মুহূর্তেই ছিন্ন স্নেহের বাঁধন

স্কুল থেকে ফিরে বাবাকে ক্লাসে প্রথম হয়ে পাওয়া পুরস্কার দেখাবে বলে কথা দিয়েছিল ছোট্ট সিদরাতুল। কিন্তু স্কুলে সে আর পৌঁছাতে পারেনি। বাবাও আর মেয়ের সঙ্গে পুরস্কারের আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারেননি। তার বদলে বেদনায় বিমূঢ় হলেন বাবা, পরিবার। বাসের চাকার নিচে হারিয়ে গেল সবকিছু।


গতকাল বুধবার সকালে রাজধানীর মিরপুর ১৪ নম্বরে বাসের তলায় পিষ্ট হয়ে মারা গেছে সিদরাতুল মুনতাহা ওরফে পালোমা (৮)। সে ছিল ইব্রাহিমপুরে অবস্থিত মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়ের ২ নম্বর শাখার দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী।
শিশু সিদরাতুলের মায়ের কষ্টটা কি আন্দাজ করা যায়! তাঁর হাত ধরেই রাস্তা পার হচ্ছিল সিদরাতুল। আর তখনই ঘটেছিল মর্মন্তুদ সেই ঘটনা।
প্রত্যক্ষদর্শী, পুলিশ ও পরিবারের সূত্র জানায়, মা শাহিদা সুলতানা গতকাল সকালে মেয়ে সিদরাতুল ও ভাইয়ের মেয়ে মুসাররাত মোস্তাফিজকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছিলেন। সকাল পৌনে আটটার দিকে তাঁরা একটি হিউম্যান হলার থেকে মিরপুর ১৪ নম্বরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের সামনে নামেন। শাহিদা শিশু দুটির হাত ধরে মনিপুর স্কুলে যাওয়ার জন্য রাস্তা পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় মিল্ক ভিটা কোম্পানির একটি স্টাফ বাস এসে পিষে দেয় ছোট্ট সিদরাতুলকে। পথচারীরা এগিয়ে এসে রক্তাক্ত শিশুটিকে নিয়ে যান কচুক্ষেতের হাইটেক কেয়ার হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। মা শাহিদা হাসপাতালে কয়েকবার মূর্ছা যান।
দুর্ঘটনার পর পথচারীরা দৌড়ে গিয়ে মিল্ক ভিটা কোম্পানির বাসটি আটক করে। তারা বাসের চালক রহিজুল ইসলামকেও ধাওয়া করে ধরে ফেলে।
সিদরাতুলের মামাতো বোন প্রত্যক্ষদর্শী মুসাররাত জানায়, হঠাৎ একটি বাইসাইকেল এসে ফুফুকে ধাক্কা দিলে তিনি রাস্তায় পড়ে যান। হাত থেকে ছুটে যায় সিদরাতুল। সঙ্গে সঙ্গে তাকে চাপা দেয় ছুটে আসা বাসটি।
সিদরাতুলের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে ইব্রাহিমপুরের মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক বাসচালকের ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। তাঁরা মিরপুর ১৪ নম্বরের প্রধান সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। এ সময় বিক্ষুব্ধ লোকজন ওই বাসটিসহ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করে।
ক্ষুব্ধ শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা তিন দফা দাবিতে মানববন্ধনও করেন। দাবিগুলো হলো: মিরপুর ১৪ নম্বর শহীদ স্মৃতি কলেজের সামনের সড়কে ফুটওভারব্রিজ স্থাপন, সড়কের ওপর দুই ধারে গতিরোধক বসানো এবং স্কুল চলার সময় নির্দিষ্ট স্থানে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা করা। বেলা একটার পর বিদ্যালয়ের মাঠে শোক সমাবেশ ও নিহত শিক্ষার্থীর জন্য দোয়া করা হয়।
কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল লতিফ প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়ায় তাঁরা রাস্তা থেকে সরে যান।
ইব্রাহিমপুরের মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মনজুর মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, সিদরাতুল ইংরেজি মাধ্যমের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। তার রোল নম্বর ছিল ১। মেধাবী এই শিক্ষার্থীকে হারিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই শোকার্ত।
সিদরাতুলের বাবা তেজগাঁও কলেজের কর্মকর্তা খালেদ আজমল খান সন্ধ্যায় বাদী হয়ে গাড়িচালককে আসামি করে মামলা করেছেন। আটক রহিজুলকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
শোকে স্তব্ধ বাড়ি: গতকাল দুপুরে মিরপুর ১ নম্বরে জনতা হাউজিংয়ের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, সিদরাতুলের মা বিছানায় নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছেন। মাঝেমধ্যেই প্রলাপ বকছেন।
একমাত্র সন্তানকে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করে ঘরে ফিরেই কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা খালেদ আজমল। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন মেয়ের কৃতিত্বের কথা: ‘মেয়েটা আমার ওয়ান থেকে টুয়ে ওঠার সময় ইংলিশ ভার্সনে ফার্স্ট হয়েছিল। স্কুল থেকে পুরস্কার দিয়েছে। কিন্তু তখন সুন্দরবনে বেড়াতে যাওয়ার কারণে ও পুরস্কার নিতে পারেনি। সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় বলে গেছে, আজকে বড় ম্যাডামের কাছ থেকে পুরস্কার নিয়ে আসবে।...’
আর বলতে পারলেন না বাবা খালেদ আজমল। তাঁকে যে সান্ত্বনা দেবে, সেই ভাষা যেন হারিয়ে ফেলেছেন স্বজনেরা।

No comments

Powered by Blogger.