এহেন পাশবিকতা রোধ করতেই হবে by নিয়ামত হোসেন

কোন পুরুষ দেখলেই মেয়েটি আঁতকে ওঠে। একটি কাগজের খবরের শিরোনাম এটি। মেয়েটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার ওপর কয়েকজন দুর্বৃত্ত-পুুরুষ যে জঘন্য, বর্বরতম নির্যাতন চালানোর কারণে মেয়েটি হাসপাতালে।
তার মানবিক বিপর্যয় এতখানি ঘটেছে যার জন্য চমকে ওঠে কোন পুরুষকে দেখলে। খবরটি সকল পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, প্রচারিত হয়েছে অপরাপর প্রচারমাধ্যমে। এই কিশোরীকে কয়েকদিন ধরে আটকে রেখে কয়েকজন দুর্বৃত্ত চরম নির্যাতন চালিয়ে এক সময় তাকে ফেলে দিয়ে যায়। অপমান, লোকলজ্জা এবং সামাজিক অবস্থার কথা ভেবে প্রথমে বিষয়টিকে চেপে রাখা হয়। কিন্তু পরে প্রকাশিত হয় প্রকৃত ঘটনা। ঘটনাটি যাঁরাই শুনেছেন বা জেনেছেন তাঁরাই স্তম্ভিত হয়েছেন।এই কয়েকদিন আগে পঞ্চগড়ের এক শিশুকে ফুসলিয়ে আটক করে রেখে ধর্ষণ করেছে আরেক দুর্বৃত্ত যুবক। সাভার এলাকার এক ঘটনায় ধর্ষিত হয়েছে আরেক তরুণী। এ ধরনের ঘটনার খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত হলে দেশের বিবেকবান মানুষ স্তম্ভিত হন, ব্যথিত হন, চিন্তিত হয়ে পড়ে সমাজের কথা ভেবে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। শিক্ষা-দীক্ষায়, অর্থনৈতিক কর্মকা-ে তাঁরা অনেকখানি এগিয়ে গেছেন। এ অবস্থায় নারী নির্যাতন কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। ধর্ষণকারীদের প্রত্যেককে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষকে নির্যাতিত প্রতিটি নারীর পাশে দাঁড়াতে হবে। সমাজটা যাতে নারীদের জন্য নিরাপদ স্থান হয়ে উঠতে পারে সর্বক্ষেত্রে সেটা সুনিশ্চিত করার জন্য সব শ্রেণীর ধর্ষক, বখাটে এবং অন্যান্য নারী নির্যাতনকারীকে রুখতে হবে। এদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
সমাজটাকে একশ্রেণীর কিছু লোক মগের মুল্লুক বানানোর চেষ্টা করছে কিনা পত্রপত্রিকায় মাঝে মাঝে কোন কোন খবর পড়ে সেই প্রশ্নটাই মনে আসা স্বাভাবিক। আমাদের সমাজটা হঠাৎ করে প্রতিষ্ঠিত হওয়া সমাজ নয়। দীর্ঘ দীর্ঘকাল আগে যে সমাজ আমাদের ছিল, যে সমাজে বাস করতেন এ কালের মানুষের পূর্বসূরিরা, আমাদের বর্তমান সমাজটি সেই পূর্বসূরিদের সমাজের ধারাবাহিকতায় এসেছে। নানা রীতিনীতি, ঐতিহ্য, কালচার বাহিত হয়ে এসেছে এ সমাজে। অতীতের রীতিনীতিকে সযতেœ ধরে রেখেছে এ সমাজ। উর্ধে তুলে ধরা হয় সেগুলোও অতীতের ধারাবাহিকতায়। এ মূল্যবোধগুলো অত্যন্ত মূল্যবান। এই মূল্যবোধগুলোকে সবসময় সমুন্নত রাখা সমাজের জন্য, সমাজের মানুষের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই মূল্যবোধগুলোর একটি নারীর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা পোষণ, তাঁদের মর্যাদাকে কোনভাবেই ক্ষুণœ হতে না দেয়া। এটা ঐতিহ্যের ব্যাপার। আমাদের সমাজের মানুষ এ ঐতিহ্যেই লালিত, এ ঐতিহ্যকেই তারা সব সময় সমুন্নত রাখেন। কিন্তু তারপরও একটা দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে এ সমাজেই অনেক নারীকে নানাভাবে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে, অপমাণিত হতে হচ্ছে। যারা এগুলোর জন্য দায়ী তারা অতি সামান্য কয়েকজন, এক কথায় তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য; কিন্তু তারপরও দেখা যাচ্ছে নারী নির্যাতন সমাজে একটা দুষ্টক্ষতের মতো এখনও বিরাজ করছে। সমাজে নানা ধরনের পন্থায় কিশোরী-যুবতী এমনকি শিশু-বালিকাদের কেউ কেউ লাঞ্ছিত হচ্ছে, অত্যাচারিত হচ্ছে। এসব ব্যাপার সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অপরাধকে উসকে দেয়। নতুন নতুন অপরাধে কাউকে কাউকে প্রভাবিতও করতে পারে। এর পাশাপাশি অনেক যুবতী-কিশোরী এসব ঘটনা শুনলে ভয় পায়, শঙ্কিত থাকে। সমাজে স্বাভাবিক চলাফেলার পথ সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। মোটকথা, নারীদের প্রতি নানামাত্রার অপমান-নির্যাতন-লাঞ্ছনার ঘটনা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এক শ্রেণীর তরুণ তথা যবুক নারীদের ব্যাপারে এমন সব ঔদ্ধত্যপূর্ণ মনোভাব পোষণ করে, তাদের সঙ্গে এমন সব আচরণ করে যাকে অপরাধ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এরা এমন এমন ঘটনাও ঘটায় যার জন্য সংশ্লিষ্ট নারীর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে, তাঁর নিরাপত্তা চরমভাবে ব্যাহত হয়।
মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনা মাঝে মাঝেই ঘটছে। মেয়েরা অফিসে যাচ্ছে, স্কুল-কলেজ যাচ্ছে, কাজকর্মে এখানে- ওখানে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু বখাটে যেন ওঁৎপেতে থাকে। এই বখাটেপনা বা মস্তানি একটা বিকৃত রুচির ব্যাপার, একটা জঘন্য ব্যাধির মতো। নারী- পুরুষ, ছেলেমেয়ে নিয়েই সমাজ। আগে মেয়েরা এখনকার মতো বাইরে আসত না। এখন ব্যাপকহারে বাইরে আসছে। পড়াশোনা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ হাজার রকম কাজে পুরুষের মতো তারাও ব্যস্ত। পুরুষের সঙ্গে সমান তালে মেয়েরা চলুক এটা সবাই বলি। কিন্তু একশ্রেণীর দুর্বৃত্তের কাজ কারবার মেয়েদের এই চলার পথে বাধা সৃষ্টি করে।
এ কথা অস্বীকার করা যাবে না, সমাজের কোন কোন ক্ষেত্রে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। নানা অপরাধপ্রবণতা সমাজে প্রবল হয়ে উঠেছে। অপরাধের বিভিন্ন ধরন, কৌশল নানা উৎস থেকে বিশেষ করে যুবসমাজ দেখছে। এসব উৎসের মধ্যে একটি হচ্ছে ডিশ এ্যান্টেনার বিকৃত অসুস্থ অনুষ্ঠান, কোন কোন চলচ্ছিত্র। এ ছাড়া পর্নোগ্রাফি, নীল ছবি, অপরাধমূলক ছবি ইত্যাদি। ডিশ এ্যান্টেনা বা উন্নত টিভি ব্যবস্থা বিজ্ঞানের একটি উন্নত আবিষ্কার। এর মাধ্যমে গোটা পৃথিবী একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে দ্রুত সারা বিশ্বের সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। প্রসার হচ্ছে জ্ঞানবিজ্ঞানের, শিক্ষার। আমাদের তরুণদের অনেকেই এই ভাল দিকগুলো গ্রহণ করেছে। এ কথাও ঠিক, কিন্তু একশ্রেণীর তরুণ গ্রহণ করছে বিপরীতটিÑতারা চলচ্চিত্রে প্রদর্শিত জীবনকে পাশ্চাত্যের উন্নত জীবনধারা বলে গণ্য করে তারই মন্দ দিকগুলোর হুবহু অনুকরণ করছে, গ্রহণ করছে ইংরেজী, হিন্দী, লারেলাপ্পা সংস্কৃতি। তারা প্রভাবিত হচ্ছে সে সবে। তবে এটাও ঠিক, সমাজে সকল মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে, মানবিকতা উধাও হয়ে গেছে। এটা মনে করার কোন কারণ নেই। লাখ লাখ কোটি কোটি শিক্ষিত-অশিক্ষিত শান্তিপ্রিয়, আমদের ঐতিহ্যগত চিরকালীন মানবিক মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত মানুষ একদিকে আর তার বিপরীতে গুটিকয় মস্তান, বিপথগামী, নারী নির্যাতনকারী সন্ত্রাসী। এরা হাতেগোনা। এখনও আমাদের সমাজে মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষের জন্য। বিপদে বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের হাত। এখনও আমাদের সমাজে কোন রুগ্ন মানুষকে বাঁচাতে মানবিক দরদ নিয়ে এগিয়ে আসে ধনী-নির্ধন হাজার মানুষ। এদের নিয়েই তো সমাজ। এদের নিয়েই তো দেশ। এরা সবাই চায় সন্ত্রাস দূর হোক, এ্যাসিড সন্ত্রাসী, নারী নির্যাতনকারীদের কঠোর শাস্তি হোক। সর্বক্ষেত্রে নারীর মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত থাকুক। দেশে সবার গণতান্ত্রিক অধিকার সমুন্নত থাকুক। নারীরা সমানতালে শিক্ষাদীক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবনের সব ক্ষেত্রে নিরাপদে যাতে এগিয়ে আসতে পারেন সে পথ পরিষ্কার রাখা হোক। আমাদের দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। নারীরা যুগ যুগ ধরে এমনিতেই পিছিয়ে। এখন তাঁরা এগিয়ে আসবেন। ইতোমধ্যেই খানিকটা এগিয়েও এসেছেন। শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে তাঁরা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন। কিন্তু যে হারে নারী নির্যাতন বাড়ছে, তাতে এই ধারা নিঃসন্দেহে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এ কথা সবাই জানে, দেশের নারীরা পিছিয়ে থাকলে, তাঁরা এগিয়ে না এলে দেশও পিছিয়েই থাকবে। এগোতে পারবে না। সেজন্যই নারী নির্যাতনের বর্তমান চিত্রটি বদলানোর জন্য বিভিন্ন কার্যব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে। প্রতিটি নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সমাজে নারীদের মর্যাদা ও সম্মান প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বরোপ করতে হবে। সামজে মানবিক মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে হবে। নারীদের প্রতি সর্বক্ষেত্রে সর্বপর্যায়ে সম্মানের দৃষ্টিভঙ্গিকে উৎসাহিত এবং জোরদার করতে হবে। এই বোধকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। একই সঙ্গে নারী নির্যাতনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্যাতিতার পক্ষে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষকে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে দাঁড়াতে হবে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের দেশে অনেক নারী শুধু মানসম্মানের ভয়ে নয়, অনেক ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের হুমকি ও দাপটের ভয়েও থানা পর্যন্ত যান না। প্রভাবশালী বিত্তশালীদের দাপটে মামলা হলেও চাপের মুখে কোন কোন ক্ষেত্রে তা তুলে নিতে হয়। ফলে সন্ত্রাসীদের বাড় আরও বেড়ে যায়। সেজন্যই নির্যাতিতার পাশে সর্বক্ষেত্রে দ্রুত দাঁড়াতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ধরনের কঠোর ব্যবস্থা প্রতিটি ক্ষেত্রে নিতে পারলে নারীদের ওপর বর্বরতা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকবে, এতে সন্দেহ নেই। এগুলো করতে পারলে নারীদের প্রতি অত্যাচারের মাত্রা যেমন কমতে থাকবে, তেমনি বিশ্ব পরিসরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মলিন হওয়ার ধারাটিও বিপরীতমুখী হবে।

No comments

Powered by Blogger.