বহু সংস্কৃতিবাদের দিন কি ফুরাল?-ইউরোপ by সেঁজুতি শুভ আহ্মেদ

আমি জানি না তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেমন হবে। তবে আমি জানি চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ কী দিয়ে হবে আর তা হলো প্রস্তর খণ্ড।'_আলবার্ট আইনস্টাইন। কোনো কিছু প্রগতির চূড়ান্ত সীমায় পেঁৗছালে তা একসময় ধ্বংস হয়ে আবার যে প্রথম থেকে শুরু হওয়ার সম্ভাবনা_ আইনস্টাইনের উক্তির মধ্যে এমন ইঙ্গিত পাই।


ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই পশ্চিমা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় উদারনীতির যে ক্রমবিকাশ তা বুঝি ভোল পাল্টে ঢিমেতালে চলা রক্ষণশীল খ্রিস্টীয় মৌলবাদের বিকাশকেই ত্বরান্বিত করছে। ইউরোপজুড়ে অভিবাসী আইন ও বহু সংস্কৃতিবাদের বিরুদ্ধে যে অসন্তোষ দীর্ঘদিন ধরে দানা বেঁধে উঠেছে, মৃদু ভূকম্পনের মতো খ্রিস্টীয় উগ্রবাদের মাধ্যমে ইতিমধ্যে যে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেনি, তা নয়। তবে সম্প্রতি নরওয়েতে অ্যান্ডারস বেরিং ব্রেইভিকের নৃশংস সন্ত্রাসী হামলা ও দেড় হাজার পৃষ্ঠার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীতে খ্রিস্টীয় মৌলবাদের সহিংস সন্ত্রাসবাদের নতুন রূপ উন্মোচিত হলো। অথচ ইউরোপে অভিবাসন প্রক্রিয়া ও বহু সংস্কৃতিবাদের গোড়াপত্তনে ইউরোপীয়দেরই কি সর্বাধিক প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়নি? ইতিহাস তো সে কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। শিল্প বিপল্গবের পরপর পশ্চিমা বিশ্বে যখন শ্রম সংকটে উৎপাদন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ার উপক্রম তখন অভিবাসন আর মেধা আমদানির মধ্য দিয়ে শিল্প-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ইউরোপ আজকের স্বর্ণশিখরে পেঁৗছতে পেরেছে। আরও পেছনে তাকালে দেখতে পারব অভিবাসন, বহু সংস্কৃতিবাদ, বর্ণবাদী নিপীড়ন, জাতিগত সহিংসতা ও রক্তক্ষয়ী দাস বিদ্রোহে দাস ব্যবসার ভূমিকা নিছক কম নয়। ষোড়শ শতকের বেশ আগে থেকেই বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন দেশে দাস ব্যবসা টুকটাক চলছিল। তবে জন হকিন্স প্রথম জ্ঞাত ব্রিটিশ প্রাইভেটর, যিনি ১৫৬২ সালে আফ্রিকান মানুষদের আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ক্যারিবীয় অঞ্চলে বিক্রয়ের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে দাস ব্যবসার সূত্রপাত করেন। পরবর্তীকালে আজকের ইংল্যান্ডই ইউরোপ-আমেরিকাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়_ দেখ, মানুষ কেনাবেচায়ও জব্বর ব্যবসা। আজকের আধুনিক ইউরোপ দাঁড়িয়ে আছে সেই ক্রীতদাস, ভিনদেশি বণিক শ্রেণী ও অভিবাসীদের নুন-ঘাম মিশ্রিত শিরদাঁড়ার ওপর। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যবহারে আজ যখন মানবশক্তি আর কায়িক শ্রমের চাহিদা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে, তখন ইউরোপ-আমেরিকার রক্ষণশীল উগ্রবাদী রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এসব উগ্রবাদীর অনেকেই অভিবাসীদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করার মনোভাব পোষণ করে। স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোতে খ্রিস্টীয় রক্ষণশীলদের দৌরাত্ম্যকে উদ্বেগজনকই বলা যায়। ইংল্যান্ডে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নাগরিকত্ব_ সব ক্ষেত্রে অভিবাসীদের আইনি অধিকার ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা কাটছাঁটের পাঁয়তারা চলছে। তবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, ইউরোপীয়দের পূর্বপুরুষরা নিজেদের স্বার্থেই যে অভিবাসীদের সামনে মুলা ঝুলিয়ে পাশে স্থান দিয়েছিল, তাদের প্রয়োজন এখন ফুরিয়ে গেছে বলে এ প্রজন্মের ইউরোপীয় উগ্রবাদীরা যদি চিন্তা-ভাবনা করে থাকে_ হোঁচট খাবে নিশ্চিত। কাল সকালেই অভিবাসীরা সব তল্পিতল্পা গুটিয়ে ইউরোপ ছেড়ে বেরিয়ে যাক_ দেখা যাবে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর একাঙ্গীকরণ, তাদের মেধা-মনন ও প্রচেষ্টার বৈচিত্র্যে দীর্ঘদিনের সোশ্যাল ফেব্রিক ও উন্নয়নের অব্যাহত ধারা ভীষণভাবে ভেঙে পড়বে। অবশ্যম্ভাবী এই পরিণতির কথা মাথায় আছে বলেই হয়তো অভিবাসী প্রসঙ্গে রক্ষণশীল উগ্রবাদীদের ভাবাদর্শে বিভক্তি লক্ষ্য করা যায়। অনেকে চায় অভিবাসী থাকুক তবে নেটিভদের সমান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে নয়। কোন এক সময় এক জার্মান মন্ত্রী তো বলেই ফেলেছিলেন, 'আমরা শ্রমিক এনেছিলাম আর এখন দেখছি আমরা মানুষ এনেছি!' শ্রমিক যে মানুষ নয়, ইউরোপীয়দের এই সভ্য (?) চিন্তা ওই জার্মান মন্ত্রীর উক্তি অপেক্ষা আর কী সুন্দরভাবে পরিস্টম্ফুট করতে পারে? এ পথে ভাবলেও যে স্ববিরোধিতা বৈ কিছু নয়_ উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক আদর্শে (যা ইঙ্গ-ইউরোপীয় কর্তৃক বিশ্বব্যাপী প্রচারিত) অভিবাসী শ্রেণীকে কোণঠাসা করার জো নেই। অনেকে ইউরোপী নেতৃত্ববলয়ে ইউর‌্যাবিয়ার আশু প্রভাব নিয়ে মহাচিন্তিত। এদের আশঙ্কা, ইসলামীকরণের মাধ্যমে ইউরোপীয়দের একক কর্তৃত্ব আবার হাত ফস্কে না যায়। এমন আশঙ্কা ইসলামভীতির অংশ। ইসলামভীতির অনেকটাই সযত্নে তৈরি করে বাজারে ছেড়েছে পশ্চিমা মিডিয়াচক্র। এই মিডিয়াগুলো যেন বুঝেও বুঝতে চায় না_ মৌলবাদ, উগ্রবাদ, চরমপন্থা, সন্ত্রাসবাদের মতো শব্দগুলো
ওসামা বিন লাদেন আর ইসলামের পেটেন্ট করা সম্পদ নয়।

সেঁজুতি শুভ আহ্মেদ : শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
theclayman.man@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.