চড়া সুদে বিনিয়োগ থমকে যাওয়ার আশঙ্কা

দেশ এখন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু ব্যাংক ঋণ দিলেও সুদের হার খুব চড়া। এভাবে চলতে থাকলে দেশে আগামীতে কোনো বিনিয়োগ হবে না। চূড়ান্তভাবে এর প্রভাব পড়বে সরকারের রাজস্ব আয়ে।


দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) আয়োজিত মতবিনিময় সভায় ব্যবসায়ী মহল থেকে এই অভিমত উঠে এসেছে।
তবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন যে গণমাধ্যমে অর্থনীতির যে সংকটের কথা বলা হচ্ছে, সেরকম কোনো সংকট নেই। এই সংকট গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ তৈরি করেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
অর্থমন্ত্রী অবশ্য এ-ও বলেছেন যে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে জলাঞ্জলি দিতেও তিনি রাজি আছেন।
রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই কার্যালয়ে আয়োজিত এই মতবিনিময় সভায় অর্থমন্ত্রী প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন অর্থ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ তারেক। এতে সভাপতিত্ব করেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ।
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য: সভার প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, বাংলাদেশ সম্ভাবনার দেশ। কিন্তু যদি সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতি না থাকে, তাহলে এই সম্ভাবনা মাটি হয়ে যাবে। এ কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতির জন্য প্রয়োজনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে জলাঞ্জলি দিতেও রাজি আছি।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, গত বছর অতি সম্প্রসারণশীল মুদ্রানীতি থাকায় আর্থিক খাতে কিছু ‘বাবল’ সৃষ্টি হয়েছে। বেসরকারি খাতের জন্য ১৭-১৮ শতাংশ ঋণের প্রবৃদ্ধিই যথেষ্ট।
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, এ বছর ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নেওয়ার কথা। ২২ জানুয়ারি সরকারের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। তিনি বলেন, ‘আমার যখন আদায় কম হচ্ছে, তখন আমাকে ঋণ নিতে হয়। কিন্তু যখন আদায় বেশি হয়, তখন নিচ্ছি না।’
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, অনেকেই সার্বভৌম ঋণ নেওয়ার বিরোধী। কিন্তু সরকার সার্বভৌম বন্ড ছেড়ে ঋণ নেওয়ার চেষ্টায় আছে।
দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা এখন খুব ভালো উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী এ জন্য শক্তিশালী নীতিকে কৃতিত্ব দেন। তিনি দাবি করেন, ২০১৫ সালে দেশে প্রথমবারের মতো বিদ্যুতের উদ্বৃত্ত থাকবে।
সরকারি ব্যাংক ও বিমা প্রতিষ্ঠানের পুঁজিবাজারে আসার প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘ব্যাংক ও বিমা প্রতিষ্ঠানগুলো আমাকে বলল, পুঁজিবাজারে আসব। কিন্তু দু-একটি ছাড়া কেউই এল না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তারা যে অঙ্গীকার করেছে, সেটা তাদের পালন করা উচিত।’
অর্থমন্ত্রী অবশ্য মূল্যস্ফীতিকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন।
আলোচনা: এ কে আজাদ বলেন, এ বছর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৯২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু তা অর্জিত হবে না। এর মূল কারণ তারল্যসংকট। বাজেটে বলা ছিল, সরকার ব্যাংক থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেবে। কিন্তু প্রথম পাঁচ মাসেই সরকার নিয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা। তাই ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের জন্য ঋণ পাচ্ছেন না।
এ কে আজাদ বলেন, ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে এখন সুদ দিতে হচ্ছে ১৭ থেকে ২১ শতাংশ পর্যন্ত। আবার মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।
এভাবে ব্যাংকে তারল্যসংকট ও সুদের হার বেশি থাকলে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করবে না উল্লেখ করে এ কে আজাদ বলেন, বিনিয়োগ না হলে সরকারের রাজস্ব আয় হবে না। প্রবৃদ্ধিও হবে না। সরকারকে আবার ঋণ নিতে হবে।
এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ব্যাংকগুলো যে যেভাবে পারছে সেখানে ঋণের সুদের হার বাড়াচ্ছে। তা ছাড়া অনেক ব্যাংকই সময়মতো বিলের টাকা পরিশোধ করে না।
সভায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ না। আমি জুতা বানাই। উৎপাদিত পণ্যের ৮০ শতাংশ রপ্তানি করি। আর ২০ শতাংশ দেশের চাহিদা থাকে। বিশ্বমন্দা চললেও দেশে চাহিদা বাড়ছে। আমার বিক্রিও বাড়ছে। তাহলে কীভাবে অর্থনীতির অবস্থা খারাপ হয়।’
পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, চলমান ও বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিতে টানাপোড়েন দেখা দিতেই পারে। বিশ্বমন্দার কারণে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না, আবার দেশীয় বিনিয়োগও বাড়ছে না। এগুলো আসলেই সমস্যা। তবে অর্থনীতির সবগুলো সূচকেই ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থা ভালো বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এফবিসিসিআইয়ের সভাপতির সঙ্গে দ্বিমত করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন বলেন, গত ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আয় হয়েছে। আর গোটা অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা শুধু অর্জনই নয়, অতিক্রমও করতে পারবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এনবিআর বহির্ভূত খাত থেকে ২৫ শতাংশ কর (ট্যাক্স) আদায় হওয়ার কথা। তা হচ্ছে না। জমির ওপর করের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৩১ শতাংশ। কিন্তু এখন পর্যন্ত হয়েছে মাত্র সাত-আট শতাংশ। এসব জায়গায় হাত দেবে কে?’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘অনেক সময় সমস্যার ‘‘কুইক’’ (দ্রুত) সমাধান করতে গিয়ে নতুন সমস্যার তৈরি হয়। কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টগুলো সে রকমই।’ তিনি অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল কিংবা সার্বভৌম বন্ড ছেড়ে ঋণ নেওয়ার বিরোধিতা করে বলেন, এতে সংকট আরও বাড়বে।
মতবিনিময় সভায় অন্যদের মধ্যে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান জায়েদি সাত্তার ও নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর, এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী, বিজিএমইএর সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদার, মেট্রো চেম্বারের সহসভাপতি নিহাদ কবির, ঢাকা চেম্বারের সহসভাপতি হায়দার আহমেদ খান প্রমুখ বক্তব্য দেন।

No comments

Powered by Blogger.