দূতাবাসে সত্যায়ন, জনশক্তিতে ধসের আশঙ্কা

দীন ইসলাম: আত্মীয়-স্বজনের প্রচেষ্টায় বিদেশে কাজের অনুমতিপত্র পেয়েও রক্ষা নেই। সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস বা হাইকমিশন থেকে নিয়োগ সংক্রান্ত সব কাগজপত্র সত্যায়ন করাতে হবে। ঘুরতে হবে দূতাবাসের বারান্দায়। সত্যায়ন প্রক্রিয়া শেষ না হলে চাকরি নিয়ে বিদেশ যাত্রাও বন্ধ। গতকাল থেকে নতুন এ নিয়ম    পৃষ্ঠা ১৭ কলাম ৩
কার্যকর করেছে সরকার। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) বিষয়টির খারাপ দিক তুলে ধরে সরকারকে বোঝাতে চেয়েছে। গতকাল শেষ বারের মতো এ বিষয়ে যারপরনাই চেষ্টা করে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। নতুন এ নিয়ম কার্যকরের ফলে জনশক্তি রপ্তানি খাতে ধস নামবে বলে মনে করছেন জনশক্তি রপ্তানি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, বিদেশের শ্রম বাজার এমনিতে সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। এখন শুধু সম্পর্কের কারণে সংযুক্ত আরব আমিরাত আর সৌদি আরবে কিছুসংখ্যক শ্রমিকের নামে একক ভিসা দেয়া হচ্ছিল। সেটিও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের কারণে এখন ভেস্তে যেতে বসেছে। এর ফলে দেশের জনশক্তি রপ্তানিতে চরম ধস নামতে পারে। এর আগে গত মঙ্গলবার প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে হঠাৎ সার্কুলার জারি করে পাঠানোর পর থেকে রিক্রুটিং এজেন্সি ও সেখানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ওদিকে একক ভিসা প্রক্রিয়ায় দেশের ৯০ শতাংশ জনশক্তি রপ্তানি হয়ে থাকে। আগে তাদের সত্যায়ন না লাগলেও নতুন এই সিদ্ধান্তের ফলে এখন তারা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়বেন এবং দ্বারে দ্বারে ঘুরে কাজ হাসিল করতে হবে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭৬ লাখ ৯৯ হাজার ৯৫১ জন বিদেশে গেছেন। তাদের ৯০ শতাংশই গেছেন একক ভিসায়। তাই নতুন নিয়মে দেশের জনশক্তি রপ্তানিতে ধস নামার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, দুর্নীতি ও অনিয়ম রোধ করতে একক ভিসার নতুন নিয়ম চালু করা হয়েছে। এর কোন খারাপ দিক পাওয়া গেলে প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত রিভিউ করা হবে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, একক ভিসায় সত্যায়ন প্রক্রিয়া চালু হওয়ায় নানাবিধ সমস্যা দেখা দেবে। উদাহরণ টেনে এক কর্মকর্তা বলেন, সৌদি আরব বা দুবাইয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস বা হাইকমিশন থেকে কয়েক শতাধিক কিলোমিটার দূরে দেখা গেল কোন কোম্পানিতে এক জন বা দুই জন শ্রমিক লাগবে। এদেশ থেকে অপেক্ষমাণ যাত্রীটি কাঙ্ক্ষিত দেশে যাওয়ার জন্য দিন গুনছেন। ওই সময় দেখা গেল দূতাবাসের কর্মকর্তা ছুটিতে দেশে এসেছেন বা অন্য ব্যস্ততার কারণে বিষয়টি এক মাসের বেশি সময় নিষ্পত্তির অপেক্ষায় পড়ে থাকলো। তখন কোম্পানিটি অন্য দেশের কোন শ্রমিককে নিয়োগ দিয়ে দেবেন। এতে মার খাবে দেশের জনশক্তি। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাস বা হাইকমিশনে কাউন্সিলর (শ্রম) বা প্রথম সচিব (শ্রম) পদে নারী কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের পক্ষে বেশি দূরত্বে গিয়ে তদন্ত করে রিপোর্ট দেয়া সম্ভব হবে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, একক ভিসার চেয়ে দলগত ভিসায় এতদিন ঝক্কি ঝামেলা বেশি ছিল। দলগত ভিসায় দূতাবাসের সত্যায়ন থাকার পরেও দালালের হাতে প্রতারিত হওয়া, নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি টাকা নেয়া, বিদেশে গিয়ে কাজ না পাওয়া, কথা অনুযায়ী বেতন না পাওয়াসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতারিত ব্যক্তিরা জনশক্তি মন্ত্রণালয় থেকে উল্লেখযোগ্য কোন সহায়তা বা প্রতিকার পান না। যারা একক ভিসায় অর্থাৎ প্রবাসী আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা প্রতিবেশীর মাধ্যমে ভিসা এনে বিদেশে যান, তাদের ক্ষেত্রে এসব প্রতারণার ঘটনার হার হাতেগোনা। একক ভিসা পাওয়ার পর কর্মী নিজের উদ্যোগে দূতাবাসের কোন সত্যায়ন ছাড়াই রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে সরাসরি সংশ্লিষ্ট দেশে যেতে পারেন। নতুন সিদ্ধান্তের ফলে এখন তাদেরও নানা ঝক্কি-ঝামেলার মুখে পড়তে হবে। ঘাটে ঘাটে পয়সা খরচও করতে হবে। তবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় জারি করা আদেশে বলেছে, একক ভিসার ক্ষেত্রে কর্মীর নিয়োগকর্তা, মজুরি, কাজের পরিবেশসহ নানা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দূতাবাস, বিএমইটি এবং মন্ত্রণালয় অবহিত নয়। এ জন্য কর্মীদের প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। দূতাবাসও এসব কর্মীর সঠিক তথ্য সংরক্ষণ করতে পারছে না। এসব কর্মীর চাকরির নিরাপত্তা, প্রতিশ্রুত মজুরিপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা এবং সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট  দেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস বা হাইকমিশন থেকে নিয়োগসংক্রান্ত সব কাগজপত্র সত্যায়িত করাতে হবে। দূতাবাস ও হাইকমিশন কর্তৃক সত্যায়িত একক ভিসার তালিকা তাৎক্ষণিকভাবে মন্ত্রণালয় এবং বিএমইটিতে জানাতে হবে। জনশক্তি রপ্তানিকারকরা বলছেন, সরকার তথ্য রাখার কথা বলে সত্যায়ন করতে চাইছে। কিন্তু এখন প্রত্যেক কর্মীকে বিদেশে যেতে স্মার্ট কার্ড নিতে হয়। তাতে ওই কর্মী কোথায় যাচ্ছেন, কার অধীনে কাজ করছেন, সব তথ্যই থাকছে। কাজেই তথ্য সংরক্ষণের জন্য সত্যায়নের যে কথা বলা হচ্ছে, তা যুক্তিতে টেকে না।

No comments

Powered by Blogger.