বৈঠার টানে টানে গান গতির সঞ্চার_ প্রাণের উৎসব- বাংলার লোকজ ঐতিহ্য নৌকাবাইচ

মীর আবদুল আলীম, রূপগঞ্জ নৌকা বাইচের এ গীতের সঙ্গে পরিচিত নারায়ণগঞ্জসহ দেশের অনেকেই। নৌকা বাইচ উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ সারি গান। নৌকার বৈঠাধারীরা সারিবদ্ধ হয়ে গান গেয়ে যায় বলেই এর নাম সারি গান।
গায়ক গানের একেকটি পদ গেয়ে যান। আর সকল নৌকাকমর্ী সেই সুরকে টেনে নেয় দলবদ্ধভাবে। অবশ্য দৌড়ের নৌকায় গান সকল সময় গীত হয় না। উৎসবের যাত্রাপথে, ফিরতি যাত্রায় কিংবা মহড়া পর্বে চলে এই গানের চর্চা। গায়কের হাতে থাকে করতাল, সঙ্গে তাল সঙ্গত করেন একজন ঢুলি। গানগুলো আবার স্থান সময় ভেদে বিভিন্ন হয়। ঘাট থেকে উৎসবে আবার উৎসব থেকে ঘাটে যেতে গাওয়া হয় এমন গান। বৈঠার টানে টানে এ ধরনের গীত গেয়ে শক্তি সঞ্চার করে প্রতিযোগীরা।
নৌকা বাইচ এ দেশের এক প্রাণের উৎসব। গ্রামীণ এ খেলা আবাল বৃদ্ধবনিতার হৃদয়ে দাগ কাটে। গ্রাম-গঞ্জে নয় নৌকা বাইচ এখন জাতীয় পর্যায়ে স্থান করে নিয়েছে। বাংলার অতি প্রাচীন নৌকা বাইচের ধারণা পাওয়া যায় পৃথিবীর অতি প্রাচীন সভ্যতায়। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ বছর পূর্বে মেসোপটেমিয়ার লোকেরা ইউফ্রেটিস নদীতে এক ধরনের নৌকা বাইচ করত বলে জানা যায়। এর কয়েক শতাব্দী পরে মিসরে ও নীল নদে এই ধরনের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের নিদর্শন পাওয়া যায়। আমাদের ভূখ-ে রণতরীর প্রতিযোগিতা থেকে নৌকা বাইচের উৎপত্তি এমন ধারণাও প্রচলিত। কিন্তু নদীমাতৃক বাংলার যাতায়াতে উপযোগী হিসেবে নৌকার জনপ্রিয়তার সঙ্গে ক্রীড়া পর্বটি এর একটি অংশ হিসেবে দীর্ঘ ঐতিহ্য ধারণ করছে। নৌকার একটা নিজস্ব শক্তি আছে। কোন দুষ্ট আত্মা তার ওপর ভর করলে সে নিজস্ব শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠে। অবশ্য অনেক সময় দেও-দৈত্যও এর ওপরে এসে চড়াও হয়। আত্মা ভর করলেই নৌকা দেওয়ালা হয়ে যায়। অনেক সময় নিজস্ব শক্তিতে সে হারিয়ে যায় লোকচক্ষুর অনত্মরালে। দীর্ঘদিন কোন খোঁজ থাকে না। নিজের রাজ্যে সে ঘুরে বেড়ায়, আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠে। আবার কোন একদিন নিজের রাজ্য থেকে বেরিয়ে এসে ভেসে ওঠে কাউকে জানান না দিয়েই। ঠিক বাইচের দিন ঘাটে এসে হাজির হয়, এমন গল্পও প্রচলিত রয়েছে বাংলার অতি প্রাচীন নৌকা বাইচ উৎসব সম্পর্কে। চারদিকে কোন আসা-যাওয়ার চিহ্ন না রেখেই বিলের ওপর ভেসে উঠত দৌড়ের নৌকা। তাতে বোঝাই থাকত লোক-লস্কর। সাঁক করা এই সুন্দর নাও আবার হঠাৎ হারিয়ে যেত হঠাৎ উদয় হওয়ার মতোই। এগুলো সবই শোনা কথা। স্বচক্ষে দেখেছে এমন কেউ বলে না। যাদের উদ্ধৃতি দেয়া হয় তারা মারা গেছে এক-দু'শ' বছর আগে। দাদার দাদা, নানার নানা নাম উদ্ধৃত করে এমন কিংবদনত্মি উপস্থাপন করা হয়। কেউ কেউ আবার বলেন, কাঠের মাঝে দোষ থাকলে এমন হয়। কাটার আগে গাছের ওপর জিন ভর করে। জিন কিংবা ভূত ভর করলে তখন গাছটি দোষী হয়ে যায়। গাছ কেটে শুকিয়ে ফেললেও এই আছর যায় না। এই গাছের একটি তক্তাও যদি নৌকায় যুক্ত হয় তবে নৌকা আর মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। চলার সময় দোল খায় বেশি। জোরে ছুটতে চাইলে গতি কমে যায়, আবার কখনও গতি বেড়ে যায়। এগুলো আবার অনেকেই বিশ্বাস করেন না। কিন্তু যারা বিশ্বাস করেন তাদের টলানো দায়। যেমন, কাঠমিস্ত্রিদের তাঁরা বলেন এটা সত্য 'জিন-পরী০ ধরা' গাছের কাঠ দিয়ে নৌকা গড়ালে এটি হবেই। তবে দোষী গাছের তক্তা চিহ্নিত করা খুব সহজ। একটা নৌকার যতগুলো তক্তা আছে প্রতিটার কাছে জ্বলনত্ম কুপি ধরতে হবে। যেসব তক্তার কাছে এসে কুপি নিভবে না ওগুলোতে অন্য কোন অসত্মিত্ব ভর করেনি। কিন্তু যদি কোনটার কাছে কুপি নিভে যায় তাহলে বুঝে নিতে হবে তক্তাটি পূর্ণতই দোষী। তখন নৌকা থেকে তক্তাটি সরিয়ে ফেললে সেটি স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এই ঘটনা শুধু দৌড়ের নৌকার ক্ষেত্রেই ঘটে তা নয়, ছোট-বড় যে কোন নৌকায়ই এমন হতে পারে। এরূপ গল্প-কাহিনী নৌকা বাইচ সম্পর্কে বাংলায় বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত রয়েছে। দৌড়ের নৌকা নির্মাণে পেশাদার মিস্ত্রি রয়েছে। পাট, বাঁশ, দড়ি-কাছি ছাড়াও নৌকা নির্মাণের মূল সামগ্রী হলো কাঠ। অনেক সময় তক্তা বানানো হয় গাছ কেটে। তবে বেশিরভাগ সময়েই নৌকার মালিক চেরাই করা কাঠ কিনে আনেন। নৌকা নির্মাণে জারাই কাঠকেই উপযুক্ত মনে করা হয়। তবে বর্তমানে বহুবিধ কাঠের ব্যবহার স্বাভাবিক বিষয়। নৌকার আদর্শ দৈর্ঘ্য ষাট হাত। এতে বত্রিশটি তক্তা প্রয়োজন হয়। প্রতি তক্তা দশ হাত লম্বা। নৌকার মূল অংশ বাতা। এটাই নৌকার কাঠামো নির্দিষ্ট করে। লম্বা চারটি কাঠে এটি তৈরি হয়। ছোট-বড় মাঝারি সবসহ 'গুড়ায়' লাগে ২৯ টুকরা কাঠ। তার পরই আসে গলুই আর পাছার তক্তা। সরম্ন পাতাম আর পেরেক ঠুকে তক্তা জুড়তে সময় লাগে এক থেকে দুই সপ্তাহ। নৌকা নির্মাণের শুরম্ন হতেই মিস্ত্রিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়। হাতের আন্দাজটা করতে হয় নিভর্ুল। বেছে বেছে দেখে নিতে হয় কোথায় জুড়তে হবে কোন্ তক্তাটি। নতুন নতুন নৌকার গতি কম থাকে। দু'তিন বছর পর গাঁথুনি ঢিলে হয়ে এলে গতি বেড়ে যায়। নৌকার কাজ যেদিন শুরম্ন হয় সেদিনই পালিত হয় ছোটখাটো আচার-অনুষ্ঠান। নৌকা নির্মাণের দিন 'বিষকরমের' নামে ভক্তি ও পুজোও করা হয়। মিস্ত্রিদের অংশগ্রহণে পুজোর মূল উপকরণ হয় আম্রপলস্ন্লব শোভিত ঘট ও ভোগ। নৌকা নির্মাণ শেষেও একই প্রকারে পুজো করা হয়। 'বিষকরম' বা বিশ্বকর্মা হলেন দেবশিল্পী। পৃথিবীর নির্মাতা শিল্পসমূহের প্রকাশক, অলঙ্কারের স্রষ্টা, দেবতাদের বিমান নির্মাতা। তার কৃপাতেই জন্ম নেয় শিল্পকলার যাবতীয় জ্ঞান। তাই নৌকা নির্মাতা সনাতনী ধর্মানুসারী মিস্ত্রিরা বিশ্বকর্মার পুজো করেই কর্ম শুরম্ন করেন। নৌকার কাঠামো নির্মাণের পর নৌকার অঙ্গ সজ্জার আলাদা গুরম্নত্ব রয়েছে। প্রথমে নৌকার বাইরের অংশে কোন একটা রঙের প্রলেপ দেয়া হয়। এরপর দু'পাশে 'কটিঘর' অাঁকতে হয়। বিভিন্ন রঙের সমারোহে পদ্মফুল, গলুইয়ের কাছাকাছি অঞ্চলে বড় বড় চোখ, সিংহ, বাঘ, পরী, পাতা, ঘোড়া, মালা আর বিচিত্র সব জীবজন্তুর ছবি দিয়ে সমগ্র নৌকাকে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। এভাবে নৌকা বাইচের উৎসবে নৌকাগুলোর জমকালো সজ্জা উৎসব অঙ্গনকে আরও মাতিয়ে তোলে।

No comments

Powered by Blogger.