চুক্তি হয়নি তাই যুক্তি খোঁজা হচ্ছে কার ঘাড়ে দোষ চাপানো যায়-কালের আয়নায় by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

তিস্তা নদীর নামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় অদ্বৈতমল্ল বর্মণের উপন্যাস 'তিতাস একটি নদীর নাম' পড়ার সময়। এই উপন্যাসটি যখন পড়ি, তখন আমি কিশোর। বড় হয়ে তিস্তা নদীটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। অবশ্য তিস্তার সেই ভরা যৌবনকালের অবস্থা এখন নেই। এখনকার এই শীর্ণ তিস্তা সারা উপমহাদেশের রাজনীতিতে হঠাৎ এমন বৈঠকী বিতর্ক শুরু করে দিতে পারে, তা কখনও ভাবিনি।


এটা কি কম কথা! পাঠান-মোগল সম্রাটদের পর যিনি মাথায় প্রথম পাগড়ি ধারণ করে দিলি্লর সিংহাসনে বসেছেন, সেই প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং তার দেশের চার রাজ্যের চার মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশে। পারস্পরিক স্বার্থে যোগাযোগ থেকে শুরু করে নানা ব্যাপারে দিলি্ল উদার হয়ে ঢাকার সঙ্গে অনেক চুক্তি করেছে। যদি আগেই বলে দেওয়া হতো, এবারের ঢাকা বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টন, ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চুক্তি, ছিটমহলগুলোর সমস্যায় আরও সন্তোষজনক সমাধান ইত্যাদি হবে না, তা আরও চিন্তাভাবনার পর তিন মাস কি চার মাস পরে হবে, তাহলে এত বিতর্ক সৃষ্টি হতো না। বাংলাদেশ যা পেয়েছে, তাই নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলতে পারত, ভারত বাংলাদেশকে অনেক দিয়েছে এবং দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের এক নবযুগের সূচনা হতে চলেছে।
কিন্তু কথায় বলে 'দিলি্লকা লাড্ডু যো খায়া উও পস্তায়া, যো নেই খায়া, উওভি পস্তায়া' (দিলি্লর লাড্ডু যে খায় সে পস্তায়, যে না খায় সেও পস্তায়)_ বাংলাদেশের হয়েছে তাই। দিলি্লর সঙ্গে বিবাদ করা তার সাজে না, সাধ্যও নেই। আবার মিতালি করতে গেলেও বিপাকে পড়তে হয়। ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিলে তিস্তার পানি, বিদ্যুৎ, ছিটমহল, বাণিজ্য বৈষম্য ইত্যাদি সমস্যার এবারের বৈঠকেই সন্তোষজনক সমাধানে পেঁৗছা যাবে বলে সবচেয়ে বেশি ঢোল পিটিয়েছিল দিলি্ল। কিন্তু মনমোহনজি বিরাট এন্টুরেজ নিয়ে ঢাকায় পেঁৗছতে পেঁৗছতে সেই ঢাকের বাদ্যি থেমে যায়।
দেখা গেল, তিস্তা, বিদ্যুৎ, ছিটমহল ইত্যাদি সব সমস্যা পাশে সরিয়ে রেখে এমন কিছু চুক্তি করার জন্য তারা ঢাকা এসেছেন, যা করার জন্য মন্ত্রী অথবা সচিব পর্যায়ের বৈঠকই যথেষ্ট ছিল। অবশ্য তাদের লক্ষ্য ছিল ট্রানজিট চুক্তি। সুতরাং শীর্ষ বৈঠক করে ঢাকাকে কিছু সান্ত্বনা চুক্তি উপহার দিয়ে তারা ট্রানজিট সুবিধা বাগাতে পারবেন, এটাই সম্ভবত তাদের আশা ছিল। শেখ হাসিনার সাহস ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে ধন্যবাদ। তিনি এই কাড়া-নাকাড়ার বাদ্যে মুগ্ধ হননি এবং ট্রানজিট চুক্তিতে সই না দিয়ে দেশের মর্যাদা রক্ষা করেছেন। অবশ্য তার উপদেষ্টা হিসেবে একজন 'ট্রয়ের ঘোড়া' ছিলেন এবং তিনি তিস্তা, বিদ্যুৎ ইত্যাদি চুক্তি ছাড়াই ট্রানজিট চুক্তিতে সই দিতে শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। শেখ হাসিনা তার পরামর্শ শোনেননি।
এটা গেল আগের কথা। এখন বর্তমানের কথায় আসি। বাংলাদেশ তিস্তার পানি পায়নি এবং ভারতও ট্রানজিট চুক্তি ছাড়াই খালি হাতে ফিরে গেছে, তা নিয়ে দুই দেশেই তোলপাড় শুরু হয়েছে। ঢাকা বৈঠকের 'অসাফল্য' শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেনি (খালেদা জিয়া হতাশ হয়েছেন); কিন্তু মনমোহন সিংয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। দিলি্ল এখন প্রকারান্তরে দোষ চাপাতে চাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘাড়ে। কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একেবারে শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসেন ঢাকা বৈঠকে না আসার জন্য। তিনি তিস্তার ৩০-৪০ হাজার কিউসেক পানি বাংলাদেশকে দিতে রাজি নন। তিনি দিলি্লর হুকুম শোনেননি।
তাতে পশ্চিমবঙ্গে একশ্রেণীর মানুষের কাছে মমতার জনপ্রিয়তা বেড়েছে, সেই মোগল আমলেও বাংলা দিলি্লর আধিপত্য মানতে চায়নি, বারবার বিদ্রোহী হয়েছে। এ যুগে মমতা প্রমাণ করলেন, তিনিও দিলি্লর হুকুম অমান্য করার তেজ ও সাহস রাখেন। কিন্তু তার এই তেজ ও সাহস দিলি্লর সম্মান হ্রাস করেছে, মনমোহন সিংয়ের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে মমতার জনপ্রিয়তায় আঘাত পড়েছে এবং ভারতেরও যেসব মানুষ বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের এই ঐতিহাসিক সুযোগ হাতছাড়া করাকে একটি কূটনৈতিক ব্যর্থতা মনে করেন, তাদের কাছেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষুণ্ন হয়েছে।
মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফর যদি সম্পূর্ণ সফল হতো, তাহলে কৃতিত্বটা তিনি একাই নিতে পারতেন। কারণ, এবার পশ্চিমবঙ্গে 'দিলি্লর ভাইসরয়' চাণক্য বুদ্ধির অধিকারী প্রণব মুখার্জি ঢাকায় আসেননি, যিনি সফর সফল হলে বারোআনা কৃতিত্ব নিতেন (সম্ভবত সফর সম্পূর্ণ সফল হবে না জেনেই তিনি আসেননি)। এখন সফর অসফল (আমি ব্যর্থ হয়েছে বলি না) হওয়ায় মনমোহন সিং এবং দিলি্লর মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার জন্যই একজন স্কেপগোট দরকার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সহজ স্কেপগোট হয়েছেন। তার রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা এবং সস্তা জনপ্রিয়তার মোহ তাকে এই স্কেপগোট বানানো সহজ করেছে।
পশ্চিমবঙ্গের গত সাধারণ নির্বাচনের কিছু আগে থেকে এবং নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরের কৃষক আন্দোলনে সাহসী নেতৃত্ব দেওয়ায় আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে আগের ধারণা বদলে ফেলে তার অনেকটাই অনুরাগী হয়ে উঠেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, তিনি দুই বাংলার বাঙালি সম্পর্কেই মমতা পোষণ করেন এবং পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থহানি না হলে বাংলাদেশকে তার ন্যায্য পাওনা দিতে মোটেই অনিচ্ছুক নন। এখন তার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দিলি্ল তাকে জানিয়েছিল, বাংলাদেশকে তিস্তার ২৫ হাজার কিউসেক পানি দেওয়া হবে। তারপর তাকে না জানিয়েই তা ৩০ থেকে ৪০ হাজার কিউসেকে বাড়ানো হয়েছে এবং তিস্তা চুক্তি সম্পর্কে দিলি্লর কেন্দ্রীয় সরকার তার সঙ্গে কোনো আলোচনাই করেনি। সুতরাং দিলি্লর 'বশ্যতা স্বীকার করে' তিনি ঢাকায় যাননি।
দিলি্ল বলছে, মমতা ঢাকা যাবেন না তা আগে বলেননি। তবু তাকে বোঝানোর জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মেননকে তার কাছে পাঠানো হয়েছিল। তখনও মমতার মনোভাব ছিল দিলি্লর কাছে অস্পষ্ট। তারপর একেবারে শেষ মুহূর্তে তিনি যখন ঢাকা যাবেন না বললেন, তখন দিলি্ল বিব্রত, ঢাকা মর্মাহত এবং দুই দেশের অধিকাংশ মিডিয়া মমতা সম্পর্কে ক্রিটিক্যাল। দুই দেশের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি হতে গিয়েও হতে পারল না। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হলো সারা উপমহাদেশের গণতান্ত্রিক শিবির। শক্তি বাড়ল সাম্প্রদায়িক ও গণবিরোধী চক্রগুলোর।
আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘনিষ্ঠভাবে জানি এ কথা বলব না। তার সাহস ও সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসা সম্পর্কে আমার সন্দেহ নেই। কিন্তু তার নীতিনিষ্ঠা সম্পর্কে আমার সন্দেহ আছে। সহজ সুবিধাবাদিতাও তার রাজনীতির অঙ্গ বলে আমার ধারণা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি মনমোহন সিংয়ের মন্ত্রিসভাতেই রেলমন্ত্রী ছিলেন। সুতরাং বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তাসহ বিভিন্ন চুক্তিতে দিলি্ল কী করতে চায়, তা তার অজানা থাকার কথা নয়।
তাছাড়া শেখ হাসিনাকে দিদি ডেকে, বাংলাদেশে রবীন্দ্র জন্মোৎসব উপলক্ষে সোনারতরী মৈত্রী ট্রেন পাঠানোর পরিকল্পনা করে তিনি দুই বাংলার সংযোগ ও সম্পর্ক বাড়িয়ে তোলার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তারপর হঠাৎ কী হলো? অতীতে একবার বিজেপির দলে ভিড়ে, আরেকবার কংগ্রেস জোটে ফিরে এসে তিনি যে ভোল পাল্টানোর চরিত্রের পরিচয় দিয়েছিলেন, এবার বাংলাদেশকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দেওয়ার ব্যাপারেও তিনি একই ভোল পাল্টানোর খেলা খেললেন বলে অনেকেই মনে করতে পারেন।
আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনের আসল কথা জানার জন্য লন্ডন থেকে কলকাতায় টেলিফোন করে তার একটি সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি এখন ঠোঁট খুলতে নারাজ। বাধ্য হয়ে কলকাতায় ও দিলি্লতে তার সমর্থক সাংবাদিকদের দু'একজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মধ্যে আছেন কলকাতার দৈনিক স্টেটসম্যানের সম্পাদক মানস ঘোষ, কলামিস্ট অচিন রায় এবং দিলি্লর ইংরেজি দৈনিক পেট্রিয়টের (অধুনালুপ্ত) সাংবাদিক প্রেমাংশু বণিক।
বণিক এখন সাংবাদিকতা করেন না, কিন্তু দিলি্লর মমতা-লবির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। মানস ঘোষ এ মাসের গোড়ায় মনমোহন সিংয়ের টিমের সঙ্গে ঢাকায় গিয়েছিলেন। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুবই ঘনিষ্ঠ। পশ্চিমবঙ্গের গত সাধারণ নির্বাচনে দৈনিক স্টেটসম্যান মমতার দলের জয়ে বারোআনা শক্তি জুগিয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। আমি এই তিন সাংবাদিক বন্ধুকেই বলেছি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই হঠাৎ ভোল পাল্টানোর কারণ কী? তারা বলেছেন, মমতা ভোল পাল্টাননি। প্রথমত, তিস্তার পানি বণ্টন সম্পর্কে দিলি্ল তার সঙ্গে আগে পরামর্শ না করায় এবং চুক্তিতে পানি বৃদ্ধি সম্পর্কে তার মত না নেওয়ায় তিনি সঙ্গতভাবেই ক্ষুব্ধ হয়েছেন। দ্বিতীয়ত, তিস্তার পানিপ্রবাহ এখন এত কম যে, বাংলাদেশকে ৩০-৪০ হাজার কিউসেক পানি দেওয়া হলে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল পানির অভাবে মরুভূমি হয়ে যাবে। ওই উত্তরাঞ্চলেই মমতার তৃণমূলের
জনপ্রিয়তা বেশি।
আমার কাছে এই যুক্তি খুব একটা ধোপে টেকে না। প্রথম কথা, দুই দেশের কোনো কোনো পানি বিশেষজ্ঞই বলেছেন, হিমালয়ের পাদদেশে এত নদ-নদী আছে যে, তার পানি তিস্তায় ডাইভার্ট করার ব্যবস্থা করে অনায়াসে তিস্তার পানিপ্রবাহ বাড়ানো যায় এবং দুই বাংলার পানির চাহিদাই মেটানো যায়। এই ব্যবস্থা করার জন্য সময়ের দরকার হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকা এসেই সে কথা বলতে পারতেন এবং তিস্তা সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদন দু'চার মাসের জন্য স্থগিত রাখতে পারতেন। তিনি তা না করে যা করলেন তাতে তার নিজের ভূমিকা সম্পর্কে দুই দেশের মানুষের মনে শুধু সন্দেহ সৃষ্টি করেননি, দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যেও অযথা সন্দেহ ও সংশয়ের বীজ রোপণ করলেন।
তিস্তার পানি বণ্টন সম্পর্কে দিলি্লর কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যদি মতৈক্য না থাকে, তাহলে সেটাও তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এই অভ্যন্তরীণ বিরোধ একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির ক্ষেত্রে এক্সপোজ করা এবং প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করা কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে?
তবে একটি ব্যাপারে কলকাতায় দৈনিক স্টেটসম্যান সম্পাদকের (যিনি ঢাকা বৈঠকের সময় উপস্থিত ছিলেন) সঙ্গে সহমত পোষণ করি। তিনি বলেছেন, বৈঠক যে সম্পূর্ণ সফল হলো না, তার জন্য দুই দেশের 'ব্যুরোক্রেটিক-বাঙ্লিংই' বেশি দায়ী। ট্রানজিট সুবিধা বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের কাছ থেকে সহজেই আদায় করা যাবে এই আশায় তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ এখন কতটা, কতটা পানি বাংলাদেশকে দেওয়া যাবে এবং পশ্চিমবঙ্গের এ সম্পর্কে মতামত কী, এসব ব্যাপারকে কিছুমাত্র গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। 'ডেল্হি-ব্যুরোক্রেসি' ভেবেছিল, অন্য কিছু চুক্তির লোভ দেখিয়েই হাসিনার কাছ থেকে ট্রানজিটের সুবিধা আদায় করা যাবে। তারপর তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে গড়িমসি করেও বেশ কিছুকাল কাটিয়ে দেওয়া যাবে।
যে কৌশলটা ভারত অতীতে বাংলাদেশের সঙ্গে সব চুক্তির ব্যাপারেই করেছে এবং এখনও করছে। মনমোহন সিংয়ের মতো একজন সাবেক ব্যুরোক্র্যাট ভারতের প্রধানমন্ত্রী না হয়ে একজন দ্বিতীয় শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতাও যদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতেন, তাহলে এ ভুলটা তিনি করতেন না, আমলাতন্ত্রের দাম্ভিকতা ও একদেশদর্শিতার ফাঁদে পা দিতেন না। যে ভুলটা অতীতে ইন্দিরা সরকার বা পরবর্তীকালের গুজরাল বা দেবগৌড়া সরকার করেনি।
বাংলাদেশের তরফেও এই 'ব্যুরোক্রেটিক-বাঙ্লিং'টা হয়নি তা নয়, গঙ্গার পানি চুক্তির সময়ও শেখ হাসিনার পাশে ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদসহ প্রবীণ ও নবীন রাজনৈতিক সহকর্মী এবং পরামর্শদাতারা। সেবারও গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে এই পরামর্শদাতাদের সাহায্যে শেখ হাসিনা পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি আগেই দূর করার জন্য জ্যোতি বসুর মন জয় করার কাজে উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন। জ্যোতি বসুর সোনারগাঁয়ের পৈতৃক ভিটায় একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
এবার তিস্তার পানি চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কেন দক্ষ রাজনৈতিক সহকর্মীদের, এমনকি পররাষ্ট্র মন্ত্রককেও এক প্রকার পাশ কাটিয়ে কেবল বিদেশ থেকে ভাড়া করে আনা উপদেষ্টার ওপর (যিনি বা যারা আবার কূটনীতিক নন, একাডেমিশিয়ান বলে পরিচিত) বেশি নির্ভরশীল হয়েছিলেন তা আমার জানা নেই। এই উপদেষ্টারা সম্ভবত ধরেই নিয়েছিলেন, তিস্তার পানি চুক্তিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থন একেবারে ষোলোআনা নিশ্চিত। তাকে আগে থেকে প্রস্তুত করা দরকার নেই। আবার মোটা মাথার বুদ্ধিতে তারা একথাও ভাবতে পারেন, কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যেখানে রাজি, সেখানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতার কাছে ছোটাছুটির দরকার কী? অতীত থেকে শিক্ষা নিলে তারা এই ভুলটা করতেন না।
তাই এখন চুক্তিটা না হওয়ায় যুক্তি খোঁজা হচ্ছে কার ঘাড়ে দোষটা চাপানো যায়। এ ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই সহজ স্কেপগোট তাতে সন্দেহ নেই। দিলি্লর আমলাতান্ত্রিক জ্যাঠামি অথবা চতুরতা যে এক্ষেত্রে কাজ করে থাকতে পারে, তা আমাদের চোখ এড়ালে ভুল হবে। দুই দেশের বৃহত্তর স্বার্থেই তিস্তাসহ সব নদ-নদীর সমস্যার মীমাংসা এবং ভারতকে ট্রানজিট সুবিধাদান সম্পর্কেও একটা সন্তোষজনক চুক্তি হওয়া প্রয়োজন। তবে এই চুক্তি সম্পাদনে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতা প্রয়োজন, আমলাতান্ত্রিক
ভাড়ামি নয়।
লন্ডন, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১১, শুক্রবার
 

No comments

Powered by Blogger.