কারাগার থেকে কামারুজ্জামানের চিঠি-'যুদ্ধাপরাধ'-এ অভিযুক্তদের নেতৃত্ব ছাড়ার পরামর্শ by সেলিম জাহিদ

জামায়াতে ইসলামীর যেসব নেতার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উঠছে, তাঁদের দলীয় নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। কারাগার থেকে লেখা এক চিঠিতে এ পরামর্শ দেন জামায়াতের এই জ্যেষ্ঠ সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তিনি কারাগারে আটক রয়েছেন।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, কামারুজ্জামানের এই চিঠির খবর শুনে কারাগারে চরম উৎকণ্ঠায় পড়েন জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ। বিষয়টি যাতে জানাজানি না হয়, সে জন্য তাঁরা লোক মারফত সতর্ক থাকতে বলেছেন দলীয় নেতাদের। জানা গেছে, চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে দলের ভেতরে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ৭ নম্বর সেল (বকুল) থেকে গত ২৬ ডিসেম্বর কামারুজ্জামান এই চিঠি পাঠিয়েছেন। পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে চিঠিটি দলের ভারপ্রাপ্ত নেতাদের হাতে পেঁৗছানো হয়। চিঠির একটি কপি কালের কণ্ঠও পেয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম প্রথমে কিছু বলতে রাজি হননি। পরে তিনি এ ধরনের একটি চিঠির কথা শুনেছেন বলে জানান। একপর্যায়ে চিঠির বিষয়বস্তু প্রকাশ করে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এত বড় চিঠি কারাগার থেকে আসল কী করে?' তিনি চিঠির কপিটি দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। আজহারুল ইসলাম
বলেন, 'কারাগারে যাঁরা আছেন, তাঁরা দল পরিচালনার জন্য বাইরের নেতাদের দায়িত্ব দিয়েছেন। এর বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই। কেউ যদি এমন কিছু করার চেষ্টা করেন তা হবে দল ভাঙার ষড়যন্ত্র।'
জামায়াতের ঢাকা মহানগর কমিটির ভারপ্রাপ্ত আমির ও সংসদ সদস্য হামিদুর রহমান আযাদ জানান, এ ধরনের চিঠির কথা তিনি শুনেছেন। তিনি বলেন, 'বাইরে থাকতে তিনি (কামারুজ্জামান) দলের জন্য ভাবতেন, এখন জেলে থেকেও ভাবছেন, এতে দোষের কি? আমরা তাঁর মতামতকে অশ্রদ্ধা করি না। তবে জেলের পরিস্থিতি আর বাইরের পরিস্থিতি তো এক নয়।'
'পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে নতুন কর্মকৌশল গ্রহণ সময়ে দাবি' শিরোনামে লেখা ওই চিঠিতে কামারুজ্জামান জামায়াতে ইসলামীর ৬০ বছরের দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের বিশ্লেষণ করে দলের জন্য বেশকিছু নতুন কৌশল ও কর্মপন্থা প্রস্তাব করেন। প্রায় ছয় হাজার শব্দের এই চিঠিতে কামারুজ্জামান বর্তমান পরিস্থিতিকে 'খুব নাজুক' এবং জামায়াতের জন্য 'কঠিন চ্যালেঞ্জ' বলে উল্লেখ করে তা মোকাবিলায় তিনটি বিকল্প পথ বাতলে দেন। এগুলো নিম্নরূপ :
'এক. যা হবার হবে। আমরা যেমন আছি তেমনি থাকব। (বর্তমানে এই কৌশলই অবলম্বন করা হয়েছে।)
দুই. পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে পেছনে থেকে একটি নতুন সংগঠন গড়ে তুলবে। এই সংগঠন প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার সঙ্গে ধর্মহীন শক্তির মোকাবিলা করবে।
তিন. আমাদের যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মিথ্যা অভিযোগ আনা হচ্ছে, তারা জামায়াতের নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়াব এবং সম্পূর্ণ নতুন লোকদের হাতে জামায়াতকে ছেড়ে দেব। অর্থাৎ একটা নিউ জেনারেশন জামায়াত হবে এটি।'
কামারুজ্জামান লিখেছেন, 'আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায় উপরোক্ত তিন অবস্থার প্রথমটা হচ্ছে নেতৃত্ব আঁকড়ে থাকা, হতবুদ্ধিতা এবং হতাশাবাদিতা। একটি গতিশীল আন্দোলন এ ধরনের পশ্চাৎমুখী অবস্থান গ্রহণ করতে পারে না।'
চিঠির এক জায়গায় কারাগারে আটক নেতাদের প্রতি ইঙ্গিত করে কামারুজ্জামান বলেন, 'নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে। নিজেকে সম্পৃক্ত করে চিন্তা করলে সমস্যার সমাধান হবে না।' তিনি আরো লিখেছেন, 'আমাদের অনেকের তো বয়সও হয়েছে। সরাসরি আন্দোলনে থাকলেই বা আমরা আর কতটা অবদান রাখতে পারব? সুতরাং সবাই মিলে দ্বিতীয় যে বিকল্পটির কথা উল্লেখ করেছি, তা সামনে রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই হবে কাঙ্ক্ষিত এবং যুক্তিযুক্ত।' তিনি উল্লেখ করেন, 'এ ধরনের একটি অবস্থান গ্রহণ করলে সাময়িকভাবে আমাদের জন্য ব্যক্তিগতভাবে অবমাননাকর মনে হলেও শেষ পর্যন্ত মহত্ত্বের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলেই আমার বিশ্বাস।'
মৃত্যুদণ্ডের আশঙ্কা : কামারুজ্জামান আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, 'সরকারের আরো তিন বছর সময় আছে। এই সময়ের মধ্যেই যেকোনোভাবে প্রহসনের বিচার করে জামায়াতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে পারে। জামায়াতের কর্মী এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের ঘাবড়ে দেওয়ার জন্য মৃত্যুদণ্ডও দিতে পারে এবং অনেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও দিতে পারে। আবার সম্ভাবনাময় জামায়াত নেতাদের নির্বাচনে দাঁড়ানোর অযোগ্য ঘোষণা করতে পারে এবং তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারে।'
একাত্তরের আলবদর নেতা লিখেছেন, সরকার বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে তাঁদের ভাবমূর্তি খতম করে নির্বাচনী রাজনীতিতে জামায়াতকে একটি অকার্যকর দলে পরিণত করতে পারে। একটা পর্যায়ে গিয়ে আন্তর্জাতিক চাপের কথা বলে এবং বঙ্গবন্ধুর ক্ষমা করে দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে আওয়ামী লীগ ক্ষমা করতে জানে বলে ঘোষণা দিয়ে ক্ষমা করে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিতে পারে। জামায়াতকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ত্যাগ করার জন্য চাপ দিতে পারে এবং এর বিনিময়ে বিচারের বিষয়টি শিথিল করার প্রস্তাব দিতে পারে।
যুদ্ধাপরাধীদের দল হবে জামায়াত : কামারুজ্জামানের মূল্যায়ন, 'যেভাবেই উপসংহার টানা হোক না কেন তাতে জামায়াত রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে_এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইতিমধ্যেই মিডিয়া জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধীদের দল বানিয়ে ফেলেছে। যদি সরকারের বর্তমান ঘোষণা অনুযায়ী বিচারকার্য চলে, তাহলে জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে দেশে বিদেশে চিহ্নিত হয়ে যাবে।' তাঁর মতে, জামায়াতের নেতাদের মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধের মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে বিচার করার পর জামায়াতকে সরকার নিষিদ্ধ না করলেও জামায়াতের ভাবমর্যাদা ভীষণভাবে ক্ষুণ্ন হবে। দেশের ভেতরে-বাইরে জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী, বাংলাদেশবিরোধী, স্বাধীনতাবিরোধীদের দল হিসেবে চিহ্নিত করবে। ফলে জামায়াতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। জামায়াতের ভাব-মর্যাদা পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
নতুন সংগঠনের রূপরেখা : উদ্ভূত পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে জামায়াতকে পেছন থেকে সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করে নতুন প্লাটফর্মে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন কামারুজ্জামান। তাঁর মতে, সেই প্লাটফর্মকে রাজনৈতিকভাবে কেউ সরাসরি আক্রমণ করতে পারবে না। তিনি লিখেছেন, 'আপাতদৃষ্টিতে জামায়াতে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে এমনটি মনে হলেও ক্ষতির কিছু নেই। বরং হেকমতের খাতিরে তেমন একটা কিছু করে হলেও নতুন আন্দোলন দাঁড় করানোর ঝুঁকি গ্রহণ করা উচিত।'
এ ধরনের একটি সংগঠনের রূপরেখাও দেন কামারুজ্জামান। তাঁর মতে, বাংলাদেশের সংবিধান সামনে রেখে যে ধরনের সংগঠন হলে কোনো প্রশ্ন থাকবে না, সে ধরনের সংগঠন করতে হবে। ছায়া মন্ত্রিসভা কনসেপ্ট গ্রহণ করতে হবে। বিশিষ্ট নাগরিক, প্রবীণ আলেম ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের নিয়ে দলের একটি অভিভাবক পরিষদ থাকবে। তিনবারের বেশি কেউ কেন্দ্রীয় সভাপতি বা জেলা সভাপতি থাকতে পারবে না। সব পদের ব্যবহার বাংলা পরিভাষায় হবে। কেন্দ্রীয় কমিটিতে সব পেশার লোকদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। নির্বাচনে প্রথমে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে গতিশীল করতে হবে। যুব ও ছাত্রদের সহায়তায় ক্রিকেট, ফুটবল ও হকি দল, প্রয়োজনে ক্লাব গঠন করতে হবে। অমুসলিমদের সঙ্গে সামাজিক ও ওয়ার্কিং রিলেশন গড়ে তুলতে হবে। সাংবাদিক তৈরি করে বিভিন্ন পত্রিকায় ও টিভি চ্যানেলে ঢোকাতে হবে।
আন্দোলন করে আমাদের মুক্ত করা হবে এমন সম্ভাবনা নেই : কামারুজ্জামান আশঙ্কা প্রকাশ করেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালে তাঁরা ন্যায়বিচার পাবেন না। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, 'বর্তমান সরকার যত দিন ক্ষমতায় আছে, আমাদের মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। সহসা সরকার পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। আন্দোলন করে আমাদের মুক্ত করা হবে এমন কোনো সম্ভাবনাও নেই। আন্দোলন করলে সরকারের পতন ঘটার কোনো আশঙ্কাও নেই, পুরো মেয়াদ পর্যন্তই সরকার ক্ষমতায় থাকবে।' তিনি আরো লিখেছেন, 'জামায়াতের ওপর এবং জামায়াতের নেতা হিসেবে আমাদের ওপর সুস্পষ্ট জুলুম হচ্ছে। এ জন্য অনেকে দুঃখ প্রকাশ বা নিন্দা করলেও দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী কার্যকরভাবে আমাদের তথা জামায়াতের পক্ষ অবলম্বন করবে না। ...বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষে যে নির্বাচন হবে তাতেও জামায়াত ভালো করতে পারবে_এমন কোনো সম্ভাবনাও দেখছি না।'
মুক্তিযুদ্ধ এখনো জ্বলন্ত ইস্যু : কামারুজ্জামান লিখেছেন, জামায়াতের অনেকে মনে করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার বিষয়টি একসময় মিটমাট হয়ে যাবে। তিনি বলেন, 'যেহেতু বিষয়টি আমরা মিটমাট করতে পারিনি অথবা এই রাজনৈতিক বিরোধটি নিরসন করতে পারিনি, যেহেতু আমরা অনেকেই মনে করেছিলাম এটা একসময় এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে, যেহেতু আমাদের অনেকের চিন্তার গণ্ডি অতিক্রম করে এটা একটা জ্বলন্ত ইস্যু হিসেবে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে, যেহেতু সরকারও এ বিষয়ে অবশ্যই একটা কিছু করতে বদ্ধপরিকর এবং যেহেতু কিছু না হলেও দল ও নেতৃত্বের ভাবমর্যাদা ধুলায় লুণ্ঠিত হয়েছে এবং জনমনে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছে, সেহেতু সামগ্রিক বিবেচনায় নতুন কর্মপন্থা ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করা সময়ের অনিবার্য দাবি। আমরা যদি নতুন কর্মকৌশল গ্রহণে ব্যর্থ হই, ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।'
স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা গ্রহণযোগ্যতার পথে বাধা : কামারুজ্জামান লিখেছেন, 'পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে বিরোধিতা করার মতো অতি স্পর্শকাতর কোনো অভিযোগ নেই। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলন খুবই সম্ভাবনাময় আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও এই দুর্ভাগ্যজনক ও স্পর্শকাতর অভিযোগ আন্দোলনের রাজনৈতিক সাফল্য ও গ্রহণযোগ্যতার পথে বড় বাধার সৃষ্টি করে আছে।'
গত বছরের ১৩ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.