শিক্ষা দিবসের ভাবনা-দুর্ভাবনা by কাজী ফারুক আহমেদ

আজ ১৭ সেপ্টেম্বর 'শিক্ষা দিবস'। শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে ও একটি গণমুখী শিক্ষানীতির দাবিতে নবকুমার স্কুলের ছাত্র বাবুল, বাস কন্ডাক্টর গোলাম মোস্তফা ও গৃহকর্মী ওয়াজিউল্লাহর রক্তে স্নাত হয়ে শিক্ষার্থী এবং মেহনতি মানুষের মিলিত আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে ১৭ সেপ্টেম্বর।


আমার সৌভাগ্য, ছাত্র ও শিক্ষক দু'ভাবেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে দেখার সুযোগ হয়েছে। বাষট্টিতে ছাত্র আন্দোলনে আর তার ১০ বছর পর থেকে শিক্ষক আন্দোলনে সম্পৃক্ত থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন অসঙ্গতি দূর করতে সাধ্যমতো সচেষ্ট থেকেছি।
১৯৬২ সালে প্রকাশিত শরীফ শিক্ষা কমিশনের সুপারিশে ছিল : উর্দুকে জনগণের ভাষায় পরিণত করতে হবে; অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুল ও নামমাত্র বেতনের মাধ্যমিক স্কুল স্থাপনের জন্য সরকারের ওপর নির্ভর করাই জনসাধারণের রীতি। তাদের উপলব্ধি করতে হবে, অবৈতনিক শিক্ষার ধারণা বস্তুত কল্পনামাত্র এবং 'স্নাতক ডিগ্রি কোর্সকে সম্প্রাসারণ করে তিন বছরমেয়াদি করা উচিত হবে।' শরীফ কমিশন রিপোর্টে দরিদ্র পিতার সন্তান মেধাবী হলেও শিক্ষার দ্বার তার জন্য বিলাস হিসেবে দেখানো হয়। ছাত্ররা আগে থেকেই আইয়ুব তথা সামরিক আইনবিরোধী আন্দোলনে ছিল। এমন অবস্থায় শরীফ কমিশনের গণবিরোধী শিক্ষা সংকোচনমূলক সুপারিশ তাদের ক্ষোভের মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। তারা অত্যন্ত সংগঠিতভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। শুধু শিক্ষা সমস্যাকে কেন্দ্র করেই এত বিশাল ও ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন আগে আর হয়নি। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব
স্তরের ছাত্ররা এতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে।
১৭ সেপ্টেম্বর খুব ভোরে থেকেই ছাত্ররা পিকেটিং শুরু করে। পিকেটিংয়ের আওতায় পড়ে মোনায়েম মন্ত্রিসভার সদস্য হাসান আসকারীর মার্সিডিজ গাড়ি ভস্মীভূত হয়। সকাল ৯টা না বাজতেই সব বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। এমন সময় খবর আসে নবাবপুরে গুলি হয়েছে এবং কয়েকজন শহীদ হয়েছেন। তৎক্ষণাৎ পুরো জমায়েতে এক অগি্নশিখার ঢেউ বয়ে যায়। মিছিল শুরু হওয়ার কথা ছিল সকাল ১০টায়। কিন্তু তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে বের হয় জঙ্গি মিছিল। মিছিল হাইকোর্ট পার হয়ে আবদুল গনি রোডে প্রবেশ করলে পেছন থেকে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে নিহত হয় বাবুল, ইপিআরটিসি সরকারি বাসের কন্ডাক্টর গোলাম মোস্তফা ও গৃহকর্মী ওয়াজিউল্লাহ একই সঙ্গে আহত হন। পরদিন ওয়াজিউল্লাহ হাসপাতালে মারা যান।
এখন আসি বর্তমান প্রেক্ষাপটে। শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সরকার থেকে বিনা মূল্যে কয়েক কোটি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয়েছে। দেশব্যাপী প্রাথমিক, পরবর্তী পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার সরবরাহ ও ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান, সিলেবাস যুগোপযোগীকরণের উদ্যোগ, টেলিভিশনে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান প্রচার ও স্কুলের রুটিনের সঙ্গে সমন্বয়ের মতো উলেল্গখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ধীরগতিতে হলেও কর্মসংস্থান, আত্মকর্মসংস্থান নিশ্চিতকরণে সক্ষম বৃত্তিমূলক ও টেকনিক্যাল শিক্ষা ইতিমধ্যেই উচ্চ শিক্ষাঙ্গনেও জায়গা করে নিতে শুরু করেছে। মাদ্রাসা পড়ূয়াদের শিক্ষার মূলধারায় যুক্ত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে প্রতি উপজেলায় কারিগরি স্কুল স্থাপনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা উন্নীতকরণের কাজ, স্থায়ী শিক্ষা কমিশন, শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠন, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের জন্য তিনটি স্বতন্ত্র এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত একটি ও শিক্ষক সংগঠনগুলোর করণীয় নিয়ে আরেকটিসহ মোট পাঁচটি কোড অব কন্ডাক্ট সংবলিত শিক্ষা আইন প্রণয়নের কাজ এগিয়ে চলেছে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বস্তরে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল চালু করতে সরকারের কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে তা নিয়ে গত মাসে ২৪ আগস্ট অতিরিক্ত শিক্ষা সচিবের সভাপতিত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে সভায় আমি স্বতন্ত্র্প স্কেলের যৌক্তিকতা, সম্ভাব্য ভিত্তি ও বাস্তবায়নের কৌশল সম্পর্কে লিখিত মতামত পেশ করি। এর মধ্যে ছিল অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে প্রচলিত জাতীয় স্কেলে সব স্তরের শিক্ষকদের নির্দিষ্ট শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধি ও বর্তমানে যে যে স্তরে বেতনভাতা পাচ্ছেন, তার নূ্যনপক্ষে দুই ধাপ উন্নীতকরণের প্রস্তাব। এদিকে শিক্ষকদের একাংশের নৈতিক স্খলন, পাঠদানে অদক্ষতা ও পেশাগত অসদাচরণ অভিভাবক, শিক্ষা সংশিল্গষ্ট, শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কহীন সবার নিত্য আলোচনার বিষয়। কিন্তু এর প্রতিবিধানে সমন্বয় ও সহযোগিতার কোনো উদ্যোগ এখনও চোখে পড়ছে না। এবারের শিক্ষা দিবসে এটাই আমার ভাবনা-দুর্ভাবনার বিষয়

No comments

Powered by Blogger.