গতকাল সমকাল-উভয় সংকটে পাকিস্তান ও আমাদের শিক্ষণীয় by ফারুক চৌধুরী

গত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১১-এর রাতে কাবুল থেকে একজন আত্মীয় এবং সুহূদের একটি ই-মেইল পেলাম। এক লাইনের সেই বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘আমরা নিরাপদ আছি।’ আমার এই আত্মীয়টি বাংলাদেশি আমেরিকান। তাঁর আমেরিকান সহধর্মিণী কাবুলের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে কর্মরত রয়েছেন এবং দূতাবাস কম্পাউন্ডেই তাঁদের বাস।


ই-মেইলটি থেকে আঁচ করলাম যে সেই দূতাবাস সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছে। তার অব্যবহিত পরই জানা গেল, সেখানে সন্ত্রাসী হামলায় অন্তত ১৬ জন ব্যক্তি নিহত হয়েছে। কাবুলের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের অবস্থান এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্বন্ধে আমার মতো যাঁদের সামান্যতম ধারণাও রয়েছে, তাঁরা বুঝবেন যে সেখানকার নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ভেদ করার জন্য সন্ত্রাসী আঘাত হানতে পারদর্শিতা, ক্ষমতা এবং ক্ষিপ্রতার প্রয়োজন রয়েছে। আমার আত্মীয়টি তাই নিকটজনের কাছে বার্তা পাঠিয়ে তাঁর কুশল জানানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। কিন্তু তাঁর বার্তা এও স্পষ্ট করল যে আফগানিস্তানে তালেবান জঙ্গিবাদীরা এখন কয়েক বছর আগের তুলনায় অনেক বেশি তৎ পর হয়ে উঠেছে।
আমরা জানি, এই হামলা এখন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে এবং সেই দুই দেশের মধ্যে বৈরিতা এখন চরমে। তার কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী সেনাধ্যক্ষ অ্যাডমিরাল মাইক মালেন অভিযোগ করেছেন যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সাহায্যপুষ্ট হাক্কানি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এই কুকাণ্ডটি ঘটিয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, তাদের ইতিপূর্বের সংশ্লিষ্টতাও প্রমাণ করে যে হাক্কানি নেটওয়ার্ক আইএসআইয়ের ‘একটি বাহু’। হাক্কানি সন্ত্রাসীরা মূলত আফগানিস্তানভিত্তিক, যারা অন্য অনেকেরই মতো পাঁচ কোটি পশতুন অধ্যুষিত আফগানিস্তান-পাকিস্তান উন্মুক্ত সীমান্তের দুই পাশে সক্রিয় রয়েছে। তারপর অবশ্য প্রেসিডেন্ট ওবামা এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বেসামরিক অনেক প্রতিনিধি ইংরেজি ভাষার বিশাল ভান্ডার থেকে চয়ন করে কিছু কম আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করেছেন। তবে এই পদক্ষেপ সম্ভবত পূর্বপরিকল্পিত, কারণ অ্যাডমিরাল মাইক মালেনের মতো একজন উর্দি পরিহিত বিদায়ী সামরিক কর্মকর্তার পক্ষে সরকারের অনুমোদন ছাড়া একটি বিদেশি রাষ্ট্রকে জড়িয়ে এই ধরনের বক্তব্য দেওয়া সম্ভব নয়। পাকিস্তানের ক্ষমতাধর সেনাধ্যক্ষ জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানি এবং সেই সরকারের নবনিযুক্ত স্পষ্টভাষী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা রাব্বানি খার এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এও বলেছেন যে এই ধরনের অভিযোগের জন্য যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের মৈত্রী হারাতে পারে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির সভাপতিত্বে সেই দেশের ৩২টি রাজনৈতিক দলের ৫০ জন নেতা একটি বিরল সম্মেলনে প্রায় সাত ঘণ্টা আলোচনার পর (মনে ভাবনা জাগে, কোনো রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে বাংলাদেশে আমরা কি তা অনুষ্ঠিত করতে পারব!) ঘোষিত হয়েছে যে অ্যাডমিরাল মালেনের অভিযোগটি ভিত্তিহীন এবং অপমানজনক। সব মিলিয়ে সেই সভায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পাকিস্তানের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে মতৈক্য লক্ষ করা গেছে। এখানে লক্ষণীয় যে জেনারেল জিয়াউল হক অথবা জেনারেল পারভেজ মোশাররফের শাসনকালের তুলনায় বিতর্কিত হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানে এখন একটি জনপ্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচিত সরকার রয়েছে, সেই কারণে অ্যাডমিরাল মালেনের উক্তির বিরুদ্ধে এই যাত্রায় পাকিস্তান একটি রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে। এদিকে পাকিস্তানে একটি শঙ্কা বিরাজ করছে যে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব অবজ্ঞা করে (অ্যাবোটাবাদে পাকিস্তানের অগোচরে ওবামা বিন লাদেন নিধন এবং পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ঘন ঘন ড্রোন আক্রমণ ইত্যাদি দ্রষ্টব্য) যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের হাক্কানি নেটওয়ার্কের কথিত অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালাতে পারে। উপমহাদেশ আর পূর্ব এশিয়ায় এমন রাষ্ট্র খুব কমই রয়েছে, যদি তা আদৌ থেকেই থাকে, যার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব যুক্তরাষ্ট্র আর তার দোসরেরা নির্দ্বিধায় লঙ্ঘন করেই যাচ্ছে। এর কারণ হলো পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক রাষ্ট্রকর্তাদের জনবিচ্ছিন্ন স্বেচ্ছাচারী নীতি।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি সেদিন বললেন, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সঙ্গে রাখতেও পারছে না, ছাড়তেও পারছে না। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নীতিনির্ধারক জনপ্রতিনিধি ‘অতি পুরোনো ভৃত্য’ পাকিস্তান সম্বন্ধে ‘ছাড়ালে না ছাড়ে, কি করিব তারে’ দ্বন্দ্বে ভুগছেন। এদিকে বুশ সাহেবের বোমাবাজি থেকে শুরু করে একটি দশক ধরে অর্থহীন, ধ্বংসাত্মক আর রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর যুক্তরাষ্ট্রের বোধোদয় হয়েছে যে আফগানদের ‘ডান্ডা মেরে ঠান্ডা’ করা যাবে না। তাই ২০১৪ সালের মধ্যেই তারা আফগানিস্তান থেকে পাততাড়ি গোটানোর আয়োজন করছে। যুক্তরাষ্ট্র আর তার দোসরদের এখন বক্তব্য এরকম যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আফগানরাই দেশের ‘নিরাপত্তা’ রক্ষা করতে পারবে। এই প্রত্যাশা, অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে, একান্তই অবাস্তব।
আফগানিস্তানে তালেবানরা এখন আবার চূড়ান্ত বিজয়ের স্বপ্ন দেখছে। তাই তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র আর কারজাই সরকারের আলোচনার প্রস্তাব তারা আমলেই আনছে না। বরং যেসব আফগান নেতা শান্তি স্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছেন, তাঁদের হত্যা করতেও তারা দ্বিধা করছে না। তাই পাকিস্তান এখন উভয় সংকটে। আফগানিস্তানে তারা তালেবাননির্ভর হতে চায়, আর পাকিস্তানে হতে চায় যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর। উর্দুতে বলে, ‘খেয়াল আচ্ছা হ্যায়, মগর হ্যায় নামোমিকন’—চিন্তা ভালোই কিন্তু তা অসম্ভব। আঞ্চলিক রাজনীতির টানে তার বাস্তবায়ন দুষ্করই হবে।
অতীতে একটু ফিরে যেতেই হয়। পাকিস্তান আর তালেবান-শাসিত আফগানিস্তানের সম্পর্ক এককালে ভালোই ছিল। পাকিস্তানের সেনাধ্যক্ষ হিসেবে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ১২ এপ্রিল ১৯৯৯ সালে করাচিতে একটি সেমিনারে একটি তাৎ পর্যপূর্ণ উক্তি করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম এবং তাঁর বক্তব্যটি ১৩ মে ১৯৯৯-এ প্রথম আলোতে আমার ‘পাকিস্তান ও তালেবান’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে ছাপা হয়েছিল। সেদিন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ আফগানিস্তানে পাকিস্তানের তালেবানদের সমর্থনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। তাঁর মতে, সেই সময়ে আফগানিস্তানের ৩১টি প্রদেশের ২৬টিই ছিল তালেবানদের আয়ত্তাধীন। তিনি সেদিন বলেছিলেন যে একমাত্র তালেবানরাই আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা আনতে সক্ষম, কারণ তারাই হচ্ছে জাতীয় পর্যায়ে সেই দেশের একমাত্র সংগঠিত শক্তি। যেহেতু আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা পাকিস্তানের জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে, পাকিস্তানের উচিত তালেবানদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখা। যদি পাকিস্তান এই সমর্থন প্রত্যাহার করে তাহলে আফগানিস্তানের অরাজকতা আরও ঘনীভূতই হবে এবং তা হবে পাকিস্তানের স্বার্থ পরিপন্থী। এদিকে তিনি কিন্তু ছিলেন পাকিস্তানের ভূখণ্ডে তালেবানদের প্রভাব বিস্তারের বিরুদ্ধে সচেতন। তিনি সেদিন এই আশা প্রকাশ করেছিলেন যে ভবিষ্যতে একটি স্থিতিশীল আফগানিস্তানের ওপর অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে পাকিস্তান তালেবান-শাসিত সেই দেশকে তার কট্টরবাদিতা ও চরমপন্থী মনোভাব পরিহার করাতে সক্ষম হবে।
তার কিছুদিন পরই পারভেজ মোশাররফ নাটকীয়ভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করলেন। তালেবান আফগানিস্তানের সঙ্গে শুরুতে তিনি পাকিস্তানের সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখলেন। আফগানিস্তানের তালেবান সরকার বহির্বিশ্বে তাদের একমাত্র রাষ্ট্রদূত আবদুস সালাম জায়েফকে নিযুক্ত করল। এল আমেরিকার বিরুদ্ধে নয়-এগারোর জঙ্গি আক্রমণ। বুশ সাহেব ঘোষণা করলেন তাঁর সাবধানবাণী—‘সন্ত্রাস দমনে (অর্থাৎ আফগানিস্তান আক্রমণে) হয় আপনারা আমার সঙ্গে, নইলে বিপক্ষে।’ ভড়কে গেলেন পারভেজ মোশাররফ। গণেশ উল্টে গেল। গদি রক্ষার জন্য তিনি সন্ত্রাসবিরোধী সংগ্রামে বুশের দোসর সেজে গেলেন। কোনো জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকারে তা সম্ভব হতো না। তাঁর অবস্থানের ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন করে মোশাররফ আমেরিকানদের ক্রীড়নক হয়ে গেলেন।
মনে আছে নয়-এগারোর ছয় সপ্তাহ পরই ২২ অক্টোবর ২০০১ সালে, ইসলামাবাদে আমি তালেবান রাষ্ট্রদূত আবদুস সালাম জায়েফের একটি সাক্ষাৎ কার নিয়েছিলাম, যা তখনই ‘পাকিস্তানে আফগান রাষ্ট্রদূত আবদুস সালাম জায়েফের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎ কার: অক্টোবর ২০০১’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছিল। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস যে সেই সাক্ষাৎ কারের দুই মাসের মাথায় ২ জানুয়ারি ২০০২ সালে এই পারভেজ মোশাররফ রাষ্ট্রদূত আবদুস সালাম জায়েফকে অত্যন্ত অন্যায় ও কাপুরুষোচিতভাবে বন্দী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের হাতে তুলে দিলেন। একজন রাষ্ট্রনায়কের নিজের দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল।
আমি যখন ২২ অক্টোবর আবদুস সালাম জায়েফের সাক্ষাৎ কার নিয়েছিলাম, তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান সম্বন্ধে আমার কিছু বলার নেই।’ তিনি হয়তো তখনই পারভেজ মোশাররফের মতিগতি আঁচ করতে পেরেছিলেন। চার বছরেরও বেশি সময় আমেরিকার গুয়ানতানামো কারাগারে কাটিয়ে দেশে ফিরে আবদুস সালাম জায়েফ মাই লাইফ উইথ তালেবান শীর্ষক একটি আগ্রহ উদ্দীপক বই লিখেছেন। পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি না ঘটিয়ে আমি সেই বই থেকে পাকিস্তান সম্বন্ধে মাত্র একটি উদ্ধৃতিরই বঙ্গানুবাদ দিচ্ছি। তিনি বলছেন, ‘তাদের (পাকিস্তান) এক মুখে দুই জিহ্বা এবং এক মাথায় দুই মুখ রয়েছে, যাতে তারা প্রত্যেকের ভাষাই বলতে পারে, প্রত্যেককে ব্যবহার করতে পারে, প্রত্যেককে প্রতারিত করতে পারে। তারা নিজেকে পারমাণবিক রাষ্ট্র হিসেবে জাহির করে ইসলাম আর মুসলমান দেশকে রক্ষার নামে আরবদের প্রতারিত করে, তারা সন্ত্রাসবিরোধী কর্মকাণ্ডে আমেরিকা আর ইউরোপের সঙ্গে যোগ দিয়ে তাদের চুষে খায় এবং কাশ্মীরে জিহাদের নামে তারা পাকিস্তান আর বিশ্বের মুসলমানদের ঠকিয়েই যাচ্ছে। পর্দার অন্তরালে তারা সবার সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করে থাকে...।’
বইটি যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জায়েফের মনোভাব অনায়াসেই বুঝতে পারবেন। তিনি আসলে নয়-এগারোতে প্রীত ছিলেন না মোটেও। তাঁর দেশের ওপর আঘাত আসবে, এই শঙ্কা ছিল তাঁর মনে। চার বছরে গুয়ানতানামো কারাগারে তাঁর বিরুদ্ধে আমেরিকানরা কিছুই পায়নি। তিনি একটি মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পেয়েছেন, যাতে তিনি বলেছেন তিনি ‘যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড বা সামরিক অভিযানে’ অংশ নেবেন না। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক মূল্যায়নে যথেষ্ট দৈন্য রয়েছে। সেটাই ছিল জায়েফের দুর্ভাগ্য। তাই উইকিলিকসের প্রকাশিত তথ্যে আমাদের অতিরিক্ত উৎ সাহী হওয়ার কোনো কারণ নেই। যাই হোক, জায়েফ এখন কাবুলেই আছেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় নন, তবে মনে হয় তালেবানরা তাঁর সম্বন্ধে কোনো বিরূপ ভাব পোষণ করে না।
বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হয়, জায়েফের বিরূপ মন্তব্য সত্ত্বেও, পাকিস্তানের আফগানিস্তান নীতি আবার তালেবাননির্ভর হয়েই উঠছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত আর কারজাই সরকার একটি তালেবানবিরোধী অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। চীন সেই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনতে খুবই আগ্রহী এবং জিনজিয়াং প্রদেশে পাকিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইসলামি জঙ্গিদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও তারা পাকিস্তানের আফগানিস্তান নীতির ওপর সংবেদনশীলই রইবে। আফগানিস্তানের বিবর্তনের ওপর ইরানের ক্রমবর্ধমান আগ্রহ তালেবানদের শক্তি জোগাতে পারে। তবে যা-ই ঘটুক না কেন পাকিস্তানের কথায় এবং কাজে আপাতত ব্যবধান থেকেই যাবে।
তার প্রধান কারণ হলো পাকিস্তানের নড়বড়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামো। এই কাঠামো নড়বড়ে হওয়ার কারণ অনেক। তার মাঝে রয়েছে ১৯৪৭-এর পর দেশটিকে একটি সাংবিধানিক ভিত্তি দিতে বিলম্ব করা (১৯৫৬ পর্যন্ত পাকিস্তানে কোনো সংবিধান ছিল না আর ‘নামকাওয়াস্তে’ সেই সংবিধানটিও ১৯৫৮ সালে বাতিল হয়ে গেল), সাময়িক স্বার্থে ঘন ঘন সংবিধান সংশোধন (১৯৭৩-এর সংবিধানটি ইতিমধ্যে বোধ হয় ১৯ বার সংশোধিত হয়েছে) রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার, ধর্মব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক স্বার্থে আশকারা দেওয়া এবং রাজনৈতিক প্রাত্যহিকতার সঙ্গে দেশের মৌলিক স্বার্থের গোল পাকিয়ে ফেলা। পাকিস্তানের এই আয়নায় আমরা কি আমাদের নিজেদের প্রতিবিম্ব কিছুটা হলেও দেখি না?
আমাদের মনে রাখতে হবে যে পাকিস্তান অথবা আফগানিস্তানের মতোই বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান নাজুক, যা বিভিন্ন কারণে দিন দিনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই দেশে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক ক্ষমতাধরদের আগ্রহ বাড়ছে, তাদের স্বার্থের পরিধিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশে যদি কোনো অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তার একটা আঞ্চলিক এমনকি বৈশ্বিক মাত্রা থাকবেই। যা হয়তো গত শতাব্দীতে ততটা ছিল না। আমাদের প্রতিবেশী, আঞ্চলিক এবং ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, কৌশলগত এবং স্ট্র্যাটেজিক কারণে আমাদের দেশে তাদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখা এবং বর্ধনে সচেষ্ট রইবে। তা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ উৎ সাহিত করবে। বিদেশি নেতারা, এমনকি ঢাকার চুনোপুঁটি রাষ্ট্রদূতেরা আমাদের ‘গণতন্ত্রে’ দীক্ষা দিতে লিপ্ত হয়ে যাবেন। আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য তা বিপজ্জনক। পাকিস্তান তা এখন হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে। আমাদের বুঝতে হবে যে বর্তমানের সংকুচিত পৃথিবীতে একটি দেশের, বিশেষ করে, উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সংঘাত আর অরাজকতার একটি বৈদেশিক মাত্রা রয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যবহারবিধিতে তাই আমাদের পরিপক্বতা আনতে হবে, জাতীয় স্বার্থে হতে হবে সহনশীল ও সমঝোতা মনোভাবাপন্ন। নইলে বিদেশি টানাহেঁচড়ায় আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল হয়ে যাবে এবং শারীরিক দুর্বলতার মতোই নানা প্রকার ব্যাধি, তথা অবাঞ্ছিত বিদেশি হস্তক্ষেপকে প্রশ্রয় দেবে। কথাটি সব সময়ের জন্যই প্রযোজ্য, তবে নির্বাচন-পূর্ব আগামী দুই-আড়াই বছর, আমাদের এই বাস্তবতার দিকে শ্যেন দৃষ্টি রাখতেই হবে। বাংলাদেশের মতো সমস্যাসংকুল একটি রাষ্ট্র, অদূরদর্শী রাজনীতির জন্য যে দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে যেতে পারে, পাকিস্তানই তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
 ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net

No comments

Powered by Blogger.