শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির থাবা

সোলায়মান তুষার: শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির থাবা পড়েছে। ফলে পিছিয়ে পড়েছে উন্নয়ন আর অগ্রগতি। দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংকের চাপ রয়েছে সরকারের ওপর। দুর্নীতি আর অনিয়মের কারণে এক বছরের ব্যবধানে উন্নয়ন অগ্রগতি দুই ভাগ কমে গেছে। এটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরই হিসাব। দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বৈঠকেও। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বর্তমানে ৬৫টি উন্নয়ন প্রকল্প চলছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতি ছিল ১৩ ভাগ। আর ২০১১-১২ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১১ ভাগে। এসব    পৃষ্ঠা ৮ কলাম ১
প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ১২৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের  ১২৯৭ কোটি টাকা- যা মোট প্রকল্পের ৬১ ভাগ। এছাড়া প্রকল্প সাহায্য ৮২৭ কোটি টাকা- যা মোট প্রকল্প বরাদ্দের ৩৯ ভাগ। ২০১১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মোট অর্থ অবমুক্ত হয়েছে ৪৯৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা- যা মোট বরাদ্দের ২৩ ভাগ। ওইসময় পর্যন্ত অবমুক্ত অর্থের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ২৩৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা- যা মোট এডিপি বরাদ্দের ১১ ভাগ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সার্বিক অগ্রগতি নিয়ে ১৪ই নভেম্বর একটি বৈঠক হয় মন্ত্রণালয়ে। এতে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। বৈঠকে শিক্ষা সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী উল্লেখ করেন, অক্টোবর পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অগ্রগতি ১১ ভাগ। তিনি আরও বলেন, গত বছরের একই সময়ে অগ্রগতি ছিল ১৩ ভাগ। অর্থাৎ এবছর শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত অর্থবছরের চেয়ে ২ ভাগ পিছিয়ে। এ পর্যায়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে জানানো হয় যে, এ বছর এ পর্যন্ত মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রী উপবৃত্তি প্রকল্পের অর্থ ব্যয় না হওয়ায় অগ্রগতি কম হয়েছে। এ পর্যায়ে অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) বলেন, এটা যথাযথ যুক্তি হতে পারে না। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত ২০১০-১১ অর্থবছরের চেয়ে ২০১১-১২ অর্থবছরে প্রকল্পের উন্নয়ন কমে যাওয়ার খবর মোটেই সুখকর নয়। প্রকল্পের উন্নয়ন পেছানোর পেছনে কয়েকটি প্রকল্পে দুর্নীতির গন্ধ রয়েছে। বেশ কয়েকটি প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহান্সমেন্ট প্রজেক্ট। বিশ্বব্যাংকের অর্থ সহায়তায় ওই প্রকল্পের টাকা হরিলুট হয়েছে। এ প্রকল্পে দেয়া বিশ্বব্যাংকের ১১৮১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা নয় ছয় হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের চাপে সরকার প্রকল্পের পরিচালক, উপ-পরিচালকসহ ৮ কর্মকর্তাকে ওএসডি করেছেন। তবুও থামেনি দুর্নীতি। ২০০৮ সালের জুলাই মাসে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ পরিচালনায় চালু হয় এ প্রকল্প। এ প্রকল্পের ৯৯১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বিশ্বব্যাংকের। বাংলাদেশ সরকারের মাত্র ১৯০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা। প্রকল্পের শুরুতেই দুর্র্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ২০১০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ছিল শূন্য ভাগ। কিন্তু টাকা ব্যয় হয়েছে ঠিকই। ভুয়া ভাউচার দিয়ে প্রায় ২ কোটি টাকা আত্মসাৎ, অতিরিক্ত ইংরেজি ও গণিতের ক্লাস নেয়ার নাম করে প্রায় ২০ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং ৪৮টি ভুয়া স্কুলের নামে প্রায় ১৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। দুর্নীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ভবন ছাড়াই সংস্কার কাজ বাবদ ব্যয় দেখানো হয় ৪২ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের পুরাতন হোস্টেল ভবনের মেরামত কাজের ৪২ লাখ ৪৮ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়। কিন্তু মাউশি তদন্ত করে জানতে পারে, ওই বিদ্যালয়ে আগে কোন পুরনো হোস্টেল ভবন ছিল না। রাজধানীর একমাত্র মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ইডেনেও ১০ তলা ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১০ তলা ছাত্রী হোস্টেলও একই ভাবে ভুল নকশা করায় দ্বিতীয়বার কাজ করতে হয়েছে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনের চেয়ে ছোট বারান্দা করা হয়েছে দু’টি ভবনে। ৩০৬টি মডেল স্কুল প্রকল্পে নতুন করে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ৪৬৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ওই প্রকল্প চলছে। অনিয়ম ধরা পড়ায় বাতিল করা হয়েছে ১২টি উপজেলায় মডেল স্কুল স্থাপনের সিদ্ধান্ত। অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সরকারি বিদ্যালয়বিহীন উপজেলায় একটি করে মডেল স্কুল স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। বর্তমান সরকারের আমলে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণ, নিম্নমানের কম্পিউটার ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার অভিযোগ করা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরই একটি বৈঠকে। বর্তমানে ১০০টি মডেল স্কুল স্থাপনের কাজ চলছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সভায় বলা হয় নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করায় ১০০০ কম্পিউটার বাক্সবন্দি করে রাখা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে গত বছরের ১৪ই নভেম্বর মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হয়। তাতে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। সভায় ‘৩০৬টি উপজেলা সদরে নির্বাচিত বেসরকারি বিদ্যালয়সমূহকে মডেল বিদ্যালয়ে রূপান্তর’ শীর্ষক প্রকল্প সম্পর্কে বলা হয়, এ প্রকল্পের আওতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিতরণকৃত কম্পিউটার ও কম্পিউটার যন্ত্রপাতি ইনস্টল না করে বাক্সবন্দি অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। তাছাড়া, সরবরাহকৃত কম্পিউটারগুলোর গুণগতমান যথাযথ নয় মর্মেও সভাকে অবহিত করা হয়। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক জানান, তিনি বেশ কিছু বিদ্যালয় পরিদর্শন করেছেন। সেগুলো যথাযথভাবে ইনস্টল করা হয়েছে। তবে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ থাকলে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ পর্যায়ে উপ-প্রধান (পরিকল্পনা-২)-এর নেতৃত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আইসিটি সেলের একজন কর্মকর্তা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি সাব-কমিটি গঠন করে সরজমিন পরিদর্শনপূর্ব প্রতিবেদন প্রদানের জন্য বলা হয়। এবিষয়ে শিক্ষা সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, সেকেন্ডারি এডুকেশন কোয়ালিটি অ্যান্ড অ্যাকসেস এনহান্সমেন্ট প্রজেক্ট নিয়ে একটু সমস্যা হয়েছিল। প্রকল্প পরিচালকসহ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।  ৩০৬টি মডেল স্কুল প্রকল্পে নিম্নমানের কম্পিউটার সরবরাহ ও ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণ বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। জেনে বলতে হবে। প্রকল্পের অগ্রগতি ২ ভাগ কমে যাওয়ার কারণ কি জানতে চাইলে সচিব বলেন, আগামী মে মাস আসলে এটা বোঝা যাবে পিছিয়ে গেছে কিনা। তিনি বলেন, কোন প্রকল্পের টেন্ডার দিতে হয়তো দেরি হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এবারের উপবৃত্তি এখনও দেয়া হয়নি। এটা দেয়া হলে প্রকল্পের অগ্রগতি বেড়ে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.