শেখ হাসিনা শুধু জাতীয় নেতা নন, বিশ্ব নেতাও মনমোহন- শেখ হাসিনার ইন্দিরা গান্ধী শানত্মি পুরস্কার গ্রহণ

মামুন-অর-রশিদ আনুষ্ঠানিকভাবে মর্যাদাপূর্ণ ইন্দিরা গান্ধী শানত্মিপদক গ্রহণ করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার নয়াদিলস্নীর রাষ্ট্রপতি ভবনে তাঁর হাতে এই পুরস্কার তুলে দেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল।
জাতীয় সংহতি সুদৃঢ়করণ, নিরস্ত্রীকরণ কিংবা সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদ দমন এবং উন্নয়নের ধারায় শানত্মি প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় অঙ্গীকারের জন্য তাঁকে এই পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয় বলে ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল ট্রাস্ট জানায়। উলেস্নখ্য, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনদিনের সরকারী সফরে এখন নয়াদিলস্নী রয়েছেন। সোমবার দিলস্নীর হায়দরাবাদ হাউসে দু'দেশের শীর্ষপর্যায়ের বৈঠকে তিনটি চুক্তি ও দু'টি সমঝোতা স্মারক স্বাৰরিত হয়। পদক গ্রহণ ছাড়াও শেখ হাসিনা মঙ্গলবার ভারতের সাবেক তিন প্রধানমন্ত্রীর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং ভারতীয় ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে মিলিত হয়েছেন।
পদক প্রদান অনুষ্ঠানে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল বলেন, "সন্ত্রাস ও সহিংসতার বিরম্নদ্ধে শেখ হাসিনার প্রচেষ্টা আজ বিশ্বব্যাপী নন্দিত-প্রশংসিত। নিজের জীবন হুমকির মুখে থাকা সত্ত্বেও তিনি সাহসের সঙ্গে সবকিছু মোকাবেলা করছেন।" শেখ হাসিনা পদক গ্রহণের পর দেয়া বক্তব্যে বলেন, "আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও শানত্মিতে। আমার দেশের মানুষকে দারিদ্র্যের শিকল এবং সন্ত্রাসের কবল থেকে মুক্তি করতে আমি অঙ্গীকারাবদ্ধ। মানবাধিকার সংরৰণ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা আমার দায়িত্ব মনে করি।" পুরস্কার প্রদানের জন্য তিনি ইন্দিরা গান্ধী মোমোরিয়াল ট্রাস্টকে ধন্যবাদ জানান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, তিনি নিজের জীবনকে শানত্মি ন্যায় ও গণতন্ত্রের জন্য উৎসর্গ করেছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেন, বিশ্ব ফোরামে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর গতিশীল ভূমিকার কারণে আজ সারাবিশ্বে সকল গুরম্নত্বপূর্ণ ফোরামে বাংলাদেশের বক্তব্য শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করা হয়। দেশের গণতন্ত্র উদ্ধারে শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বের কথা তুলে ধরে বলেন, তিনি এখন কেবল জাতীয় নেতা নন। তিনি মহান বিশ্বনেতাও।
ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল ট্রাস্টের চেয়ারপার্সন সোনিয়া গান্ধী শেখ হাসিনার সঙ্গে নিজের শাশুড়ি ইন্দিরা গান্ধীর তুলনা করে বলেন, 'ইন্দিরা গান্ধী যেমন তাঁর স্বনামধন্য পিতা জওহরলাল নেহেরম্নর কাছ থেকে রাজনীতি শিখেছেন তেমনি শেখ হাসিনাও তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছেন।' ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিসত্মানের কারাগার থেকে মুক্তির পর দিলস্নীতে বঙ্গবন্ধুর যাত্রাবিরতির কথা উলেস্নখ করে তিনি বলেন, 'সে সময় আমিও উপস্থিত ছিলাম।'
অতীতে যাঁরা এ পদক পেয়েছেন
অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং ইউপিএ নেত্রী ও কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীও বক্তৃতা করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আনত্মর্জাতিক জুরি বোর্ড গত বছরের নবেম্বরে শেখ হাসিনাকে গান্ধী পুরস্কারের জন্য মনোনয়নের সিদ্ধানত্ম নেয়। ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকা-ের দু'বছর পর ১৯৮৬ সাল থেকে গান্ধী পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। এর আগে ড. ইউনূস ১৯৯৮ সালে এই পদক পান। এছাড়া মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কার যাঁরা পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার, জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান, নামিবিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা সাম নিউজোমা, সাবেক আইরিস প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসান, বিল গেটস, মিখাইল গর্বাচেভ, হামিদ কারজাই, আল বারাদেই, ওয়াংগারি মাথাই প্রমুখ। সংগঠন হিসাবে ইউনিসেফ এই পদক পেয়েছে। এই পুরস্কারের মূল্যমান ২৫ লাখ ভারতীয় রম্নপী এবং সনদ। এবারের ইন্দিরা গান্ধী পদক দেয়া হয় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। মঙ্গলবারের পদক প্রদান অনুষ্ঠানে পরিবারের সদস্যসহ প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
শানত্মি-উন্নয়ন অন্বেষণে শেখ হাসিনা
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনপূর্ব দলীয় ইশতেহারে 'সাউথ এশিয়ান টাস্কফোর্স এগেইনস্ট টেররিজম' গঠনের ঘোষণা দেন। তিনি প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) ৰমতায় থাকাকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ ২৪ বছরের রক্তৰয়ী সংঘাত বন্ধ করতে পার্বত্য শানত্মিচুক্তি করেন। এই চুক্তির মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের পাহাড়ে ভিয়েতনামের মতো রক্তগঙ্গা স্রোত বন্ধ করে দিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হন। বিরোধী দলে থাকাকালীন বিচারবহিভর্ূত হত্যাকা-ের তীব্র বিরোধিতা করেন। দু'একটি ঘটনা ঘটলেও সরকারে আসার পরও বিচারবহিভর্ূত হত্যাকা-ের ব্যাপারে তাদের অবস্থান স্পষ্ট। প্রথম মেয়াদে ৰমতায় আসার পর দেশের দৰিণ পশ্চিমাঞ্চলে সর্বহারার 'কাটা মু-ু' সন্ত্রাস বন্ধ করেন। সেখানে বিপথগামী যুবকদের সুপথে নিয়ে আসতে তাদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেন এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। শুধু তাই নয়, দ্বিতীয় মেয়াদে ৰমতায় আসার পর তাঁর সরকার মৌলবাদী জঙ্গীবাদের বিরম্নদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করছে। এতে জঙ্গীদের ভিত নড়ে গেছে। একই সঙ্গে বর্তমান শেখ হাসিনা প্রশাসন মাত্র এক মাসের মধ্যে দেশের দৰিণ পশ্চিমাঞ্চলে সর্বহারা 'কাটামু-ু' বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করেন। সবচেয়ে বড় সাফল্য বাংলাদেশে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরম্নদ্ধে অপারেশন পরিচালনা। প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী উলফা বাংলাদেশে বিশেষ মহলের রাজনৈতিক আশ্রয়ে ভারতবিরোধী নানা তৎপরতা চালাতে থাকে। শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ায় উলফাবিরোধী অভিযানের ফলে উলফার শীর্ষ নেতারা বাংলাদেশ ছাড়তে শুরম্ন করে। একপর্যায়ে উলফাপ্রধান অরবিন্দ রাজখোয়াসহ কয়েক ভারতীয় সীমানত্ম রৰীবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়। আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদের বিরম্নদ্ধে শেখ হাসিনা প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের কারণে উলফার শীর্ষপর্যায়ের নেতারা বাংলাদেশ ছাড়তে শুরম্ন করেছে। দেশে মৌলবাদ জঙ্গীবাদ এবং গণতন্ত্রের দুশমনদের সামনে একমাত্র প্রতিবন্ধকতা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাকে লৰ্য করে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাসহ বিভিন্ন সময়ে খুনীচক্রের তৎপরতা প্রমাণ করে শেখ হাসিনাই তাদের একমাত্র টার্গেট। সকল প্রতিকূলতা ও বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করে প্রত্যয়ী বিশ্বাস নিয়ে তিনি গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছেন।
শেখ হাসিনার বক্তব্য
পদকপ্রাপ্তির পর দেয়া বক্তব্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ইন্দিরা গান্ধীর অবদান স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, "বঞ্চিত ও নিষ্পেষিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ৰেত্রে তাঁর অবদান ভারতের সীমানার মধ্যে সীমিত থাকেনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ যখন শোষণ আর শাসনের শৃঙ্খল ভেঙ্গে দিতে রক্তবন্যায় ভেসে যাচ্ছিল, তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে এক কোটি বাঙালীকে ভারত অন্ন বস্ত্র আর বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে। শুধু তাই নয়, ইন্দিরা গান্ধী গোটা বিশ্ববাসীর প্রতি বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রয়াত মিসেস গান্ধীর সেদিনের ভূমিকা বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে চির জাগরূক থাকবে।"
শেখ হাসিনা দু'দেশের ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ৰেত্রে সাদৃশ্যের কথা তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত একই ইতিহাসের অংশ। মূল্যবোধ ও জীবনযাত্রার দিক দিয়েও দু'দেশের আবহ প্রায় একই। দু'দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও জোরদার করার একটি সুযোগ আমাদের সামনে এসেছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও শানত্মি প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদৰেপ তুলে ধরে তিনি বলেন, এসব বাসত্মবায়ন করা গেলে বাংলাদেশ কাঙ্ৰিত শানত্মির ধারায় ফিরে আসবে যা পৰানত্মরে উন্নয়নের পূর্বশর্ত।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর ভারত সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণে উন্নতির পথে এগিয়ে যায়। অন্যদিকে বাংলাদেশে স্বাধীনতার অল্প সময় পরেই বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক শক্তির অপতৎপরতা, সপরিবারে জাতির জনককে হত্যা উন্নয়ন অগ্রগতির ধারা বার বার ব্যাহত করেছে। অহিংস নীতির ধারক ভারতবর্ষের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর উক্তি স্মরণ করে শেখ হাসিনা আরও বলেন, "আমরা যা দেখতে চাই আমাদের নিজেদেরই তাতে বদলাতে হবে। আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য আমাদের আরও সবুজ-সুন্দর এবং সমান সুযোগ ও সম্ভাবনার একটি পৃথিবী রেখে যেতে হবে যা আমাদের বর্তমান পৃথিবীর চেয়েও সুন্দর।" শেখ হাসিনা তাঁর বক্তৃতায় উভয় দেশের দুঃখী মানুষের জন্য তাঁর পুরস্কার উৎসর্গ করে বলেন, "এটা আমার জন্য এক বিশাল উপহার।"
আবেগ আপস্নুত শেখ হাসিনা বলেন, '৭৫-এর আগস্টে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পর তিনি ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা ভারতে ছয় বছরের নির্বাসিত জীবনযাপনকালে এই দিলস্নীতেই ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরম্নল ইসলামের দু'টি কবিতার পঙ্ক্তি আবৃত্তি করেন।
সাবেক তিন প্রধানমন্ত্রীর সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার সকালে ভারতের সাবেক তিন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরম্ন, ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধীর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। মৌর্য শেরাটন হোটেল থেকে প্রথমে যান জওহরলাল নেহেরম্নর সমাধিস্থল শানত্মিবানে। সেখান থেকে ইন্দিরা গান্ধীর সমাধিস্থল শক্তিশালে যান। পরে তিনি রাজীব গান্ধীর সমাধিস্থল বীরভূমে যান। তিন নেতার সমাধিতে পুষ্পাঞ্জলি দেয়ার পর কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এই সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, উপদেষ্টা এইচটি ইমাম ও মশিউর রহমান, ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয়, ছোট বোন শেখ রেহানা প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.