বিশ্বকাপ ক্রিকেট-চরম নাটকীয়তার পর ভারত-ইংল্যান্ড টাই-ভারত : ৪৯.৫ ওভারে ৩৩৮ -ইংল্যান্ড : ৫০ ওভারে ৩৩৮/৮

শচীন টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরিতে রান-পাহাড় গড়েও জিততে পারেনি ভারত। অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসের অসাধারণ সেঞ্চুরি জয় এনে দিতে পারেনি ইংল্যান্ডকেও। ফলাফল নাটকীয়তা আর রোমাঞ্চে ভরা এক টাই! টেন্ডুলকারের ১১৫ বলে ১২০ রানের অসাধারণ ইনিংসের সুবাদে ৩৩৮ রানের বিশাল স্কোর গড়ে সহজ জয়ের আশাই করছিল ভারত।
কিন্তু ব্যাঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে স্বাগতিক বোলারদের সামনে ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত হন স্ট্রাউস। তাঁর ১৫৮ রানের অধিনায়কোচিত ইনিংসের সুবাদে ৫০ ওভার শেষে ইংল্যান্ডের স্কোরও ৩৩৮ রান, ৮ উইকেটে। ব্যাটিং-স্বর্গে টস জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিতে দুবার ভাবেননি ধোনি। অ্যান্ডারসনের করা প্রথম বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়েও বেঁচে যান শেবাগ। এই সুযোগ পাওয়ার পরও নড়বড়ে ছিলেন তিনি এবং ভাগ্যের সহায়তাও পেয়ে যাচ্ছিলেন। ভাগ্য যেদিন শেবাগের এমন সঙ্গ নেয় সেদিন সাধারণত বোলারদের কান্নার দিন হয়। কিন্তু ইংল্যান্ডের সৌভাগ্য, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের জয়ের নায়ক শেষ পর্যন্ত কাল ৩৫ রানের বেশি করতে পারেননি। কিন্তু শেবাগ গেলেও আরেকজন তো থেকে যান, যিনি দিনকে দিন জানাচ্ছেন_ক্রিকেট মাঠে তিনি ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি। হ্যাঁ, শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। আরেকবার তিনি নায়ক, আরেকবার তিনি ভারতের রানরথের চালক। টেস্টে সেঞ্চুরির হাফ সেঞ্চুরি পূরণ করেছেন, ওয়ানডেতেও সেটা হয়ে যেত যদি গত এক বছর প্রায় বিশ্রামে না কাটাতেন। বিশ্বকাপ দিয়ে সেই বিশ্রাম কাটিয়ে ফিরেছেন, বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেও শুরু করেছিলেন দারুণ কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক রান আউটে সেদিন বড় কিছু হয়নি। কাল আর ভাগ্যের কোনো বাধা নেই এবং সেটা যেন না হয় সে জন্য শুরু থেকেই ছিলেন সতর্ক। খেলেছেন একটু সময় নিয়ে, কিন্তু সেট হয়ে যাওয়ার পর যেন যৌবনের বিস্ফোরক টেন্ডুলকার, আর তাই ব্যাট থেকে বেরিয়ে এল পাঁচটি ছক্কা। সঙ্গে ১০টি বাউন্ডারিতে ১১৫ বলে ১২০। ক্যারিয়ারের ৪৭তম সেঞ্চুরি এবং বিশ্বকাপের পঞ্চম সেঞ্চুরি। ওয়ানডের সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির মালিক তিনি অনেক দিন ধরে, বিশ্বকাপেও সর্বোচ্চ ছিলেন কিন্তু সেখানে সঙ্গী ছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী, মার্ক ওয়াহ এবং রিকি পন্টিং। কাল তাঁদের ছাপিয়ে তিনি হয়ে গেলেন বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির একক মালিক। সঙ্গে যুবরাজ সিংয়ের ৫০ বলে ৫৮ এবং গৌতম গম্ভীরের ৬১ বলে ৫১ রানের ইনিংস দুটিতে ভারত ৪৯.৫ ওভারে অলআউট হওয়ার আগে করে ৩৩৮। অলআউট হওয়ার তথ্যেই পরিষ্কার, শেষটা ভারতের মনমতো হয়নি। আসলেও তাই, নইলে একসময় মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে করা ইনিংসের কাছাকাছি চলে যাবে ভারত। শেষদিকের ব্যাটসম্যানরা তালটা ধরে রাখতে না পারায় থামতে হয় ৩৩৮-এ-ই।
এটাই বিশাল স্কোর। কিন্তু ভারতের ব্যাটিং স্বর্গ উইকেটে ৩৩৮ রানও যে এমন কিছু নয় সেটা প্রমাণেই যেন নামে ইংল্যান্ড। শুরু থেকেই চালিয়ে খেলে দুই ওপেনার স্ট্রাউস ও কেভিন পিটারসেন জানিয়ে দেন, এত সহজে হাল ছাড়ছেন না তিনি। পিটারসেন (২২ বলে ৩১) এবং এরপর ওয়ানডাউনে নামা জোনাথন ট্রট (১৯ বলে ১৬) ফিরে গেলেও ইংলিশ ইনিংসের চাকা তাতে থামানো যায়নি। অধিনায়ক স্ট্রাউসের সঙ্গে এসে যোগ দেন ইয়ান বেল। এরপর যে ব্যাটিং তাতে ম্যাচটা প্রায় ইংলিশদের পকেটে ঢুকে গিয়েছিল। তৃতীয় উইকেটে দুজনের ১৭০ রানে ইংল্যান্ড ৪৩তম ওভারে গিয়ে পেঁৗছায় ২ উইকেটে ২৮১ রানে, যেখান থেকে জয় মনে হচ্ছিল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু ঘটনা ঘটল এর পরই। জহির খানের বলে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গেলেন ৭১ বলে ৬৯ রান করা ইয়ান বেল। সেই ধাক্কাও সামলানো যেত, যদি পরের বলে স্ট্রাউস আউট হয়ে না যেতেন। জহির খানের দারুণ বলে ইংলিশ অধিনায়ক ফিরে যান ১৪৫ বলে ১৫৮ রানের অসাধারণ এক ইনিংস খেলে। ১৮টি চার ও একটি ছক্কায় সাজানো ইনিংসটি খেলার সময় ভারতীয় বোলারদের তিনি নামিয়ে এনেছিলেন একেবারে সাধারণের পর্যায়ে। সেই তারা আবার অসাধারণ হয়ে গেলেন জহির খানের এই পরপর দুই বলের নাটকে। উইকেট পড়তে থাকল নিয়মিত কিন্তু এর ফাঁকেও ইয়ার্ডি-ব্রেসনান-সোয়ানরা লুজ বলগুলো বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে নিজেদের ম্যাচে ধরে রেখেছিলেন। শেষ ওভারে তাই দরকার ১৪, হাতে দুই উইকেট। আর এবারও শেহজাদ একটা বল পাঠিয়ে দিলেন বাউন্ডারির বাইরে, এই ছক্কাতেই শেষ বলে দরকার দেখা দিল ২ রানের। সেটা ইংল্যান্ড পায়নি বলে ম্যাচ তারা জেতেনি আবার তাদের পুরোপুরি রানবঞ্চিত করতে পারেনি বলে দুদলের স্কোর সমান। দারুণ নাটকীয়তার ম্যাচ টাই। পয়েন্ট ভাগাভাগি মেনে নিতে হলো দুই দলকে। আর দর্শকরা দেখল দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ এক ম্যাচ।
ভারতের রানের পাহাড় গড়া, সেই পাহাড়ের চূড়ায় ইংলিশরা যখন প্রায় হেসেখেলে পেঁৗছে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে, তখনই আবার ম্যাচের বাঁকবদল। জহির খানের বোলিংয়ে মনে হচ্ছিল ভারতই বোধ হয়...। সেখান থেকে আবার ইংলিশদের ফিরে আসা এবং শেষ পর্যন্ত কারো না জেতা! দারুণ এক ক্রিকেট ম্যাচ, যেমন ম্যাচ হলে বিশ্বকাপ ক্রিকেটকে ঠিক মানায়।

ভারত-ইংল্যান্ড স্কোরকার্ড
টস : ভারত
ভারত রান বল ৪ ৬
শেবাগ ক প্রায়র ব ব্রেসনান ৩৫ ২৬ ৬ ০
টেন্ডুলকার ক ইয়ার্ডি ব অ্যান্ডারসন ১২০ ১১৫ ১০ ৫
গম্ভীর ব সোয়ান ৫১ ৬১ ৫ ০
যুবরাজ ক বেল ব ইয়ার্ডি ৫৮ ৫০ ৯ ০
ধোনি ক রাইট ব ব্রেসনান ৩১ ২৫ ৩ ১
ইউসুফ ক সোয়ান ব ব্রেসনান ১৪ ৮ ১ ১
কোহলি ব ব্রেসনান ৮ ৫ ১ ০
হরভজন এলবিডাবি্লউ ব ব্রেসনান ০ ১ ০ ০
জহির রান আউট ৪ ৫ ০ ০
চাওলা রান আউট ২ ৪ ০ ০
মুনাফ অপরাজিত ০ ০ ০ ০
অতিরিক্ত (লেবা-৩, ও-৭, নো-৫) ১৫
মোট : (৪৯.৫ ওভার, অলআউট) ৩৩৮

উইকেট পতন : ১/৪৬, ২/১৮০, ৩/২৩৬, ৪/৩০৫, ৫/৩০৫, ৬/৩২৭, ৭/৩২৭, ৮/৩২৮, ৯/৩৩৮।
বোলিং : অ্যান্ডারসন ৯.৫-০-৯১-১, শেহজাদ ৮-০-৫৩-০, ব্রেসনান ১০-১-৪৮-৫, সোয়ান ৯-১-৫৯-১, কলিংউড ৩-০-২০-০, ইয়ার্ডি ১০-০-৬৪-১।

ইংল্যান্ড রান বল ৪ ৬
স্ট্রাউস এলবিডাবি্লউ ব জহির ১৫৮ ১৪৫ ১৮ ১
পিটারসেন ক এন্ড ব মুনাফ ৩১ ২২ ৪ ০
ট্রট এলবিডাবি্লউ চাওলা ১৬ ১৯ ১ ০
বেল ক কোহলি ব জহির ৬৯ ৭১ ৪ ১
কলিংউড ব জহির ১ ৫ ০ ০
প্রায়র ক রায়না ব হরভজন ৪ ৮ ০ ০
ইয়ার্ডি ক শেবাগ ব মুনাফ ১৩ ১০ ১ ০
ব্রেসনান ব চাওলা ১৪ ৯ ০ ১
সোয়ান অপরাজিত ১৫ ৯ ০ ১
শেহজাদ অপরাজিত ৬ ২ ০ ১
অতিরিক্ত (লেবা-৭,বা-১,ও-৩) ১১
মোট : (৫০ ওভার, ৮ উইকেট) ৩৩৮

উইকেট পতন : ১/৬৮, ২/১১১, ৩/২৮১, ৪/২৮১, ৫/২৮৫, ৬/২৮৯, ৭/৩০৭, ৮/৩২৫।
বোলিং : জহির ১০-০-৬৪-৩, মুনাফ ১০-০-৭০-২, চাওলা ১০-০-৭১-২, হরভজন ১০-০-৫৮-১, যুবরাজ ৭-০-৪৬-০, ইউসুফ ৩-০-২১-০
ফল : ম্যাচ টাই
ম্যান অব দ্য ম্যাচ : অ্যান্ড্রু স্ট্রাউস

No comments

Powered by Blogger.