চিংড়ি রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ইইউ’র

আশরাফ খান: চিংড়ি রপ্তানির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বাংলাদেশ থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোয় রপ্তানি করা মাছ ও মাছ-জাত পণ্যের ২০ শতাংশ বাধ্যতামূলক পরীক্ষার সিদ্ধান্ত আরোপ করা হয়েছিল গত বছরের ১৬ই নভেম্বর। এতে ইইউভুক্ত দেশগুলোয় বাংলাদেশের চিংড়ি রপ্তানি কমে যায়। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের চিংড়ি রপ্তানি    পৃষ্ঠা ১৭ কলাম ৪
উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৮-০৯ সালে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে মিঠা পানির গলদার বেশির ভাগ চালানে নিষিদ্ধ অ্যান্টিবায়োটিক নাইট্রোফিউরান পাওয়া যায়। ইউরোপের প্রবেশ বন্দরে রপ্তানি করা চিংড়ির চালান আটক করা হয়। এ রকম ৫৪টি গলদা চিংড়ির চালান সীমান্তে আটক করে বাংলাদেশের কাছে ‘র‌্যাপিড এলার্ট’ নোটিশ পাঠানো হয়। বাংলাদেশ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরও চিংড়িতে ক্রমাগত নিষিদ্ধ অ্যান্টিবায়োটিকস পাওয়ার কারণে ইউরোপে বাংলাদেশের চিংড়ি রপ্তানি নিষিদ্ধ ঘোষণার সমূহ আশঙ্কা দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ থেকে তাদের দেশগুলোয় রপ্তানি করা মৎস্য ও মৎস্য পণ্যের ২০ শতাংশ বাধ্যতামূলক পরীক্ষার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ফুড সেফটি রেগুলেশন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের নির্দেশনা জারি করে। বাংলাদেশের চিংড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে। এই কড়াকড়ির ফলে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয় ইউরোপের বিশিষ্ট নাইট্রোফিউরান বিশেষজ্ঞ ড. গ্লেন কেনেডিকে কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ করে। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা চিংড়ি নিয়ে গবেষণা চালানো হয় তাকে দিয়ে। বেলজিয়ামের একটি মাত্র গবেষণাগারে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা চিংড়ির উপর পরিচালিত গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে বাংলাদেশের চিংড়ির উপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এই গবেষণাগারে বাংলাদেশের চিংড়ির খোসা ও মাংস একত্রিত করে পরীক্ষা করা হয়। অথচ প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী খোসা বাদ দিয়ে শুধু মাংস পরীক্ষা করার কথা। এখানে তা করা হয়নি। তাছাড়া বেলজিয়ামের পরীক্ষাগারের ল্যাব প্রটোকল ছিল ইউরোপে প্রচলিত ও স্বীকৃত ল্যাব প্রটোকল থেকে ভিন্ন। বাংলাদেশের গলদা চিংড়ি বৃটেনের এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ল্যাবরেটরিতে নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। চিংড়ির খোসা ও মাংস পৃথক পৃথকভাবে পরীক্ষা করে মাংসে কোন নাইট্রোফিউরানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। খোসার উঁচুস্তরে নাইট্রোফিউরান পাওয়া যায়। পরীক্ষায় প্রতীয়মান হয় যে, গলদা চিংড়ি প্রাকৃতিকভাবেই দেহের মধ্যে নাইট্রোফিউরান তৈরি করে এবং তা খোসার মধ্যে সঞ্চিত থাকে। বিশেষজ্ঞ নাইট্রোফিউরান ড. গ্লান পরীক্ষায় একই ফল পান। নেদারল্যান্ডসের এক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীনভাবে গলদা, বাগদা ও কাঁকড়ার ওপর পরীক্ষা চালিয়ে একই ফল পেয়েছে। পরীক্ষার এসব ফল সম্পর্কে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোয় ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। ইইউ সদর দপ্তর বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস-এ সি ফুড ইমপোর্টার্স এলায়েন্স-এর উদ্যোগে এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এই সংগঠনটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের একমাত্র মাছ আমদানিকারক সংস্থা। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির ওপর র‌্যাপিড এলার্ট জারির ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলেন। সেমিনারে ইইউভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব উজ্জ্বল বিকাশ দত্ত এতে গবেষণালব্ধ ফলের চিত্র বিস্তৃতভাবে তুলে ধরেন। ইইউভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে যৌথ ও পৃথকভাবে কথা বলেন। বাংলাদেশের এই তৎপরতায় ভাল ফল পাওয়া যায়। ইইউ তাদের আরোপিত র‌্যাপিড এলার্ট প্রত্যাহার করে নেয়। উল্লেখ্য, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার উপর র‌্যাপিড এলার্ট জারি রয়েছে। মিয়ানমারের ওপরও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রেগুলেশন আরোপ করেছে। মিয়ানমার থেকে মাছ ও মাছ জাতপণ্য আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ থেকে গত বছর ৪ হাজার ৬০৩ কোটি টাকার চিংড়ি ও হিমায়িত মাছ রপ্তানি করা হয়। রপ্তানির পরিমাণ ৩১ লাখ টন। রপ্তানি আয়ের ৬০ শতাংশই আসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে। জোট আমলে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ২৩ লাখ টন। র‌্যাপিড এলার্ট জারি থাকার পরও বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির পরিমাণ ও রপ্তানি আয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। র‌্যাপিড এলার্ট প্রত্যাহারের ফলে রপ্তানির পরিমাণ অনেক বেড়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। সচিব উজ্জ্বল বিকাশ দত্ত বলেন, এক বছরে রপ্তানি আয় ৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.