‘অর্থনীতিতে সঙ্কট নেই’

অর্থনৈতিক রিপোর্টার: অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, দেশের অর্থনীতিতে কোন সঙ্কট নেই। মিডিয়া ও সুশীলসমাজ যেভাবে সঙ্কটের কথা বলেছে তা একেবারেই ঠিক নয়। তবে বিশ্বমন্দার    পৃষ্ঠা ৫ কলাম ১
কারণে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে কিছুটা মন্থর গতি রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতো একটি দেশের অর্থনীতিতে সব সময়ই সঙ্কটে ছিল। গতকাল বুধবার সকালে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন  অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) আয়োজিত ‘দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি’ নিয়ে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
এর আগে মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে ‘দেশের অর্থনীতি কালো ছায়ার মধ্যে রয়েছে’ বলার একদিন পর একথা বললেন অর্থমন্ত্রী। এফবিসিসিআই সভাপতি একে আজাদের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মঞ্জুর এলাহী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. নাসিরউদ্দিন আহমেদ, অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান, অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ ই সাত্তার, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মাদ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোহাম্মদ তারেক, পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. হোসেন মনসুর, পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান আকরাম হোসেন, বিজিএমইএ সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, ডিসিসিআই সহ-সভাপতি হায়দার আহমেদ খান, এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহ-সভাপতি জসিম উদ্দিন, সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, ডিএসই প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভী প্রমুখ। সভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে এফবিসিসিআই সভাপতি একে আজাদ দেশের অর্থনীতি সঙ্কটের সম্মুখীন বলে মত প্রকাশ করে বলেন, সরকারের অতিরিক্ত ব্যাংক ঋণের কারণে বেসরকারি উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না। টাকার ক্রমাগত অবমূল্যায়ন, ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধির কারণে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে পারছেন না। ফলে সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। রাজস্ব আদায় না হলে সরকারের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে এবং অর্থনীতিতে আরও সঙ্কট তৈরি করবে। তিনি ঋণের প্রবাহ ১৬ শতাংশে কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির সমালোচনা করে তা ২৫ শতাংশে উন্নীত করার আহ্বান জানান। এছাড়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের দূরত্ব বাড়ছে বলেও এফবিসিসিআই সভাপতি মন্তব্য করেন। তবে অর্থমন্ত্রী  সরকারের অতিরিক্ত ব্যাংক ঋণের সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন,  এ নিয়ে অনেক কথা বলা হচ্ছে। এর আগে যারা সরকারে ছিলেন তারাও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। গত ২২শে জানুয়ারির হিসাব অনুযায়ী সরকারের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি টাকা। সরকার যখন ঋণ নেয় তখন তা নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু তা শোধ করা হলে সেটি বলা হচ্ছে না। সরকারের ঋণের পরিমাণ প্রতিদিনই পরিবর্তন হচ্ছে। এটি নিয়ে সঙ্কট তৈরি করা হচ্ছে, যা দেশের জন্য বড় ক্ষতি। মূল্যস্ফীতিকে সবচেয়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা তা কমানোর চেষ্টা করছি। মূল্যস্ফীতি সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। গত বছর মুদ্রানীতি একটু বেশিই সমপ্রসরাণমূলক ছিল। এজন্য কিছু বাবল তৈরি হয়েছিল। বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবাহ ১৬-১৭ শতাংশের বেশি আশা না করার জন্য তিনি ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বলেন।
আবুল মাল আবদুল মুহিত আরও বলেন, আমাদের দেশের অর্থনীতিতে টানাপড়েন সব সময়ই ছিল। এবার একটু বেশি। আমেরিকা ও ইউরো জোনে যে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে তার এ কারণে এ টানাপড়েন তৈরি হয়েছে। এটাই এ সময়ের বাস্তবতা। বিদেশী সাহায্য না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এ জন্য আমার কোন ব্যর্থতা নেই। যে সব বৈদেশিক সাহায্য এসেছিল সেগুলো বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ব্যবহার করতে পারেনি। এটা সব জাতির ব্যর্থতা। তিনি বলেন, পুুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও দু’একটি ব্যাংক ছাড়া অন্যরা সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। তিনি ব্যাংকগুলোর উদ্দেশ্যে তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের আহ্বান জানান। সরকার সভরেইন লোন নেয়ার চেষ্টা করছে উল্লেখ করে বলেন, অনেকে এ ধরনের লোন নেয়ার বিরোধিতা করছেন। কিন্তু এটার দরকার আছে এবং এ ধরনের ঋণ নেয়ার এখনই ভাল সময়। সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর্তুকির বিষয়ে বলেন, ভর্তুকি ভাল কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এটি ভাল নয়। ভর্তুকি কমানো অর্থনীতির জন্য খুবই প্রয়োজন। এ নিয়ে যদি বিতর্ক প্রয়োজন হয়, তাহলে আমি তা করবো। সরকার কৃষি খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে এতে সাধারণ লোক উপকৃত হলেও পেট্রলে যে ভর্তুকি দিচ্ছে তার সুবিধা বিত্তশালীরাই পেয়ে থাকেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা খুবই প্রয়োজন। এ খাতে কোন ধরনের অস্থিরতা তৈরি হলে সব মাটি হয়ে যাবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মঞ্জুর এলাহী বলেন, বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জমি, বিদ্যুৎ এবং গ্যাস সঙ্কট প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। এজন্য তিনি সরকারকে অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। এছাড়া রপ্তানি পণ্য হিসেবে তৈরী পোশাকের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে এনে পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর জোর দেন তিনি। ড. কাজী খলীকুজ্জমান বলেন, বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিতে টানাপড়েন দেখা দিতে পারে। যেখানে বিশ্বমন্দা চলছে তা থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন নই। তার প্রভাব আমাদের ওপরও পড়বে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন, রাজস্ব ঘাটতি, রিজার্ভ কমছে। সে তুলনায় আমাদের সমস্যা ততটা প্রকট নয়। তবে সরকার সমস্যাগুলো চিনেছে কিনা সেটাই বিবেচ্য বিষয়। তিনি সরকারকে দ্রুত বাজেট বাস্তবায়ন, কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাদ, অপচয় রোধ ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানোর জন্য সরকারকে পরামর্শ দেন।
এনবিআর চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারের রাজস্ব আয় নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। ৬ মাসে লক্ষ্যমাত্রার বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। রাজস্ব আদায়ের জন্য বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি প্রথা চালু করা হয়েছে। এর ফলে দীর্ঘদিন ধরে অনাদায়কৃত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বেশি অর্জন হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ-ই সাত্তার বলেন, বিশ্বমন্দার জন্য আমাদের রপ্তানি কিছুটা সঙ্কুচিত হবে। শুধু তৈরী পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভর না থেকে আমাদের রপ্তানি পণ্যের পরিমাণ বাড়াতে হবে। পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের ড. হোসেন মনসুর বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও টাকার মূল্যমানের স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এতে বেসরকারি ঋণ প্রবাহ ১৬ শতাংশে কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। সরকারকে অবশ্যই ঋণ প্রবাহ কমিয়ে আনতে হবে। কারণ এর আগে ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর ফলে শেয়ারবাজার এবং আবাসন খাতে বাবল তৈরি হয়েছিল। সামষ্টিক অর্থনীতির সঙ্কট মোকাবিলায় সরকারকে অবশ্যই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি তা না হয় তাহলে অর্থনীতিতে আরও কালো মেঘের ঘনঘটা তৈরি হবে। সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অর্থনীতি একটা আস্থার সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তবে সামষ্টিক অর্থনীতি শক্তিশালী অবস্থার মধ্যে রয়েছে তা যেন আমরা ভুলে না যাই। তবে এটাও ঠিক মূল্যস্ফীতি ডবল ডিজিটে পৌঁছেছে। সুদের হার বেড়ে গেছে। কিন্তু এ অবস্থায় ব্যাংকের আমানতের সুদের হার ১২ থেকে ১৩ শতাংশে নামিয়ে আনলে কেউ ব্যাংকে টাকা রাখবে না। কিন্তু মূল্যস্ফীতি সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে এলে সুদের হার কমে যাবে। ডিএসইর প্রেসিডেন্ট শাকিল রিজভী বলেন, আমানত ও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়তে থাকলে কেউ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আসবেন না। ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও তারা সে কথা রাখেননি। বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স সুবিধা দেয়া হলেও এখন পর্যন্ত প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.