মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু-কিছু কেন্দ্রে পুরোনো প্রশ্নে নতুনদের পরীক্ষা

মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরুর দিনেই ঢাকার কয়েকটি পরীক্ষাকেন্দ্রসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুরোনো সিলেবাসের প্রশ্নপত্রে নতুন পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও এ রকম অদল-বদল প্রশ্নপত্রে কিছুক্ষণ পরীক্ষা নেওয়ার পর আবার প্রশ্নপত্র পরিবর্তন করে পরীক্ষা নেওয়া হয়।


এতে অনেক পরীক্ষার্থী ভালোভাবে পরীক্ষা দিতে পারেনি। বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থী ফল খারাপের আশঙ্কা করছে। এ নিয়েভুক্তভোগী পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা ক্ষোভের পাশাপাশি উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। কোথাও কোথাও সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভসহ ক্ষোভ প্রকাশের ঘটনা ঘটেছে। একই ধরনের ভুল রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় কীভাবে হলো, তা তদন্ত করে বোর্ডের চেয়ারম্যানদের প্রতিবেদন দিতে বলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
গতকাল বুধবার সারা দেশে মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়। মাধ্যমিকে প্রথম দিন ছিল বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র সরবরাহে অদল-বদলের ঘটনা ঘটে। ঢাকার মিরপুর বাংলা উচ্চবিদ্যালয়, নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, কেরানীগঞ্জের জিনজিরা পিএম পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রসহ ভোলা, কুড়িগ্রাম, টাঙ্গাইলের ঘাটাইল, মির্জাপুর, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, শ্রীমঙ্গলসহ দেশের বেশ কিছু কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র সরবরাহে এই ভুল করা হয়। এসব কেন্দ্রে অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি ২০১১ সালের সিলেবাসে করা প্রশ্নপত্র দেওয়া হয় নতুন শিক্ষার্থীদের। নতুন পরীক্ষার্থীদের পাওয়ার কথা ছিল ২০১২ সালের সিলেবাসে করা প্রশ্নপত্র।
জানতে চাইলে শিক্ষাসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাদের অসতর্কতার কারণে এটি হয়েছে, তা জানিয়ে প্রতিবেদন দিতে শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানদের বলা হয়েছে। পাশাপাশি পরীক্ষার্থীদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সে বিষয়টিও খেয়াল রাখা হবে।’ তিনি জানান, ইতিমধ্যে এ ঘটনায় কুমিল্লায় দুজন ও বরিশালের পাথরঘাটায় একজন কেন্দ্রসচিবকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে আন্তশিক্ষা বোর্ড ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান ফাহিমা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কম-বেশি সব বোর্ডেই এ ধরনের কিছু ভুলের ঘটনা ঘটেছে। যারা এই গাফিলতি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর শিক্ষার্থীদের যাতে ক্ষতি না হয়, সে বিষয়টি বিবেচনা করেই আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’
রাজধানীর মিরপুর বাংলা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের ২০১২ সালের নতুন এক পরীক্ষার্থী প্রথম আলোকে জানায়, তাদের ২০১১ সালের সিলেবাসের প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা হয়। সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের পরীক্ষা পূরণ সিলেবাসেই নেওয়া হয়। পরে বিষয়টি জানার পর বহু নির্বাচনী অংশের পরীক্ষা নেওয়া হয় নতুন সিলেবাসের প্রশ্নপত্রে।
মিরপুর ১১ নম্বরে অবস্থিত এই বিদ্যালয় গিয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা বিদ্যালয়ের মাঠে জড়ো হয়েছেন। তাঁরা সবাই বিমর্ষ। পরীক্ষা ও অভিভাবকেরা জানান, বিদ্যালয়ের চারটি কক্ষে নিয়মিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে পুরোনো সিলেবাসের প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়। নাজনীন আশরাফি, শাহনাজ বেগমসহ বেশ কয়েকজন অভিভাবক তাঁদের সন্তানের ফল নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন।
এই ঘটনা নিয়ে পরীক্ষা শেষে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা স্কুলের সামনের সড়কে জড়ো হলেও পুলিশ ও র‌্যাবের বাধার কারণে তাঁরা বিক্ষোভ করতে পারেননি।
নবাবপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রেও একই ধরনের ভুল হয়েছে। শেরেবাংলা বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রীরা এখানে পরীক্ষা দিচ্ছে। একজন অভিভাবক বলেন, এই কেন্দ্রে ২০১১ সালের সিলেবাসের প্রশ্নপত্রে নতুন শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা শুরু করে কিছু উত্তর লেখার পর ভুলটি ধরা পড়লে তাড়াহুড়ো করে আবার ২০১২ সালের সিলেবাসের প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়া হয়।
কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান, উপজেলার জিনজিরা পি এম পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের তিনটি কক্ষে ভুল প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা হয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা ওই কেন্দ্রের অধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবি করেছেন। কলেজের অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা পরীক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ২০ মিনিট সময় দিয়েছি, যাতে তারা উত্তরপত্র লেখার পর্যাপ্ত সময় পায়।’
কুমিল্লা থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, বরুড়ার বাতাইছড়ি উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে পুরোনো পরীক্ষার্থীদের ২০১২ সালের সিলেবাসের প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়। ৪৫ মিনিট পর তারা হল পর্যবেক্ষকদের বিষয়টি অবহিত করলে প্রশ্ন পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। পরে বাড়ি গিয়ে পরীক্ষার্থীরা বিষয়টি তাদের অভিভাবকদের জানালে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত আমড়াতলী বাজারে সড়ক অবরোধ করা হয়।
বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কায়সার আহমেদ বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রসচিবকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে পরীক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।’
প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর অনুযায়ী, কুড়িগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে, টাঙ্গাইলের ঘাটাইল মডেল পাইলট উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রের ছয়টি কক্ষে, কুলাউড়া উপজেলার নবীন চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে, ভোলা সরকারি বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রের ১৬ নম্বর কক্ষে, হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার একটি কেন্দ্রে, মির্জাপুর পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে, মির্জাপুর কলেজ ও বাঁশতৈল উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে, শ্রীমঙ্গলের সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন শিক্ষার্থীদের পুরোনো প্রশ্নপত্র দেওয়ার ঘটনায় বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়।
প্রশ্নে ভুল: প্রশ্নপত্র অদল-বদলের পাশাপাশি বহু নির্বাচনী অংশের দুটি প্রশ্নেও ভুল ছিল বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ‘গ’ সেটের ২৮ নম্বর প্রশ্নে যে উত্তর দেওয়া আছে, সেটি সঠিক নয় বলে জানিয়েছেন একজন শিক্ষক। তবে ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এস এম ওয়াহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের ভুলের কথা কেউ বলেনি, খোঁজ নিয়ে দেখবেন।’
প্রথম দিনে বহিষ্কার ৩৮: এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার প্রথম দিনে গতকাল ১০টি বোর্ডে বহিষ্কার হয়েছে ৩৮ জন ছাত্র ও দুজন শিক্ষক (মাদ্রাসার)। বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৫ জনই দাখিলের। বাকিরা অন্যান্য বোর্ডের। গতকালের পরীক্ষায় পরীক্ষার্থী ১২ লাখ ৬৬ হাজার ৪৬১ জনের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল সাত হাজার ৩৪৫ জন। তবে একা বা দুই বিষয়ে ফেল করা পুরোনো পরীক্ষার্থীসহ এবার মোট পরীক্ষার্থী ১৪ লাখের বেশি।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ রাজধানীর ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাইস্কুল কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন শিক্ষাসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নোমান উর রশীদ, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ফাহিমা খাতুন প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.