পুলিশ-র্যা ব কেউ দায় স্বীকার করেনি- বিএনপি নেতার হাতকড়া পরানো লাশ উদ্ধার

র্যা বের পোশাক পরা সশস্ত্র ব্যক্তিরা ঝিনাইদহের শৈলকুপা থেকে ধরে নিয়ে যান বিএনপির নেতা রফিকুল ইসলাম মজুমদারকে (৪২)। এ ঘটনা ঘটে গত শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে।
এর দুই ঘণ্টা পরই ২০ কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানা এলাকার একটি পেঁয়াজের খেতে হাতকড়া পরা অবস্থায় তাঁর লাশ দেখতে পায় এলাকাবাসী। রফিকুলের স্বজন ও প্রতিবেশীদের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরাই তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়ে খুন করেছেন। হাতকড়ার ওপর খোদাই করে ‘পুলিশ’ লেখা আছে। তবে পুলিশ-র্যা ব কেউ হত্যা বা গ্রেপ্তারের দায় স্বীকার করেনি। কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়নুল আবেদীন বলেন, বাজারে পুলিশ লেখা হাতকড়া কিনতে পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে, সন্ত্রাসীরা এ সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে।
রফিকুল ইসলাম ঢাকার ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব ও গুলিস্তান এলাকার ঢাকা মহানগর কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি। রাজধানীর শনির আখড়া (পূর্ব দনিয়া) এলাকায় তাঁর নিজের ছয়তলা বাড়ি রয়েছে। তিনি পাঁচ ছেলেমেয়ের জনক। শ্বশুরবাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার আনন্দনগর গ্রাম থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বজনেরা জানান, তিনি সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তবে রাজনৈতিক সহকর্মীরা বলছেন, পুলিশের হয়রানি ও গ্রেপ্তার এড়াতে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। এর আগে ২০০৯ সালের ২৫ জুন একই ওয়ার্ডের বিএনপির সভাপতি ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর চৌধুরী আলমকে ফার্মগেট এলাকা থেকে র্যা ব পরিচয়ে একদল লোক ধরে নিয়ে যায়। এর পর থেকে তাঁর কোনো খোঁজ নেই। আর ২০১১ সালের ১৪ জুলাই নিখোঁজ হন ঢাকা মহানগর কমপ্লেক্সের (তৎকালীন ঢাকা সুপার মার্কেট) মালিক দাবিদার হাজি মো. ওয়াজিউল্লাহ (৮০)। তাঁরও এখন পর্যন্ত কোনো খোঁজ মেলেনি। হাজি ওয়াজিউল্লাহ অপহরণ মামলার ৫ নম্বর আসামি এই রফিকুল ইসলাম মজুমদার ওরফে কালা রফিক। সাম্প্রতিক সময়ে হরতালে গাড়ি পোড়ানো মামলারও আসামি তিনি।
রফিকুল ইসলামের শাশুড়ি লিপি খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, শুক্রবার দুপুরে নিজের মাইক্রোবাসে করে একাই শ্বশুরবাড়িতে এসেছিলেন রফিকুল। শনিবার সন্ধ্যায় পরিবারের অন্যদের সঙ্গে ঘরের ভেতরে কথা বলছিলেন তিনি। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে একটি মাইক্রোবাস বাড়ির সামনে আসে। তখন বিদ্যুৎ ছিল না। সাত-আটজন লোক দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে নিজেদের র্যা ব বলে পরিচয় দেয়। এরপর তারা রফিকুলের হাতে হাতকড়া পরিয়ে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়।
প্রতিবেশী রিনা বেগম জানান, রফিকুলকে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাস এসে তাঁর গাড়িচালক আমির হোসেন ও ভায়রা সাইদুর রহমানকে তুলে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় তারা বলে যায়, ‘আপনারা ঝিনাইদহ র্যা ব ক্যাম্পে যোগাযোগ করুন’। রাত দুটোর দিকে চালক ও ভায়রাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
সাইদুর জানান, রফিকুলকে ধরতে আসা লোকগুলোর হাতে অস্ত্র ও পরনে ছিল কালো পোশাক। পোশাকে র্যা ব লেখা ছিল। তাদের ব্যবহূত মাইক্রোবাসের সামনে র্যা ব লেখা ছিল। ওই রাতেই কুমারখালী থানা থেকে তাঁর শাশুড়ির মুঠোফোনে জানানো হয়, কুমারখালীর আদাবাড়িয়া গ্রামের মাঠে একটি লাশ পাওয়া গেছে। লাশটি রফিকুলের কি না, শনাক্ত করতে যেতে বলে পুলিশ।
যেখানে ফেলে রাখা হয় লাশ: রফিকুলের লাশ মেলে অপহরণস্থল থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে কুলসিবাসা-জৌতপাড়া আঞ্চলিক সড়কের ১০০ গজ ভেতরে আদাবাড়িয়া মাঠের পেঁয়াজখেতে। ওই খেতের মাটিতে ধস্তাধস্তির চিহ্ন ছিল। ধস্তাধস্তিতে কিছু পেঁয়াজগাছ মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। এ ছাড়া লাশের পায়ে ও হাতে কাদা লেগে ছিল। এলাকাটি নির্জন, তিন-চার শ গজ দূরে কয়েকটি বাড়ি আছে।
কুমারখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী নওয়াজ বলেন, রাত পৌনে ১০টার দিকে স্থানীয় লোকজনের কাছে লাশের সন্ধান পায় পুলিশ। লাশের সুরতহালকারী উপপরিদর্শক কে এম জাফর আলী বলেন, মাথার ডান দিকে, সামনে ও পেছনে শক্ত কিছু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। গলায় মাফলার পেঁচানো ছিল।
র্যা বের ভাষ্য: র্যা ব-৬-এর ঝিনাইদহ ক্যাম্পের অধিনায়ক স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল হক বলেন, শনিবার রাতে ঝিনাইদহ র্যা ব ক্যাম্প থেকে ওই এলাকায় কোনো অভিযান চালানো হয়নি। সন্ত্রাসীরা র্যা ব সেজে এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তাঁর ধারণা।
ঘটনার পরপরই কেন তাঁর গাড়িচালক ও ভায়রাকে র্যা ব ধরে নিয়ে এসেছিল জানতে চাইলে হামিদুল বলেন, রফিকুলের অপহরণের ব্যাপারে জানতে ও তথ্যের জন্য আমির হোসেন ও সাইদকে রাত নয়টার দিকে র্যা ব ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। পরে লাশ পাওয়ার খবর পেয়ে ওঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
অভিযোগের তির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে: নিহতের দ্বিতীয় স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে রফিকুলের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। সেই সংসারে তিন ছেলে ও এক মেয়ে আছে। রফিকুলের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের শাহরাস্তির চণ্ডীপুর গ্রামে। কোনো পারিবারিক বিরোধ বা রাজনৈতিক কারণে এ হত্যাকাণ্ড হয়নি বলে দাবি করেন রফিকুলের স্ত্রী। তাঁর অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোনো বাহিনী এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
কাল বিক্ষোভ: রফিকুল ইসলামকে খুনের প্রতিবাদে কাল মঙ্গলবার রাজধানীতে বিক্ষোভ-সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। হরতাল শেষে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন।

No comments

Powered by Blogger.