তিস্তার পানি বণ্টন-অবাক করা, তবে অভাবিত নয় by জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী

বাংলাদেশের মন্ত্রীরা এটাও সফরের পর বলেছেন যে, তিস্তার পানি নিয়ে চুক্তি না হলে ভারতকে 'ট্রানজিট' সুবিধা দেওয়া যাবে না। কিন্তু এই তিস্তার পানি নিয়ে যিনি আলোচনা এবং বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে বিচরণ করছেন, তিনি হলেন কিছুটা অবিশ্বাস্যভাবে হলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের ফলাফলের পটভূমিতে যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা এবং বিতর্কের সঞ্চারণ ঘটেছে,


তা হলো তিস্তা নদীর পানি নিয়ে দুটি দেশের মধ্যে প্রত্যাশিত চুক্তিতে উপনীত হওয়ার ব্যর্থতা। যদিও আশা করা গিয়েছিল এবং এই ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে, এই সফরের সময় ঢাকার দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিস্তা চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হবে, শেষ পর্যন্ত সেটা হয়ে ওঠেনি। ফলে এই সফরের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, যদিও অন্যান্য বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে এবং কিছু বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া বিরাজ করছে। তবে সবচেয়ে ছাপিয়ে যে বিষয়টি আলোচনা, বিশ্লেষণে এবং বিতর্কে প্রাধান্য পাচ্ছে সেটা হলো তিস্তা নদীর পানি নিয়ে চুক্তি এবং একই সঙ্গে ট্রানজিট সুবিধা নিয়ে চুক্তি শেষ পর্যন্ত না হওয়া। এই 'ট্রানজিটে'র বিষয়টি নতুন দিলি্লর দৃষ্টিকোণ থেকে একটি অগ্রাধিকারের ইস্যু থাকায় এই ক্ষেত্রে অগ্রগতি না হওয়ায় ভারতের জন্য হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। এই ট্রানজিটের কারণে ভারত বেশকিছু সুযোগ-সুবিধার প্রত্যাশা করে আসছিল এবং বাংলাদেশও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনায় বিচরণ করেছে। কিন্তু দুটি বিষয়ই ড. মনমোহন সিংয়ের সফরের সময়ে অর্জিত হয়নি এবং এমন ধারণাই বিদ্যমান যে, বাংলাদেশকে তিস্তার পানি না দেওয়ার কারণে ঢাকা নতুন দিলি্লকে 'ট্রানজিট' সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে চুক্তি সই করেনি। অবশ্য ট্রানজিট সুবিধা নিয়ে বিভ্রান্তিও বিরাজমান এই কারণে যে, অনেকেই বলছেন বিভিন্নভাবেই ভারতকে এই সুবিধা বাংলাদেশ আগেই দিয়েছে এবং শুধু বিস্তারিতভাবে সবকিছুতে সম্মত হওয়ার পালা। এটা নিয়েও মতের ভিন্নতা রয়েছে এবং অনেকের বিভিন্ন মাত্রার বক্তব্যের কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে সর্বাগ্রে আলোচনায় আছে তিস্তার পানি। তিস্তার এই প্রত্যাশিত চুক্তির ব্যর্থতা নিয়ে বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় দেশেই আলোচনা ও বিতর্কের শেষ নেই, এ কারণে দুটি দেশেই বিষয়টি বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে এই ব্যর্থতার জন্য বিরোধী দল সরকারকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করেছে এবং সাধারণভাবে জনগণের মধ্যেও এই ব্যর্থতার জন্য হতাশা সৃষ্টি হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তা ছাড়া সরকারের মধ্যেও এ বিষয়ে বেশ মতবিরোধ পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং সংবাদপত্রের সূত্র অনুযায়ী মন্ত্রিসভার বৈঠকে এ জন্য দু'জন উপদেষ্টাকে প্রধানত দায়ী করা হচ্ছে, যারা ড. মনমোহনের সফরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। আবার সরকারের প্রভাবশালী কয়েকজন মন্ত্রী বলেছেন, আগামী তিন মাসের মধ্যে তিস্তার পানি নিয়ে চুক্তি সম্ভব হবে। অথচ ড. মনমোহনের ঢাকায় আসার আগ পর্যন্ত বলা হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হচ্ছে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত এটা না হওয়ার কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ঢাকায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশের মন্ত্রীরা এটাও সফরের পর বলেছেন যে, তিস্তার পানি নিয়ে চুক্তি না হলে ভারতকে 'ট্রানজিট' সুবিধা দেওয়া যাবে না। কিন্তু এই তিস্তার পানি নিয়ে যিনি আলোচনা এবং বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে বিচরণ করছেন, তিনি হলেন কিছুটা অবিশ্বাস্যভাবে হলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি সংযোগ রক্ষা করার কথা নয় এ কারণে যে, ব্যাপারগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে। যেহেতু তিস্তার পানির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিভিন্নভাবে সংশ্লিষ্টতা আছে, তাই এ ব্যাপারে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর কোনো অবস্থান ও ভূমিকা থাকলে সেটা নীতিগতভাবে ভারত সরকারের বিষয়। নয়াদিলি্ল সরকার প্রধানমন্ত্রীর সফরে বাংলাদেশের কাছাকাছি পাঁচটি ভারতীয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের ঢাকায় আসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে। অন্য চারজন মুখ্যমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ঢাকায় এলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ পর্যন্ত আসেননি এবং এটা স্পষ্টতই এ কারণেই যে, তিনি তিস্তার পানি বণ্টনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত হতে চাননি এবং সে কারণে চুক্তিটিও হয়নি।
এটা সত্য যে, মমতার অবস্থানের কারণে এই চুক্তি হয়নি এবং সে কারণে তিনি এখন বাংলাদেশে নেতিবাচকভাবে প্রচণ্ডভাবে আলোচিত এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিন্দিত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিকূলতার জন্য চুক্তিটি হতে পারেনি বলে উভয় দেশেই ধারণা বিরাজ করছে। ভারত সরকারও এমন ধারণাই দিয়েছে যে, মমতার শেষ মুহূর্তের অনিচ্ছায়ই প্রত্যাশিত তিস্তা চুক্তি হয়নি। বাংলাদেশে মমতাবিরোধী বক্তব্যই বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। অথচ কয়েক মাস আগে মমতা যখন পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিশাল জয় অর্জন করেন, তিনি এ দেশেও সমাদৃত হন। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তাকে অভিনন্দনবার্তা পাঠিয়েছিলেন। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকায় তাই বাংলাদেশে অনেকেই অবাক হয়েছেন।
কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে এটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক, তিনি তার রাজ্যের এবং স্বীয় রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্যই এমন ভূমিকা পালন করেছেন। কেননা তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, বাংলাদেশ কিংবা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নন। সে ক্ষেত্রে কথা উঠতে পারে, তিনি এটা শেষ মুহূর্তে করলেন কেন? তার ঘনিষ্ঠ মহল বলেছে তিস্তার চুক্তির যে রূপরেখা কেন্দ্রীয় সরকার তাকে অবগত করেছিল, সেটা পরিবর্তন হয় এবং মমতাকে পর্যাপ্তভাবে 'ব্রিফ' করা হয়নি। যাই হোক, সেটা ভারতের নিজস্ব ব্যাপার।
তবে বিষয়টি বাংলাদেশেও বিতর্কের ঊধর্ে্ব নয় এবং অনেকেই মনে করছেন পরোক্ষভাবে মমতার সঙ্গে ঢাকার প্রয়োজনীয় সংযোগ হয়নি। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ঢাকার পক্ষে গঙ্গার পানি চুক্তিতে সহায়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন। তৎকালীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ ও পানিসম্পদমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক তার সঙ্গে কলকাতায় দেখাও করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন নৈকট্য এবং বাস্তবতার আলোকেই এটা করা হয়েছিল। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সংযোগের পাশাপাশি কলকাতার সঙ্গেও যোগাযোগ রাখা হয়। জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেব গৌড়কে চুক্তির পক্ষে প্রভাবিত করেছিলেন এবং বাংলাদেশ সরকার বাস্তবসম্মত নীতির পরিচয় দিয়ে সাফল্য পেয়েছিল। এবার এটা কতদূর হয়েছে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। অনেকেই হয়তো মনে করছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এমনি বৈরিতার মনোভাব নেওয়া ঠিক হয়নি। কিন্তু তাকে কি সত্যিই দোষ দেওয়া সঙ্গত! মমতা শিগগির নিজে নির্বাচন করছেন রাজ্য বিধানসভার সদস্য হওয়ার জন্য এবং মনে করা যেতে পারে, তিনি এ বিষয়টিও মাথায় রেখেছেন। তা ছাড়া রাজনৈতিকভাবে মিত্র হলেও তিনি সোনিয়া-মনমোহনের কংগ্রেসের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর নির্ভরশীল নন। বরং ছোট দল হলেও তার তৃণমূল কংগ্রেসেরই বেশি প্রয়োজন কংগ্রেসের কাছে। ভারত সরকারেরই মূলত দায়িত্ব ছিল মমতাকে নমনীয় করানো। আবার বাংলাদেশে কেউ কেউ মনে করছেন, সম্পূর্ণ বিষয়টিই নাকি 'পাতানো খেলা'। বিভিন্ন কারণে সেটা হয়তো তীব্র নেতিবাচকতার প্রতিফলন। তবে সাফল্য-ব্যর্থতার বিষয়টিতে স্বাভাবিকভাবেই এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে চলে আসে।

জগ্লুল আহ্মেদ চৌধূরী : সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদির বিশ্লেষক
 

No comments

Powered by Blogger.