চারদিক-করতোয়ায় নৌকাবাইচ

তাঁরা কেউ মাঝি-মাল্লা নন। করতোয়া নদীতে ১ অক্টোবর যাঁরা করতোয়া নদীতে নৌকাবাইচে অংশ নিলেন, তাঁদের অনেকেই জানতেন না নৌকাবাইচ কাকে বলে। তাঁদের সবার বাড়ি পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার আশপাশের গ্রামে। পেশা তাঁদের নৌকা নিয়ে দিনভর নদীর বুকে ভেসে বেড়ানো আর মাছ ধরা।


তাঁরাই সেদিন নেমে গেলেন নৌকাবাইচে! প্রতিযোগীদের মধ্যে বেশির ভাগ তরুণ হলেও চোখে পড়ে বেশ কজন চুল-দাড়ি পাকা প্রবীণ লোকের। শরীরে জোর নেই, প্রতিযোগিতায় নেমেছেন শুধু মনের জোরে। প্রবীণদের মধ্যে কেউ কেউ আবার জুড়ি বা করতালের টুং-টাং বাজনা বাজিয়েছেন। তালে তালে প্রতিযোগীরা মুখে ‘হেঁইও হেঁইও’ আওয়াজ তুলে বৈঠা চালিয়ে একে অপরকে পেছনে ফেলার চেষ্টা করেছেন। সবার মাঝে দেখা যায় উৎসবের আমেজ। রংপুর বিভাগে এ ধরনের প্রতিযোগিতা হওয়ার খবর খুব একটা পাওয়া যায় না।
এ নৌকাবাইচ দেখতে পঞ্চগড়ের পাঁচ উপজেলা; নীলফামারী, ডিমলা, ডোমার, জলঢাকা; ঠাকুরগাঁওসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষের ঢল নামে। বিকেল চারটায় নৌকাবাইচ শুরু হলেও দুপুরের পর থেকে লোকজন আসতে থাকে। সবাই এসে ভিড় করতে থাকেন দেবীগঞ্জের চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু, নদীর দুই ধার আর ডিসি পার্কে। ব্রিজের ওপর দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড়ে প্রায় দুই ঘণ্টা যান চলাচল করতে পারেনি। জনপ্রিয় এ খেলা প্রত্যক্ষ করে অসংখ্য মানুষ।
নৌকাবাইচ উপলক্ষে দেবীগঞ্জকে সাজানো হয়েছিল বর্ণিল সাজে। এলাকায় ছিল উৎসবের আমেজ। প্রতিযোগিতা উপলক্ষে সকাল থেকে ওই এলাকায় ছিল সাজ সাজ রব। চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু ও গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো রঙিন পতাকায় সাজানো হয়। আশপাশের বাড়িগুলোতে দূর-দূরান্তের আত্মীয়স্বজনে ছিল ভরপুর। ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা, চিৎকার-চেঁচামেচি, ঢাকঢোল আর হাততালিতে গোটা এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে।
দেবীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত এ প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন পঞ্চগড়-২ (বোদা-দেবীগঞ্জ) আসনের সাংসদ নুরুল ইসলাম।
দেবীগঞ্জের উত্তরপাড়া গ্রামের লতিফ মাস্টারের ধাপ থেকে ব্রিজের পশ্চিম পাড় পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ জলপথ পাড়ি দিতে হয় প্রতিযোগীদের। এতে অংশ নেয় ছোট ও বড় মিলিয়ে ২৬টি নৌকা। বড় ও ছোট নৌকা নিয়ে দুটি গ্রুপে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। পুরস্কারের ব্যবস্থাও রাখা হয় আলাদা আলাদা।
বড় নৌকায় প্রথম হয় টেপ্রিগঞ্জ ইউনিয়নের রামগঞ্জ বিলাসী গ্রামের দুলাল দাসের দল ও দ্বিতীয় হয় চেংঠিহাজরাডাঙ্গার শুকুর আলীর দল। প্রতিটি দলে ছিলেন ১৫ জন করে। ছোট নৌকায় প্রথম হয় টেপ্রিগঞ্জ ইউনিয়নের নগরপাড়া গ্রামের আলন দাসের দল, দ্বিতীয় হয় দেবীগঞ্জ উত্তরপাড়া গ্রামের মো. মোবারক হোসেনের দল। প্রতিটি নৌকায় ছিলেন পাঁচজন করে। এদের মধ্যে দুটি গ্রুপের প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকারীদের হাতে পুরস্কার হিসেবে তুলে দেওয়া হয় ২১ ইঞ্চি ও ১৪ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশন। এ ছাড়া প্রত্যেক প্রতিযোগীর জন্য ছিল বিশেষ পুরস্কার। প্রথম হওয়া বড় নৌকার দলের দুলাল দাস বলেন, এ ধরনের খেলায় অংশ নিয়ে জিতে তাঁর খুব আনন্দ লাগছে। তিনি পেশাদার মাঝি নন। নৌকায় করে নদীতে মাছ ধরেন। ‘প্রথম হয়ে নিজে যেমন খুশি হয়েছি, আবার হাজার হাজার দর্শককেও আনন্দ দিতে পেরে ভালো লাগছে।’ একই কথা বলেন ছোট নৌকার দলের প্রধান আলন দাস।
প্রতিযোগিতার আহ্বায়ক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল মালেকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পঞ্চগড়-২ (বোদা-দেবীগঞ্জ) আসনের সাংসদ নুরুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে জেলা প্রশাসক মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, পুলিশ সুপার মো. শাহারিয়ার রহমান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু জাফর, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ স ম নুরুজ্জামান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী, প্রতিযোগিতার সদস্যসচিব ও শালডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান হাসনাত জামান চৌধুরী বক্তব্য দেন।
পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র আলম বলে, ‘নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা দেখে খুব মজা পেয়েছি, আনন্দ করেছি।’ ঠাকুরগাঁওয়ের গড়েয়া থেকে এসেছেন আহসানুল হক (৪৫)। তিনি বলেন, ‘হেঁইও হেঁইও আওয়াজ তুলে বৈঠা চালাচ্ছিল, তা দেখে ভালো লেগেছে। এমন প্রতিযোগিতা এবারই প্রথম দেখলাম।’
দেবীগঞ্জের উত্তরপাড়ার গৃহবধূ মরিয়ম বেগম কোলে শিশু নিয়ে প্রতিযোগিতা দেখতে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রথম এ প্রতিযোগিতা উপভোগ করলাম।’
সাংসদ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘এমন আয়োজন সত্যিই মনোমুগ্ধকর। একই সঙ্গে লাখো মানুষকে অনাবিল আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি আমাদের লোকজ ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হয়েছে।’ তিনি আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান।
জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, ‘নৌকা হচ্ছে এ অঞ্চলের জীবন-জীবিকার মাধ্যম। পাশাপাশি ঐতিহ্যের ধারক। ভবিষ্যতে এটাকে আরও বড় আঙ্গিকে করতে জেলা প্রশাসন সহযোগিতা ও উদ্যোগ নেবে।’
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল মালেক বলেন, ‘গ্রামবাংলার লোকজ উৎসবের মধ্যে রয়েছে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির পরিচয়।’ প্রতিবছর এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করার কথা জানান তিনি।
প্রতিযোগিতার সদস্যসচিব ও শালডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান হাসনাত জামান চৌধুরী বলেন, ‘এমন প্রতিযোগিতা আমরা প্রতিবছর আয়োজন করব।’
 শহীদুল ইসলাম শহীদ
পঞ্চগড় প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.