সুদিনের অপেক্ষায় থাকি by রউফুল আলম

সম্রাট শাহজাহানের কন্যার চিকিৎসার মাধ্যমে জনৈক ইংরেজ চিকিৎসক ইংরেজদের বাণিজ্যের জন্য ভারতবর্ষে প্রথম কুঠি স্থাপনের রাষ্ট্রীয় সম্মতি আদায় করেন (দৃষ্টিপাত-যাযাবর)। শুরু সেখান থেকেই, তারপর পলাশীর আম্রকাননে যে সূর্য অস্ত গেছে তা উদিত হয় প্রায় দুইশ' বছর পর। শুধু এই বাংলায় জন্ম নিয়েছেন মজনু শাহ, তিতুমীর, মাস্টারদা, প্রীতিলতাসহ অনেক বীর ও বীরাঙ্গনা; প্রাণ দিয়েছেন অসংখ্য। শিক্ষা নিতে হয় ইতিহাস থেকে, দৃষ্টি হতে হয় দূরদর্শী।


ভারত, পাকিস্তান, রুশ কি আমেরিকা কেউই কেবল বন্ধু নয়, সেটা যারা দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন তাদের বোঝার মতো ঢের জ্ঞান থাকা চাই, আবার শুধু শত্রুতার গন্ধ খুঁজে সম্পর্ক শীতল করাও চলে না_ দরকার যুগোপযোগী ভারসাম্য ও বিচক্ষণতা। প্রতিবেশী রাষ্ট্র যেমন ভালো বন্ধু, তেমনি বড় শত্রুও বটে। বাণিজ্য আর সংস্কৃতির আগ্রাসন শুরু হয় সেখান থেকেই। পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সব বিষয়ে সরকার রাষ্ট্রের স্বার্থকে অক্ষুণ্ন রেখে বিচক্ষণতার সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করবে_ গণমানুষের চাওয়া সেটাই।
বড় দায়িত্ব নেওয়ার মানেই হলো বেশি ত্যাগ স্বীকার করা; বড় আসনকে আঁকড়ে রেখে মানুষকে শোষণ নয়। ক্ষমতার দাম্ভিকতা ও অপব্যবহার এ দেশের মাটিতে তীব্র আকারে দেখা দিয়েছে। রাষ্ট্রের সেবক প্রতিটি মানুষ, কিন্তু গুরুভার থাকে কিছু মানুষের হাতে_ তারা নেতা, তারা প্রতিনিধি; তারা আদর্শে হয় দৃঢ়, ব্যক্তিত্বে ঋজু। তারা কর্মে পারঙ্গম ও দায়িত্বে সচেতন।একুশ শতকে খলিফা উমরের মতো হয়তো দরিদ্র ও অভাবী মানুষের দ্বারে দ্বারে কান পাতা সম্ভব নয়; কিন্তু জনগণের কান্না শুনে ব্যথা ঘোচানোর নিরলস প্রচেষ্টা থাকা চাই। জাতির মুক্তির জন্য এ কালেও ম্যান্ডেলা ও মাহাথির উদাহরণ হতে পারে।
একজন অদক্ষ চালকের হাতে যেমন কিছু যাত্রী অনিরাপদ, তেমনি একজন অপরিণামদর্শী মন্ত্রীর হাতে দেশের বহু মানুষ অনিরাপদ। দেশের দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থার বেহাল চিত্র যখন প্রতিদিন গণমাধ্যমগুলোতে ফুটে উঠছে, তখন যোগাযোগমন্ত্রীর 'সততা পরীক্ষিত' বলে আত্মপ্রতিষ্ঠার এই চেষ্টা অবিমৃষ্যকারিত্ব বৈ কিছু নয়। মানুষ ভুলের ঊধর্ে্ব নয়। নিজ থেকে ভুল বুঝে দায়িত্ব থেকে সরে গেলে মানুষের পুষ্পমাল্য না পেলেও ঘৃণা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ক্ষমতাকে আঁকড়ে নিরাপত্তা আর চাটুকারদের বূ্যহের ভেতর থেকে মানুষের ক্ষোভ তিনি এখনও ঠাহর করতে পারেননি।
সাধারণ মানুষ সংগ্রামী_ নিজেকে ভালোবাসে, নিজেকে জীবন-সংগ্রামে টিকিয়ে রাখতে চায়, জয়ী হতে চায়। এ রকম অসংখ্য মানুষের প্রত্যয় ও সামনে অগ্রসরের প্রচেষ্টাই এ দেশকে এত দূর এনেছে। জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এই গতিকে ত্বরান্বিত করার জন্য ত্যাগী রাষ্ট্র প্রতিনিধির বড় অভাব ছিল সময়ে সময়ে। যে কোনো দেশ ও জাতির জন্য নিঃসন্দেহে এটা খুব ভয়ানক ব্যাপার। এতে করে মানুষের সমষ্টিগত প্রচেষ্টায় ভাটা পড়ে, শ্লথ হয় রাষ্ট্রের অগ্রগতি। জাতির দায়িত্ব যদি রাষ্ট্র নিতে না পারে রাষ্ট্রের দায়িত্বে মানুষের উদাসীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমাদের রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ড ও পতাকার জন্য মহান ত্যাগের ধারাবাহিকতায় জাতীয় মুক্তির মন্ত্রে এখনও আমরা সফল হতে পারিনি। কিন্তু থেমে নেই পৃথিবী, সেটাই বড় ভয়। সমগ্র পৃথিবী যখন বড় বড় অর্থনৈতিক সুনামির শিকার হয়, তখন আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের মানুষের হাড়েই মোচড় পড়ে আগে। উন্নত দেশগুলো যখন বাণিজ্যের জাল গুটায় তখন আমরাই ধরা পড়ি শিকারের জালে।
প্রতিদিন এ দেশে প্রাণের বিনাশ হয়, মরে স্বপ্ন। জঠরের ক্ষুধা মরে তীব্র আঘাত করে, ভালোবাসা মরে। এত দুঃসময়েও আমরা যেন প্রতিনিয়তই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ব্রতী। এখনও এখানে মানুষ হাসে, কী নির্জলা! মানুষ স্বপ্নাহত হয়েও স্বপ্নের আভরণে মোড়ায় নিজেকে। আমাদের কণ্ঠে যেন কী প্রত্যয় আর দৃঢ়তার সুর। এখনও যেন শুনি_'এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা' বেজে উঠে দিকে দিকে। আমরা সুদিনের অপেক্ষায় থাকি অহর্নিশ।
স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডেন
redoxrouf@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.