প্লেটভরা পোকামাকড় by শেখ রোকন

জীবনানন্দ দাশ যদিও ফড়িংয়ের জীবন পাওয়ার জন্য হাহাকার করেছেন; চীনের রাস্তায় গেলে দেখতে পেতেন তার এবং আরও অনেকের প্রিয় এ পতঙ্গ কী জীবনযাপন করে! বেশ কয়েক মাস আগে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির 'মাই শট' বিভাগে বেইজিংয়ের ফুটপাত থেকে তোলা এমন একটি আলোকচিত্র চোখে পড়েছিল।


আমাদের দেশে রাস্তায় যেভাবে আমড়া বিক্রি করা হয়, সেভাবে একেকটি বাঁশের শলাকায় পোড়া ঘাসফড়িং মালার মতো করে গাঁথা। খোলা খাবার বা 'স্ট্রিট ফুড' হিসেবে রাস্তার পাশে সাজিয়ে রাখা। কেবল চীনে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে গোটা মহাদেশেই ঘাসফড়িং জনপ্রিয় খাবার। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকাতেও তৈরি হয় ঘাসফড়িংয়ের নানা উপাদেয় আইটেম। অনেকে মেক্সিকোতে কেবল ছুটে যান এই পতঙ্গের তৈরি খাবার 'চ্যাপুলাইনস' খেতেই। মধ্যপ্রাচ্যে ঘাসফড়িং ভোজন রীতিমতো শিল্প_ গোধূলি বা উষায় মশাল জ্বালিয়ে, সূক্ষ্ম জাল ফেলে ঘাসফড়িং ধরা হয়। তারপর লবণ মেশানো গরম পানিতে ভিজিয়ে, মরু রোদে শুকিয়ে অন্যান্য খাবারের সঙ্গে ঘাসফড়িংয়ের শুঁটকি খায় আরবরা।
'আর্মি অ্যান্ট' খাদ্য হিসেবে কতটা জনপ্রিয় জানা নেই, তার ডিমের কথা বলা যাক। খাবার হিসেবে পিঁপড়ার ডিমের চাহিদা তুঙ্গে। মেক্সিকোর জনপ্রিয় ডিশ এস্কামোলসের মূল উপাদান এটি। উত্তর-পূর্ব ভারত ও মিয়ানমার-থাইল্যান্ডে প্রায় একই ধরনের একটি আইটেম ঝাল তরকারির সঙ্গে চাটনি হিসেবে পরিবেশিত হয়। জনপ্রিয় থাই সালাদ ইয়ুম যে আসলে পিঁপড়ার ডিম ও ভ্রূণের তৈরি তা-ও নিশ্চয়ই অনেকে জানেন।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল তার এক কলামে লিখেছিলেন কম্বোডিয়ার অভিজ্ঞতা। জাতিসংঘ শুভেচ্ছা দূত হিসেবে তিনি গিয়েছিলেন সেখানকার এইচআইভি পজিটিভ তরুণীদের হস্তশিল্প শেখাতে। নমপেন থেকে গাড়িতে করে গ্রামের পথে চলছেন। পাশে বসা কম্বোডীয় তরুণী মাঝে মধ্যেই কাগজের ঠোঙা থেকে কিছু একটা বের করে লবণ মাখিয়ে খেয়ে নিচ্ছে। কৌতূহলী বিবি রাসেল দেখলেন, ঠোঙা ভরা টিকটিকি আর তেলাপোকার শুঁটকি!
সন্দেহ নেই, অন্য কীটপতঙ্গও খাদ্য হিসেবে বিশ্বের বৃহত্তর অংশে জনপ্রিয়। বলা চলে দক্ষিণ এশিয়া ও ইউরোপ ছাড়া সর্বত্র। জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গোটা বিশ্বে ১৪শ'র বেশি 'প্রোটিন সমৃদ্ধ' পোকামাকড় খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ইউরোপেও অবশ্য কীটপতঙ্গ খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয় করার চেষ্টা অনেকদিন ধরে চলেছে। প্রায় দেড়শ' বছর আগে, সেই ১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ কীটতত্ত্ববিদ ভিনসেন্ট এম হল্ট পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন_ 'হোয়াই নট ইট ইনসেক্টস'। তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন, পায়ের কাছেই যেখানে এত সুস্বাদু খাবার অনাদরে পড়ে আছে, ইউরোপীয়রা হিলি্ল দিলি্ল দৌড়াদৌড়ি করছে কেন? বলা বাহুল্য, খাদ্য উদ্বৃত্তের (যেভাবেই হোক) ইউরোপে তার উদ্যোগ হালে পানি পায়নি। উল্টো নানাভাবে সমালোচিত হয়েছেন। কে না জানে, খাদ্য সংকটে নাকাল বিশ্বে অর্গানিকওয়ালাদের যুক্তিতর্ক যখন ক্ষুধার রাজ্যে গদ্যময় হয়ে গেছে, ইউরোপে জেনেটিক্যালি মোডিফায়েড ফসল তখনও ব্রাত্য। কিন্তু হল্টের প্রত্যাশিত সময় বোধহয় এসে গেছে। জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বলছে, এ বছর অক্টোবরে পূরণ হওয়া সাতশ' কোটি পেট ভরাতে আগামী দিনগুলোতে খাদ্য হিসেবে পোকামাকড়ের তালিকা দীর্ঘ হবে। কেবল এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা বা আফ্রিকা নয়, ইউরোপের কোনো কোনো দেশেও চীনের ফুটপাতের দৃশ্য জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে। সে ধাক্কায় দক্ষিণ এশিয়ার অনাগত কোনো কবি যদি সংস্কার ঝেড়ে ফেলে ফড়িংয়ের জীবন পাওয়ার বদলে খোদ ফড়িংকেই নিজের জীবন বাঁচানোর কাজে লাগান, অবাক হওয়ার কী আছে?
skrokon@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.