বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়ূক by মোঃ শফিকুল ইসলাম খোকন

বর্তমানে সারাদেশে অস্বাভাবিক মৃত্যু সড়ক দুর্ঘটনায় যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি বৃদ্ধি পাচ্ছে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে। প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকা, টিভি চ্যানেলসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে চোখে পড়ে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর ঘটনা। জনসাধারণের বৃহত্তর অংশ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আর এই বেসরকারি ক্লিনিক কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে না সংশিল্গষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এই নিয়ন্ত্রণহীন বাণিজ্যে ঠকছে রোগীরা। শুধু ঠকছে তা নয়; আর্থিক দণ্ড ছাড়াও চিকিৎসকদের অবহেলায় তাদের আপনজনকেও হারাতে হয়। বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরতা বাড়লেও মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা খুবই নাজুক।
গত ৫ সেপ্টেম্বর বরগুনার পাথরঘাটা পৌর শহরে অবস্থিত পাথরঘাটা সার্জিক্যাল ক্লিনিকে ভুয়া চিকিৎসকদের অবহেলায় প্রসূতি মা তাজেনুর বেগমসহ (২২) নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে। কী মর্মান্তিক ঘটনা! ক্লিনিকে সিজার করাতে এসে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন, তাও ভুয়া চিকিৎসকদের হাতে। জানা গেছে, প্রসূতি মায়ের অপারেশন করা ৩ জন চিকিৎসকই ভুয়া। শুধু পাথরঘাটায়ই নয়; এ রকমের ভুয়া চিকিৎসকদের বিচরণ দেশের সব জায়গায়। সরকারি অনুমোদনহীন বেসরকারি ক্লিনিকে তারা অবৈধভাবে চিকিৎসা দিয়ে আসছেন। সম্প্রতি পাবনার চাটমোহরে সেবা নামের একটি ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসা ও অপারেশনের ফলে আইরিন (২৭) নামের এক প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে। জানা যায়, অপারেশন করার জন্য রোগীর পেট কাটার সঙ্গে সঙ্গে মারা যান এবং ওই সময় ডাক্তার ও ক্লিনিকের মালিক বাচ্চা পেটের ভেতরে ঢুকিয়ে সেলাই করে দেন। ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলার এক ক্লিনিকে ডাক্তার সিজার করতে গিয়ে প্রসূতি সালেহা বেগমের কিডনির নালি কেটে ফেলায় তার মৃত্যু হয়।
মা-বাবা ও একটি পরিবারের জন্য গর্ভধারণ ও শিশুর জন্ম সবার মনে আনন্দ বয়ে আনে। অথচ প্রসবকালীন জটিলতায় তা একটি পরিবারের জন্য বিষাদময় হয়ে ওঠে। সম্প্রতি এভাবেই অপচিকিৎসকরা অনেক জীবন শেষ করে ফেলেছেন এবং তা চলমান আছে। কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে, ক্লিনিকে অভিজ্ঞ ডাক্তার তো নেই-ই, বরং ক্লিনিকের নার্স কিংবা কর্মচারীদের দ্বারা সিজার অথবা অপারেশন করানো হচ্ছে। এই অপচিকিৎসায় যারা মারা যান বিষয়টিকে কি মৃত্যু না হত্যাকাণ্ড বলা হবে? ভুয়া চিকিৎসকের অপচিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু_ সেটি স্বাভাবিক মৃত্যু যদি না-ই হয়, যদি হত্যাকাণ্ড হয় তাহলে তাদের বিচার করা উচিত।
বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবায় নিয়ন্ত্রণহীন বাণিজ্য ঠেকাতে নতুন খসড়া তৈরির জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে ১২ সদস্যের ন্যাশনাল কোর কমিটি করা হয়েছে। গত ১৪ আগস্ট খসড়াটি মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। খসড়ার ১৭(১) ধারায় বলা হয়_ আইনের বিধিমালা অনুযায়ী চিকিৎসালয়, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও নিবন্ধিত চিকিৎকের ফি নির্ধারিত হবে। (২) উপধারায় বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফির তালিকা দৃষ্টিগোচর এলাকায় ঝুলিয়ে রাখার কথাও বলা হয়েছে। খসড়ার ১৯ ধারায় বর্ণিত দণ্ডের বিধান অনুযায়ী সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরতদের অফিস সময়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে দেখা গেলে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। লাইসেন্স ছাড়া বেসরকারি সেবাকেন্দ্র পরিচালনা করলে অনধিক ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড বা ১ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের সুপারিশও করা হয়েছে। তবে ভুল বা অপচিকিৎসা অথবা অবহেলায় রোগীর মৃত্যু ঘটলে তার প্রতিকারের ব্যবস্থাটি অস্বচ্ছ। এ ক্ষেত্রে অপচিকিৎসক কিংবা সনদহীন চিকিৎসকদের দ্বারা রোগীর মৃত্যু হলে কী দণ্ড হতে পারে সে বিষয়টিও এ খসড়ার আওতায় আনা উচিত।
ভুয়া ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদের কেউ কেউ স্থানীয় দুষ্কৃতকারীদের মাসোহারা দিয়ে পুষে থাকে। ক্লিনিকের ভুল চিকিৎসার ফলে কোনো রোগী মারা গেলে জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেও ওই দুষ্কৃৃতকারী-সন্ত্রাসীরা মৃতের স্বজনদের মামলা করা থেকে বিরত রাখার সব চেষ্টা চালিয়ে যায়। এ বাস্তবতায় চিকিৎসাসেবাকে নিশ্চিত, নিরাপদ এবং বিশ্বস্ততা অর্জন করতে হলে লাইসেন্সবিহীন ক্লিনিকওয়ালাদের দৌরাত্ম্য, অপচিকিৎসার দরজা বন্ধ করতে হবে।
msi.khokon@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.