক্ল্যারিজেস হোটেলে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হলো সেদিন ভোরে হিথ্রো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ মিশনের তখনকার ভারপ্রাপ্ত প্রধান মরহুম এমএম রেজাউল করীম। তার সঙ্গে ছিলাম আমরা আরও দু’জন,-মহিউদ্দিন আহমেদ জায়গীরদার এবং আমি, মহিউদ্দিন আহমদ। ভারতীয় হাইকমিশনার আপা পন্থ হিথ্রো বিমানবন্দরের ধারে কাছেও সেদিন ছিলেন না। তবে তিনি খবর পেয়ে ক্ল্যারিজেস হোটেলে পৌঁছেন সকাল সাড়ে ১০টা কি ১১টায়। সিরাজুর রহমান হোটেলে পৌঁছেন সকাল ১১টা বা তার একটু পর।
বঙ্গবন্ধু হোটেলে পৌঁছার পর সেদিন সকালে প্রথম দেখা করতে আসেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর স্ত্রী বেগম খুরশীদ চৌধুরী, তাদের প্রথম সন্তান আবুল হাসান চৌধুরী কায়সার, দ্বিতীয় ছেলে আবুল কাসেম চৌধুরী খালেদ এবং তাঁদের একমাত্র মেয়ে শিরীন, এখন ব্র্যাকের কোন প্রতিষ্ঠানে কোন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ব্যারিস্টার মঞ্জুর হাসানের স্ত্রী। তারপর আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর ওসমান গণী। বোধ হয় তারপরই আসেন, মিনহাজ ভাই, মিনহাজ উদ্দিন, লন্ডন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন। সকাল ১১টার দিকে আসেন ভারতীয় হাইকমিশনার আপা পন্থ এবং তাঁর একটু আগে বা পরে এ.জেড মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু। মঞ্জু তখন একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যুক্তরাজ্যস্থ ‘স্টুডেন্টস একশন কমিটি’র কনভেনর বা সভাপতি। মঞ্জুর তখন অসাধারণ এক ভূমিকা ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধে। তাঁর সহযোগীদের মধ্যে তখন ছিলেন,-এখন বিএনপির এক শীর্ষস্থানীয় নেতা,-ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আওয়ামীলীগের এক প্রথম কাতারের নেতা, সুলতান শরীফ, তার বিদেশী স্ত্রী নোরা, নজরুল ইসলাম আলো, সাপ্তাহিক জনমত এর প্রথম সম্পাদক মরহুম ওয়ালি আশরাফ, এখন হাইকোর্টের একজন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এবং ব্যারিস্টার শফিউদ্দিন বুলবুল। মোশাররফও তখন এ.জেড মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জুর একটু আগে বা পরে বঙ্গবন্ধুর ৯ কামরার হোটেল ‘স্যুইট’-এ ঢোকেন, কথাবার্তা বলেন।
মোশাররফের কথা বিশেষ করে মনে আছে এই কারণে যে, মোশাররফই আমাকে উপরে দোতলায় বঙ্গবন্ধুর ‘স্যুইট’এ ঢুকে উত্তেজিতভাবে খবর দিয়েছিল, নিচে ফুটপাথে ইতোমধ্যে জড়ো হওয়া কয়েক হাজার মানুষ ড. ওসমান গণীকে নেমে যেতে দেখে তাকে ধাওয়া দেয়, লাঞ্ছিত করে। বায়ান্নার ভাষা আন্দোলনের সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রভোস্ট থাকাকালে তিনি তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকার জন্য খুন নন্দিত হয়েছিলেন। কিন্তু ’৬০-এর দশকের শেষ দিকে বাঙালীর দুঃস্বপ্নের আইউব-মোনেমী-জমানায়, এনএসএফ নামের দানব অধ্যুষিত ছাত্র সংগঠনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ড. ওসমান গণীর প্রাদুর্ভাব ঘটে; তখন তিনি দারুণভাবে নিন্দিত এবং ঘৃণিতও হয়ে পড়েন। আইউব খান-মোনেম খান চক্রের স্তাবক এই ব্যক্তি পরে ১৯৭০-এ তানজানিয়ায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ডক্টর ওসমান গণী লন্ডন হয়ে দেশে ফিরছিলেন। তখন লন্ডনে বঙ্গবন্ধু এসেছেন শুনে তিনিও বঙ্গবন্ধুকে তাঁর সালাম ও সম্মান জানাতে যান। বঙ্গবন্ধুও সেদিন ড. ওসমান গণীকে সকল রকমের ইজ্জত সম্মান দিয়ে কথা বলেছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ,-তারা তো বঙ্গবন্ধুর মতো এত উদার মনের মানুষ নয়,-সেদিন সম্মান দেখায়নি ড. ওসমান গণীকে।
তিন
যুক্তরাজ্য, তথ্য ভারতের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করতে সারা দুনিয়ার জন্য বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে মুজিবনগর সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ৫ জানুয়ারিতে ঢাকার উদ্দেশে লন্ডন ত্যাগ করেছিলেন বলে তিনি বঙ্গবন্ধুকে ৮ জানুয়ারি ভোরে হিথ্রো বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানাতে পারেননি। কিন্তু লন্ডনে বসবাসরত তাঁর পরিবারের সকল সদস্যই সেদিন সিরাজুর রহমানের অনেক আগেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন, বঙ্গবন্ধুকে সম্মান শ্রদ্ধা জানান।
সিরাজুর রহমানের জন্ম ১৯৩৪ সালে, সেই হিসেবে তাঁর বয়স এখন ৭৮। বিবিসি বাংলা থেকে অবসর নেন ১৯৯৪-তে। বয়স যাই হোক তার তো এমন স্মৃতিভ্রম, মতিভ্রম হওয়ার কথা নয়।
শুধু যে স্মৃতিভ্রম, মতিভ্রম হয়েছে তা তো নয়। তার লেখালেখিতে বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার প্রতি তার বিদ্বেষ যেন প্রকট। সিরাজুর রহমান তার উল্লিখিত চিঠিতেও যেসব বিকৃতি ঘটিয়েছেন তার আরও একটু আলোচনা একটু পরে। কিন্তু ২০০২ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘ইতিহাস কথা কয় ও নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ’ বইটির ‘বিলেতে এবং স্বাধীন স্বদেশে মুক্ত মুজিব’ প্রবন্ধটিতে তিনি কি লিখেছেন, তার কয়েকটি বাক্য এই লেখার জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক মনে করে নিচে উদ্ধৃত করছি :
‘শেখ মুজিব মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কুড়ি-বাইশ মিনিট কথা বলেছিলেন। দরোজা খুলে বেরিয়ে এসেই আমাকে বললেন : আমারে এক্সেলেন্সি কইলো ক্যান?
মুজিব ভাইর সঙ্গে বরাবর আমি খুবই সহজ এবং হাল্কা সুরে কথা বলেছি। বললাম : আপনারে এক্সেলেন্সি কইবো না তো কইবো কি? আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট ...।
উনি বললেন : আমি আবার কিসের প্রেসিডেন্ট হইলাম? আমরা না অটোনমি পালাম।
আমি বললাম : আপনি তো ছিলেন না, মুজিব ভাই, দেশটাকে ওরা ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু আপনার নামে, আমরা দেশের সব মানুষকে এক করে ফেলেছি; আমরা দেশ স্বাধীন করে ফেলেছি।’
লক্ষ্য করুন, এ লেখায় সিরাজুর রহমান বলছেন, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী যখন সেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেছেন তখন মিসেস গান্ধীই বঙ্গবন্ধুকে ‘এক্সেলেন্সি’ বলে সম্বোধন করেছেন। সিরাজুর রহমানের এমন বর্ণনার বিপরীতে উপরে উদ্ধৃত ‘গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত সিরাজুর রহমানের অন্য বর্ণনাটির তুলনা করুন। গার্ডিয়ানে প্রকাশিত চিঠিতে তিনি বলেছেন, হাইকমিশনার আপা পন্থ বঙ্গবন্ধুকে হিথরো এয়ারপোর্টে ‘ইওর এক্সেলেন্সি’ হিসেবে সম্বোধন করেন। তাহলে সিরাজুর রহমানের কোন কথাটি ঠিক?
সিরাজুর রহমানের উদ্ভট কথাবার্তা, তথ্য ও সত্য বিকৃতির এখন আরও একটি উদাহরণ। ২০০১-এর ১১ ডিসেম্বর মান্নান মালানার ইনকিলাব নামক মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কট্টর মৌলবাদী সংগঠনটিতে সিরাজুর রহমানের ‘স্বাধীনতা ছেলে মানুষ থেকে গেল, সাবালক হতে পারল না’ শিরোনামের লেখায় এই কথাগুলোও ছিল : ‘একাত্তরের ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখ রাতেই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, পাকিস্তানীদের পরাজয় আসন্ন। তখন থেকেই আমরা বিবিসির ইংরেজী অনুষ্ঠানে বার বার ঘোষণা দিতে থাকি যে, পরদিন গ্রিনিচ সময় সকাল ১০টায় বিবিসি বাংলায় একটা বিশেষ সংবাদ বুলেটিন প্রচার করবে আমার সহকর্মীদের দু’একজন আমার চাইতেও ভাল সংবাদ পাঠক ছিলেন, বিশেষ করে নুরুল ইসলাম। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে আমার ভূমিকার কথা মনে রেখে তাঁরই প্রস্তাব অনুযায়ী সহকর্মীরা পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের খবর প্রথম প্রচারের সম্মান আমাকেই দিয়েছিলেন।’ সিরাজুর রহমানের এই সম্মান ও কৃতিত্ব দাবিটিও সর্বৈব মিথ্যা। কারণ ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর দিয়ে সেদিন বিবিসি বাংলা যে বিশেষ বুলেটিনটি প্রচার করেছিল, সেটি আসলে পড়েছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। বিবিসি বাংলা তাঁর ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘সেতুবন্ধন’ নামের যে বিশেষ স্মরণিকাটি কিছুদিন আগে প্রকাশ করেছে, সেই স্মরণিকায় ‘আনন্দ ও অভিজ্ঞতার সাতটি বছর’ শিরোনামে সৈয়দ শামসুল হকেরও একটি লেখা আছে। এই লেখাটির প্রাসঙ্গিক অংশটি এমন ‘একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলো মিত্রবাহিনী অর্থাৎ সম্মিলিত ভারতীয় সেনা ও মুক্তিবাহিনীর কাছে। আমার বেতার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত : আত্মসমর্পণের খবরটি আমি পাঠ করেছিলাম সেদিন বিবিসি বাংলা খবরে।’ এখানেওতো সিরাজুর রহমান সত্য কথাটা বলছেন না।

চার
সিরাজুর রহমানের লেখা থেকে আরও একটি উদ্ধৃতি। এটিও ইনকিলাবের ওই উপরে উদ্ধৃত লেখাটি থেকে নেয়া : ’৭২ সালের ৮ জানুয়ারি শনিবার ভোরে শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে ছাড়া পেয়ে লন্ডনে এলেন। তাঁর ধারণা ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তান স্বায়ত্তশাসন পেয়েছে। ক্ল্যারিজেস হোটেলে আমি তাঁকে বলেছিলাম যে তাঁর অনুপস্থিতিতে, কিন্তু তাঁর নামে, আমরা গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছি, আমরা দেশ স্বাধীন করে ফেলেছি। মুজিব ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আমরা দু’জনেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম।
বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়েছে সে খবর সর্বপ্রথম জাতিকে এবং জাতির পিতাকে দেবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এ গৌরবের পরিমাপ নেই, পরিমাপ সম্ভবও নয়। কিন্তু পেছনের দিকে তাকিয়ে এখন মনে হয়, মুজিব ভাইকে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির কথা বলতে পেরে আমি বেশি আনন্দ পেয়েছিলাম।
বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র হওয়ার খবর সিরাজুর রহমানই প্রথম দিয়েছিলেন, তার এই সত্য ও তথ্য বিকৃতির প্রতিবাদে আমার লেখাগুলোতে আমি ‘ক্রুড়’ ভাষাতেই প্রশ্ন করেছিলাম, আমরা যে তিনজন লোক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছার পর থেকে এতগুলো ঘণ্টা কাটালাম, আমরা তখন এতগুলো ঘণ্টা কি আঙ্গুল চুষলাম? তারপর, আমাদেরইবা এই খবরটা দিতে হবে কেন? পাকিস্তানের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোও তো বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে যে কোন ধরনেরই হোক, যে কোন ফরমেই হোক, কিছু একটা সম্পর্ক রাখার আবেদন জানিয়েছিলেন।
তারপর ছিলেন ড. কালাম হোসেন। তিনিও তো সেদিন পিআইএ’র একই বিমানে তাঁর স্ত্রী ড. হামিদা হোসেন এবং তাঁদের দুই শিশুকন্যাসহ লন্ডনে পৌঁছেন। তো ড. কামাল হোসেন কি এতদিন বঙ্গবন্ধুকে দেশের অবস্থা সম্পর্কে কিছু বলেননি?
সেদিন আপা পন্থ বঙ্গবন্ধুকে হোটেলে আনেননি। হিথ্রো থেকে রেজাউল করীম সাহেবই তাঁর ফোর্ড কর্টিনা গাড়িতে হোটেলে নিয়ে আসেন। রেজাউল করীম সাহেব নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন, তাঁর বাম পাশের আসনে বঙ্গবন্ধু, পেছনের সিটে ড. কামাল হোসেন, তার স্ত্রী এবং তাদের দুই সন্তান।
তাদের পেছনে পেছনে আমার অস্টিন ১৩০০ গাড়ি। আমি নিজে গাড়ি চালিয়েছিলাম সেদিন, পাশে জায়গীরদার সাহেব। আমার গাড়িতে তাদের লাগেজ।
তো রেজাউল করীম সাহেবও কি বঙ্গবন্ধুকে ওই ৪০ মিনিটের ড্রাইভে কিছু বলেননি?
সিরাজুর রহমানের এসব উদ্ভট দাবির বিপরীতে আমার ‘ভার্সন’গুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমি গত বৃহস্পতিবার মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু এবং আবুল হাসান চৌধুরী কায়সারের সাথে আলাদা আলাদাভাবে কথা বলি। তাঁদের দু’জনই আমার বর্ণনাকে সঠিক এবং প্রকৃত তথ্য বলে আমাকে আবার নিশ্চিত করেছেন।
এজেড মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জুর কথা আগে একটু বলেছি। এখন আর একটু বলি। সেদিন ৮ জানুয়ারি মঞ্জু কাজ করেছে বঙ্গবন্ধুর একজন অতি স্নেহভাজন কর্মী হিসেবে পুরোদিন। বাংলাদেশের প্রথম এ্যাটর্নি জেনারেল মরহুম এমএইচ খোন্দকার তার বাবা; মঞ্জুর আব্বার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতা ছিল। মঞ্জু এখন কালিয়াকৈরের চন্দ্রা স্পিনিং মিলসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। তাঁর শ্রমিকদের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ, এই মানুষটির এখন নীরব নিভৃত জীবন। শুধু তাকে নিয়ে আমার একটি কলাম লেখার প্রবল ইচ্ছা।
আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, সিরাজুর রহমান আসলেন একটি টেপ রেকর্ডার হাতে। তিনি বার বার অনুরোধ করছিলেন বঙ্গবন্ধুকে, তার টেপ রেকর্ডারে কিছু একটা বলার জন্য। বঙ্গবন্ধু কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। তারপর সিরাজুর রহমান অনুরোধ করলেন, আপনি ভাল আছেন, শুধু এই বাক্যটিই বলুন। বঙ্গবন্ধু তাও বলতে রাজি হননি। রেজাউল করীম সাহেব বঙ্গবন্ধুকে তখন সিরাজুর রহমানের সামনেই যথার্থই উপদেশ দিয়েছিলেন, আপনি এখন কিছু একটা বললে, দুপুর ১টায় ক্ল্যারিজেস হোটেলের বলরুমে আপনার জন্য যে কয়েক শ’ সাংবাদিক অপেক্ষা করছে, সারা দুনিয়াতেই আপনি আজ এক নম্বর শীর্ষ খবর, সেই সংবাদ সম্মেলনটির গুরুত্ব মর্যাদা ম্লান হয়ে যাবে।
কিন্তু সিরাজুর রহমান চেয়েছিলেন একটি ‘স্কুপ’। দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষ নয় মাস পর বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে একটি শব্দ শোনার, তার একটা ছবি দেখার অপেক্ষায়, সিরাজুর রহমানই বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ নিঃসৃত একটি বাক্য, প্রথম বাক্যটি শোনানোর সৌভাগ্য লাভ করবেন, এ ছিল তার প্রত্যাশা। কিন্তু সেই যে সিরাজুর রহমান ব্যর্থ হলেন, তার সঙ্গে পরে ও কিছু প্রত্যাশার অপূর্ণতা যোগ হলো। সুতরাং চলতে থাকল তাঁর আক্রোশ, বিদ্বেষ জাহির।
শেষে আরও কিছু প্রাসঙ্গিক কথা। গার্ডিয়ান পত্রিকায় আমিও গাফ্্ফার ভাইয়ের উপদেশে প্রকৃত তথ্য বর্ণনা করে একটি চিটি পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আমার চিঠিটি ছাপা হয়নি, তবে ছাপা হয়েছিল বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টারের একটি চিঠি, কাটছাঁট করে। গাফ্্ফার ভাই পরে বলেছিলেন, আমার চিঠি একটু দীর্ঘ হয়ে গিয়েছিল। হাইকমিশনের চিঠিতে সরকারী ভাষ্য এবং অবস্থানের কথা বিবেচনা করে ওই চিঠিটিকেই তারা বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করেছিল।
সেদিন ভোরে আপা পন্থ ছিলেন না, তবে ব্রিটিশ ফরেন অফিস থেকে ছিলেন দক্ষিণ এশীয়া বিভাগের প্রধান ইয়ান সাদারল্যান্ড। বস্তুত তিনিই গভীর রাতে রেজাউল করীম সাহেবকে প্রথম খবরটি দিয়েছিলেন, রেজাউল করীম সাহেব টেলিফোনে খবর দেন আমাকে। আমি এবং মহিউদ্দিন জায়গীরদার তখন দক্ষিণ লন্ডনের বালহামে থাকতাম। আমি হিথ্রোর উদ্দেশে রওনা হই তখখুনি এবং পথে জায়গীরদারকে আমার গাড়িতে তুলে নিই। জায়গীর সাহেব নাইজিরিয়ার পাকিস্তান হাইকমিশনে থার্ড সেক্রেটারি ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে তিনি তার স্ত্রী এবং তাদের তিন শিশু সন্তানকে নিয়ে লন্ডনে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন সেপ্টেম্বরে। রেজাউল করীম সাহেব লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাইকমিশনের কাউন্সিলর পদ ছেড়ে দিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন অক্টোবরে। চাকুরী জীবনে যুক্তরাজ্যসহ কতগুলো দেশে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করে রেজাউল করীম সাহেব চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টাও হয়েছিলেন। ২০০৫-এ মিসরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে রাষ্ট্রদূত হিসাবে যোগ দেয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি কায়রোতে মারা যান।
মহিউদ্দিন জায়গীরদার এখন উত্তরায় আমার নিকটতম প্রতিবেশী, ভুটানে আমাদের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। মহিউদ্দিন জায়গীরদারও সেই ৮ জানুয়ারির সারাদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই ছিলেন।
হিথ্রো বিমানবন্দরের ‘আলকক এ্যান্ড ব্রাউন ভিআইপি স্যুইট’এ সেদিন বঙ্গবন্ধুকে দেখে আমি কেঁদে উঠেছিলাম। সিংহ পুরুষ বঙ্গবন্ধু আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, ‘ভয় নেই আমি এসে গেছি।’

‘শিউলীতলা’, উত্তরা, ঢাকা। শনিবার, ৫ জানুয়ারি ২০১৩।
mohiuddinahmed1944@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.