নববর্ষে ক্রসফায়ার বন্ধের প্রত্যাশা by বাহাউদ্দিন চৌধুরী

বিচারবহিভর্ূত হত্যাকা- ও ক্রসফায়ারের সমালোচনা করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি আমিরম্নল কবির চৌধুরী। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন প্রকাশ উপল েতিনি এই মনত্মব্য করেন।
এ ছাড়া বিরোধীদলীয় নেত্রী বিএনপিপ্রধান বেগম খালেদা জিয়াও ক্রসফায়ারের সমালোচনা করেন। খালেদা জিয়া বলেন, ক্রসফায়ারের মাধ্যমে বর্তমান সরকার অনেক হত্যাকা- ঘটিয়েছে। এখানে ত্রে বিশেষে নিজেদের রাসত্মাও তারা পরিষ্কার করে নিয়েছে। দেখা গেছে, ঘর থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে নিরপরাধ মানুষকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে। এসব কর্মকা-ের কারণে জনজীবনে আতঙ্ক নেমে এসেছে। এ অবস্থা চলতে পারে না।
প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালে বিএনপির আমলেই র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) গঠনের পর ক্রসফায়ার শুরম্ন হয়। তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ক্রসফায়ারের বিরোধিতা করেছিল। বিএনপির চেয়ারপার্সন এই প্রথম প্রকাশ্যে ক্রসফায়ারের সমালোচনা করলেন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেই প্রথম ক্রসফায়ার শুরম্ন হয়। শুধু তাই-ই নয়, সেই আমলে অপারেশন কীনহার্টের মাধ্যমে সেনাবাহিনী বহু মানুষ হত্যা করে। বলা হয়, হার্ট এ্যাটাকে তারা মারা গেছে। এইসব হত্যার বিচার আইন করে বন্ধ করা হয়। এখন বেগম খালেদা জিয়াই ক্রসফায়ারের বিরম্নদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। বিলম্বে হলেও তার এই শুভবুদ্ধির উদয়কে স্বাগত জানাই। কেবল বেগম খালেদা জিয়া এবং মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানই এই মানবাধিকার লঙ্ঘনে উদ্বেগ প্রকাশ করেননি, দেশের সব শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই এই বিচারবহিভর্ূত হত্যাকা-ের অবসান চায়। মহাজোটের নির্বাচনী প্রতিশ্রম্নতি অনুযায়ীও এটা বন্ধ করতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছেন, কোন ক্রসফায়ার হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী আত্মরার্থে গুলি করতে বাধ্য হয়েছে। কথাটা যে সত্যি নয়, তা তিনিও জানেন। বিএনপি-জামায়াত জোট আমলের পুরনো রেকর্ড তিনিও বাজাচ্ছেন, এটা জাতি আশা করেনি। র্যাবের মহাপরিচালক বলেছেন, প্রতিটি হত্যাকা-ের তদনত্মে হত্যা যথার্থ প্রমাণিত হয়েছে। একথাও গ্রহণযোগ্য নয়। বিভাগীয় তদনত্ম কোন তদনত্মই নয়। পাকিসত্মান আমল থেকেই দেশবাসী এ জাতীয় তদনত্ম দেখে আসছে। নিরপে বিচার বিভাগীয় তদনত্ম প্রয়োজন। নচেৎ এই সমসত্ম তদনত্ম প্রতিবেদন প্রশ্নবিদ্ধই থেকে যাবে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র প্রকাশিত 'মানবাধিকার বাংলাদেশ ২০০৯ : সারসংপে' শীর্ষক প্রতিবেদনে গত ফেব্রম্নয়ারি মাসে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, বিদ্রোহের পর সরকারী হেফাজতে আটক জওয়ানদের মৃতু্য, যুদ্ধাপরাধের বিচার, রাজনৈতিক সহিংসতা ও ছাত্র সংঘাত, পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি, বিচারবহিভর্ূত হত্যাকা-, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নারীর অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের রায়, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, দুনর্ীতি দমন কমিশন ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন পাস নিয়ে পর্যবেণ তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদন আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর পর্বে বিচারবহিভর্ূত হত্যাকা-ের বিষয়টিই বেশি গুরম্নত্ব পেয়েছে। প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০০৯ সালের অক্টোবর পর্যনত্ম ২০০টি বিচারবহিভর্ূত হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। পরের দুই মাসে ঘটেছে আরও ২৯টি। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ১৭৫। ২০০৯ সালে যে ২২৯টি বিচারবহিভর্ূত হত্যাকা- ঘটে, তার মধ্যে নিরাপত্তা হেফাজতে নিহত ৪৭ বিডিআর জওয়ানের মৃতু্যর ঘটনাও আছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের সবের্াচ্চ আদালত সরকারকে দু' দুটো রম্নল জারি করার পরও বিচারবহিভর্ূত হত্যাকা- থেমে থাকেনি। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও বিভিন্নমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ক্রসফায়ারের প েবক্তব্য দিয়েছেন। তখন বিরোধী দলে থেকে আওয়ামী লীগ এসব বক্তব্যের নিন্দা করলেও এখন একই ধরনের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি শোনা যায়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি আমিরম্নল কবীর চৌধুরী বলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কোন সংস্থা কতর্ৃক যেন কোনভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন না হয়, সে জন্য কঠোর পদপে নিতে হবে। তিনি বলেন, দারিদ্র্য দূরীকরণের পাশাপাশি মানবাধিকার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সভা সেমিনার আয়োজন সাময়িকী পুসত্মিকা প্রকাশ ও প্রচারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো যেতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে আসকের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল বলেন, ক্রসফায়ার বন্ধ করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে, নীতিগত সিদ্ধানত্ম নিতে হবে। সরকারকে তার নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার অনুযায়ী সিদ্ধানত্ম নিতে হবে, কোন অগণতান্ত্রিক ও বর্বর উপায়ে দেশ চলবে না।
গত বছর ২৫ ও ২৬ ফেব্রম্নয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ, হত্যাকা-, ধর্ষণ, লুটপাট, অগি্নসংযোগ, লাশ গুমের বিষয়েও বিসত্মারিত আলোচনা করা হয় প্রতিবেদনে। বলা হয়, 'নির্যাতন, লাশ পুড়িয়ে ফেলা, গণকবরে পুঁতে ফেলা এসব আমাদের একাত্তরের দুঃসহ দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়।'
প্রতিবেদনে বিদ্রোহের দুই দিনের হত্যাকা-ের নিন্দার পাশাপাশি জবানবন্দি আদায়ের নামে বিডিআর জওয়ানদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগও আনা হয়। বলা হয়, বিডিআর সদর দফতর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী নিরাপত্তা হেফাজতে আটক অবস্থায় এ পর্যনত্ম ৪৭ জন বিডিআর জয়ান মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ১০ জন, আত্মহত্যায় পাঁচ, লিভার সিরোসিসে চার, কিডনি রোগে তিন, উচ্চরক্তচাপে দুই ও ক্যান্সারে দু'জনের মৃতু্যর কথা বলা হলেও আসকের নিজস্ব তদনত্ম ও বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তাদের সবাই নির্যাতনের কারণে মারা গেছেন।
বিডিআর সদর দফতরে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যাকা-ের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি আটক বিডিআর সদস্যদের মানবাধিকার নিশ্চিত করারও দাবি জানানো হয় প্রতিবেদনে।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে দীর্ঘসূত্রতা দেখে জনগণের মধ্যে বিচার শুরম্ন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বলে প্রতিবেদনে মনত্মব্য করা হয়। বলা হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে বিচার কাজ পরিচালনার জন্য সরকার পুরনো হাইকোর্ট ভবনে তদনত্ম সংস্থার দফতর ও বিচার আদালত স্থাপনের পাশাপাশি আইনজীবী নিয়োগের ঘোষণা দেয়। বিচার প্রক্রিয়া আনত্মর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য করতে জাতিসংঘের কাছে কৌশলগত সহায়তা চায় সরকার এবং জাতিসংঘ এ সহায়তা দিতে সম্মতও হয়। তবে বাসত্মবিক অর্থে কবে বিচার শুরম্ন হবে তা এখনও অনিশ্চিত। এ বিষয়ে সরকারের দীর্ঘসূত্রতা দেখে জনগণের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগছে আদৌ বিচার শুরম্ন হবে তো ?
ইতোপূর্বেও আমি বিভিন্ন সময়ে এই কলামে অবিলম্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরম্ন করার দাবি জানিয়েছি। ক্রসফায়ার বন্ধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে জাতিকে কলংকমুক্ত করা হোক।
লেখক : ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও সাবেক সচিব

No comments

Powered by Blogger.