‘উড়িয়া যাইব শুয়া পাখি/পড়িয়া রইব ছায়া ...’

গত ২১ ডিসেম্বর দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে ‘হাছন রাজার গান: মিস্টিক বাঙালির মরমি ইশতেহার’ শিরোনামে একটি রচনা সামহয়্যার ইন ব্লগে পোস্ট করেছিলেন সদ্য প্রয়াত গীতিকার ও ব্লগার জুবায়ের হোসেন ইমন।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত কবি ও বাউল দেওয়ান হাছন রাজার জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানিয়ে জুবায়ের ইমন শুরুর লাইনে লিখেছিলেন, ‘উড়িয়া যাইব শুয়া পাখি/পড়িয়া রইব ছায়া ...।’ ইমন লিখেছিলেন, ‘আজ হাছন রাজার (১৮৫৪-১৯২২ খ্রিস্টাব্দ) জন্মদিন। যিনি তাঁর গানে একটি অনিবার্য প্রশ্ন রেখেছিলেন: ‘কী ঘর বানাইমু আমি/শূন্যেরও মাঝার।’ বোঝা যায়, এক অমোঘ শূন্যতা বোধে আক্রান্ত হয়েছিলেন বাংলার ওই মরমি গীতিকার। ঘরসংসার -এমন কী- খোদ অস্তিত্বই যেখানে অর্থহীন, অসার - তাহলে জীবন কেন? কেন ক্ষণিকের এই শূন্য জীবনে এত আনন্দের উপকরণ? সুনামগঞ্জের মরমি গীতিকার এই নিদারুণ ভাবনায় বিস্মিত ও ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন সন্দেহ নেই।’ জুবায়ের ইমন কি জানতেন, রচনাটি প্রকাশের ঠিক দুই সপ্তাহের মাথায় না ফেরার দেশে চলে যেতে হবে তাঁকে! দুঃখজনক হলেও, এমনটিই ঘটেছে। গত ৪ জানুয়ারি শুক্রবার গভীর রাতে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন তিনি। চলে গেলেও, নিঃসন্দেহে তাঁর ফেলে যাওয়া ছায়া ঠিকই পড়ে থাকবে এই ধরণির বুকে। নিজের সৃষ্টিকর্মের মধ্যে তিনি অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন—এমনটাই প্রত্যাশা সবার।
বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় রক ব্যান্ডদল ‘ব্ল্যাক’ যাত্রা শুরু করেছিল ১৯৯৮ সালে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ব্যান্ডটির জন্য গান লিখেছেন জুবায়ের ইমন। এই ব্যান্ডের বেশির ভাগ গানই তাঁর লেখা। গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে লেখা ইমনের সেই গানগুলো শ্রোতাদের কাছে যথেষ্টই প্রশংসিত হয়েছে।
জুবায়ের ইমন সম্পর্কে ব্ল্যাক ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট মুশফিক জাহান বলেন, ‘ইমন ভাইয়ের বাসাতেই ব্ল্যাক ব্যান্ডের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তাঁকে আমাদের ব্যান্ডের নিউক্লিয়াস বলা যায়। মূলত তাঁর অনুপ্রেরণা থেকেই ব্যান্ড গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা। গান লেখা, রেকর্ডিং থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে তাঁর পথ-নির্দেশনা না পেলে ব্ল্যাকের জন্মই হয়তো হত না। ব্ল্যাক ব্যান্ডের প্রতিটি সদস্য তাঁর কাছে চির ঋণী। ১৯৯৮ সালে যখন আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম, তার আগে ব্যান্ডের গানগুলোর মূল বিষয়বস্তু ছিল রোম্যান্টিসিজম। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সেই ধারা ভেঙে পোস্ট মডার্ন ধারায় গান লেখার শুরু হয়েছিল মূলত ইমন ভাইয়ের হাত ধরেই। সেই সময়টাতে ব্ল্যাক, আর্টসেলসহ আরও কয়েকটি ব্যান্ডদল নতুন এ ধারায় গান গাইতে শুরু করে।’
জাহান আরও বলেন, ‘ইমন ভাইয়ের জীবনটা ছিল অদ্ভুত একটি উপন্যাসের মতো। প্রচারবিমুখ এ মানুষটি কখনোই খ্যাতির পেছনে ছোটেননি। নিভৃতে নিজের জগতে বিচরণ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। সাধারণত কোনো ব্যান্ড জনপ্রিয়তা পেলে এর সদস্যদের অনেক ভক্ত জুটে যায়। কিন্তু ব্ল্যাক ব্যান্ডের ক্ষেত্রে একটু অন্য রকম ঘটনাই ঘটেছে। ব্ল্যাকের গানের গীতিকার হিসেবে অনেক ভক্ত পেয়েছিলেন ইমন ভাই। মূলত তাঁর লেখা গানের কথার গভীরতার কারণেই এমনটা হয়েছিল। প্রচণ্ড মিশুক প্রকৃতির একজন মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর ব্যক্তিত্ব সবাইকে চুম্বকের মতো টানতো। তিনি মন খুলে কথা বলতে খুব ভালোবাসতেন।’

জুবায়ের ইমন সম্পর্কে তাঁর বোন রুনি জানিয়েছেন, ‘আমরা চার বোন, এক ভাই। একমাত্র ভাই হওয়ায় তাঁকে আমরা অনেক ভালোবাসতাম। এত তাড়াতাড়ি সে আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাবে, এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। খুব কষ্ট হচ্ছে। ইমনের জন্ম হয়েছিল ঢাকার শান্তিনগরে, এখানেই সে বেড়ে উঠেছে। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করার পর সে সিটি কলেজে ভর্তি হয়। সেখান থেকে এইচএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরিকল্পনা করে। এটি ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষায় সে অংশ নেয়নি। শেষ পর্যন্ত ঠিকই সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হয়।’
লেখালেখি ছাড়া আর কিছুই করতেন না জুবায়ের ইমন। গানের পাশাপাশি নিয়মিত ব্লগে লেখালেখি করতেন। কয়েকটি উপন্যাসও লিখেছেন। কিন্তু কোনোটিই প্রকাশিত হয়নি। এবারের একুশে বইমেলায় তাঁর একটি উপন্যাস বের হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.